পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। পাশাপাশি নিজ অক্ষের ওপরও লাটিমের মতো ঘুরছে নির্দিষ্ট গতিতে। এই ঘুর্ণনকে বলা হয় আহ্নিক গতি। পৃথিবীতে দিন-রাত হয় এই গতির কারণে। কেমন হতো যদি আহ্নিক গতি অনেক বেশি হতো? অনেক বেশি মানে সর্বোচ্চ গতি হলেই বা কী হতো?
পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর প্রতি ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪.১ সেকেন্ডে একবার চক্কর দিচ্ছে। এই চক্করের গতি অবশ্য পৃথিবীর সব অংশের জন্য সমান না। মেরু থেকে যতো দূরে যাওয়া যাওয়া যায় এই গতি তত বাড়ে। বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবীর আহ্নিক গতি সবচেয়ে বেশি থাকে। প্রতি প্রায় ৪৬০ মিটার/সেকেন্ড। মেরুতে এই গতি সবচেয়ে কম। অনেক জায়গা আসলে সেই অর্থে ঘোরেই না। এ কারণে মেরু অঞ্চলের কাছে কিছু অঞ্চলে বছরের অর্ধেকটা সময়জুড়ে দিন থাকে। সূর্য অস্ত যায় না সেসব অঞ্চলে।
পৃথিবীর এই ঘূর্ণন এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দিনরাতের চক্র এই গ্রহের সার্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। শুধু তাই না, পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে ঋতুবৈচিত্র্য তৈরি হয়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর সরাসরি প্রভাব আছে আহ্নিক গতির। জোয়ার-ভাটার পিছনেও কাজ করে ঘূর্ণন। তাই, হঠাৎ করে ঘূর্ণন বেগ বেড়ে গেলে কি জলবায়ু অস্থিতিশীল হয়ে যাবে? জীববৈচিত্র্য কি বিপন্নের মুখে পড়বে এই গ্রহের?
পৃথিবীর গতি যদি ঘন্টায় ১ মাইল বেড়ে যায় অর্থাৎ মাত্র ৪৫ মিটার/সেকেন্ড হয়, তাহলে প্রতিটার দিনের দৈর্ঘ্য অন্তত দুঘন্টা কমে যাবে। তবে এটুকু পার্থক্যর জন্য খুব বেশি ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। শুরুতে জেট ল্যাগের মতো একটা অবস্থা তৈরি হবে। আর আহ্নিক গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু বার্ষিক গতি বাড়ছে বা কমছে না, তাই ক্যালেন্ডারে যোগ করতে হবে নতুন দিন।
নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যাবে সমুদ্রপৃষ্টে। বিষুবরেখা বরাবর এর উচ্চতা বেড়ে যাবে প্রায় ৯ থেকে ২০ মিটার বা ৩০ থেকে ৬৫ ফুট। নিউইয়র্ক, মুম্বাই, ভেনিসের মতো শহরগুলো তলিয়ে যাবে পানির নিচে। লাখ লাখ মানুষ হবে বাস্তুহারা।
বর্তমানে পৃথিবীর আহ্নিক গতি ১০০০ মাইল/ঘন্টা। এটাকে যদি দ্বিগুণ করা যায় অর্থাৎ ঘূর্ণন গতি, ২০০০ মাইল/ঘন্টা হলে দেখা যাবে দুর্যোগের প্রকৃত চিত্র। হিমালয়, কিলিমানজারো বা আন্দ্রেস উঁচু পাহাড় ছাড়া বাকি ভূ-খণ্ড তলিয়ে যাবে পানির নিচে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলো এই অতিরিক্ত গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না। ফলে বিঘ্নিত হতো বেতার ও ইন্টারনেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
আবহাওয়ায় আসবে ভয়াবহ পরিবর্তন। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যাবে ব্যাপকহারে। ঘন কুয়াশা, মেঘ আর ক্রমাগত বৃষ্টি স্বাভাবিক ঘটনা হতো বিষুবীয় অঞ্চলে।
আহ্নিক গতি আরও একটু বাড়লে মানুষ ছিটকে পড়তো মহাশূন্যে। ভূ-পৃষ্ট থেকে কোনকিছু মহাকাশে পাঠাতে চাইলে তার বেগ সর্বনিম্ন ১৭ হাজার ৬৪২ মাইল/ঘন্টা বা ৮ হাজার ৮৮৬ মিটার/সেকেন্ড হতে হয়। বাংলায় এই বেগকে বলা হয় মুক্তিবেগ। অর্থাৎ পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি প্রায় ১৮ হাজার মাইল/ঘন্টায় হলেই এই ঘটনা ঘটতো। শুধু মানুষ নয়, ভূ-পৃষ্ঠের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন সবকিছুই পৃথিবীর আকর্ষণ ছিন্ন করে যেত মহাশূন্যে।
দেখা যেত উর্ধ্বমুখী বৃষ্টি। অর্থাৎ আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার পরিবর্তে বৃষ্টি হতে, মাটি থেকে আকাশে। পৃথিবীর ঘুর্ণন গতি আরও কিছুটা বেড়ে প্রায় ২৪ হাজার মাইল হলে ঘটতো আরও ভয়ংকর ঘটনা। ঘূর্ণনের কারণে প্রচন্ড চাপে দুই মেরু হতো সমতল, বিষুবীয় অঞ্চল বরাবর চেপে আসতো। চ্যাপ্টার চাকতির আকার ধারণ করতো পৃথিবী। এ অবস্থায় পৃথিবীর প্রাণ টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
এবার আসল প্রশ্নে আসা যাক। পৃথিবী এই গতি বাড়তে বাড়তে যদি আলোর গতিতে গিয়ে ঠেকতো তাহলে কী ঘটতো? আলোর গতি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯২ কিলোমিটার/সেকেন্ড বা ১ লাখ ৮৬ হাজার ২৮২ মাইল/সেকেন্ড। মহাবিশ্বে এই গতিকে ধ্রুব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবী কোনোভাবে এই বেগে ঘুরলে তা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৬ লাখ ৫২ হাজার গুণ বেশি হতো।
আপেক্ষিকতার সূত্রানুযায়ী স্থির ভরের কোনোকিছু আলোর বেগে চলা সম্ভব নয়। তাই, পৃথিবীর ভাগ্যে ঠিক কী ঘটবে আলোর গতিতে ঘূর্ণনের ফলে তা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গতিতে ঘুরলে পৃথিবীর মাত্রা পরিবর্তন হয়ে যাবে। ত্রিমাত্রিক গোলক পৃথিবী পরিণত হবে পাতলা চাকতিতে। সেক্ষেত্রে পৃথিবী কঠিন এই গড়ন ঠিক থাকবে, নাকি ধুলোয় পরিণত হবে সবকিছু তা বলা কঠিন। লরেঞ্জের রূপান্তরে দেখা যায়, স্থির ভরের কোন বস্তুর বেগ আলোর বেগের সমান হলে তার দৈর্ঘ্য, ভর ও সময় অসংজ্ঞায়িত হয়ে পড়ে।
ফলে ধ্রুব গতিতে ঘোরার কারণে আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর সময় থেমে যেতে পারে। এছাড়া পুরো পৃথিবীটাই পরিণত হতে পারে ছোট ব্ল্যাকহোলে। সেই ব্ল্যাকহোল হয়ত সৌরজগতের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে না। কিন্তু মানুষসহ পৃথিবীর পুরো অস্তিত্বই বিলীয় হয়ে যাবে মহাবিশ্বের অতল রহস্যের মাঝে।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: হোয়াটঅফশো ডট কম, উইকিপিডিয়া, লাইভ সায়েন্স