বিশ্বের সবচেয়ে বড় উল্কাগর্ত খুঁজে পাওয়া গেছে চীনে
উল্কাপাতের আঘাতে তৈরি হওয়া আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় গর্তটা ছিল চোখের সামনেই। কিন্তু তা এতদিন কেউ খেয়াল করেনি। চীনের গুয়াংডং প্রদেশের ঝাওকিং শহরের কাছে একটি পাহাড়ের দিব্যি লুকিয়ে ছিল এক বিশাল গর্ত। স্থানীয় মানুষ বা বিজ্ঞানীরা এতদিন বুঝতেই পারেননি, এটি সাধারণ কোনো গর্ত নয়। অবশেষে গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন, এটি একটি ইমপ্যাক্ট ক্রেটার বা মহাজাগতিক বস্তুর আঘাতে তৈরি হওয়া গর্ত। এর নাম দেওয়া হয়েছে জিনলিন ক্রেটার।
আধুনিক পৃথিবীর বুকে খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় ক্রেটার এটাই! ভাবতে পারেন, বারবার কেন ‘আধুনিক’ শব্দটা ব্যবহার করছি। ভূতত্ত্বের ভাষায় আধুনিক মানে গতকাল বা গত বছরের ঘটনা নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গর্তটি তৈরি হয়েছে হোলোসিন যুগে। অর্থাৎ, শেষ বরফ যুগ শেষ হওয়ার পর, মোটামুটি গত ১১ হাজার ৭০০ বছরের মধ্যে কোনো এক সময়ে। পৃথিবীর কোটি কোটি বছরের ইতিহাসের তুলনায় এই সময়টা কমই। তাই একে বলা হচ্ছে আধুনিক সবচেয়ে বড় গর্ত।
এর আকার শুনলে চোখ কপালে উঠবে। এই গর্তের ব্যাস ৮২০ থেকে ৯০০ মিটার! মানে প্রায় এক কিলোমিটার চওড়া। গভীরতা ৯০ মিটার! এর আগে রাশিয়ার মাচা ক্রেটারকে সবচেয়ে বড় আধুনিক ক্রেটার ভাবা হতো, যার ব্যাস ছিল ৩০০ মিটার। কিন্তু চীনের এই নতুন গর্তটি আগেরটিকে একুদ্ম শিশু গর্তের কাতারে ফেলে দিল।
শেষ বরফ যুগ শেষ হওয়ার পর, মোটামুটি গত ১১ হাজার ৭০০ বছরের মধ্যে কোনো এক সময়ে। পৃথিবীর কোটি কোটি বছরের ইতিহাসের তুলনায় এই সময়টা কমই।
সবচেয়ে বড় রহস্য হলো, এই গর্তটা টিকে থাকল কীভাবে? গুয়াংডং প্রদেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়, বয় মৌসুমী বায়ু। সাধারণত এমন আবহাওয়ায় হাজার হাজার বছরে মাটি ক্ষয়ে গর্ত ভরাট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু জিনলিন ক্রেটারটি প্রকৃতির এই ভাঙন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কারণ ওই পাহাড়ে আছে গ্রানাইট পাথর। পুরু গ্রানাইট পাথরের স্তরের মধ্যে তৈরি হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি বা বাতাস এর খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি।
আরেকটা প্রশ্ন হলো, বিজ্ঞানীরা কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে এটা মহাকাশ থেকেই এসেছে? আগ্নেয়গিরির মুখও তো হতে পারত! উত্তরটা লুকিয়ে আছে পাথরের আণুবীক্ষণিক কণায়। গবেষকেরা ওই এলাকার গ্রানাইট পাথরের ভেতরে প্রচুর কোয়ার্টজ কণা খুঁজে পেয়েছেন। সেগুলো চ্যাপ্টা বা বিকৃত হয়ে গেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে প্ল্যানার ডিফরমেশন ফিচার। সহজ কথায়, এই বিশেষ বিকৃতি বা দাগ তখনই তৈরি হয়, যখন পাথরের ওপর অকল্পনীয় চাপ পড়ে। প্রায় ১০-৩৫ গিগাপ্যাসকেল চাপ। পৃথিবীর কোনো ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত বা টেকটনিক নড়াচড়ার কারণে এত বিশাল চাপ তৈরি হতে পারে না। একমাত্র মহাকাশ থেকে প্রচণ্ড গতিতে আসা কোনো বস্তু আছড়ে পড়লেই এমনটা হওয়া সম্ভব।
গবেষকেরা ওই এলাকার গ্রানাইট পাথরের ভেতরে প্রচুর কোয়ার্টজ কণা খুঁজে পেয়েছেন। সেগুলো চ্যাপ্টা বা বিকৃত হয়ে গেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে প্ল্যানার ডিফরমেশন ফিচার।
গবেষকরা নিশ্চিত, এটি কোনো উল্কার কাজ, ধূমকেতুর নয়। কারণ ওটা যদি ধূমকেতু হতো, তবে গর্তটা অন্তত ১০ কিলোমিটার চওড়া হতো! তবে উল্কাটি লোহার ছিল নাকি পাথরের, তা এখনো জানা যায়নি।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০০টির মতো এমন নিশ্চিত ক্রেটার খুঁজে পাওয়া গেছে। জিনলিন ক্রেটার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, গভীর জঙ্গলে বা পাহাড়ের আড়ালে হয়তো এমন আরও অনেক মহাজাগতিক চিহ্ন লুকিয়ে আছে। সেগুলো এখনো আমরা খুঁজে পাইনি!