মহাশূন্য অভিযানে ইউরেনাস নতুন লক্ষ্য কেন

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের গ্রহগুলোকে তিনটি মৌলিক শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এক, সূর্যের কাছের ও পাথুরে গ্রহ বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গল। দুই, তারপরের বৃহস্পতি ও শনি মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসদানব। আর তিন, সৌরজগতের শেষ প্রান্তের বিশাল ও বরফদানব ইউরেনাস (সূর্য থেকে দ্বিতীয় দূরতম গ্রহ) ও নেপচুন, এগুলো বৃহস্পতি ও শনির চেয়ে ছোট। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এদের বায়ুমণ্ডলে ও অভ্যন্তরে প্রচুর মিথেন, পানি ও অন্যান্য বরফ উৎপাদনকারী অণু রয়েছে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো সব সময় আগ্রহোদ্দীপক বলে বিবেচিত হলেও, অন্যান্য নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা শুরু না হওয়া এবং ইউরেনাস ও বৃহষ্পতির মতো বরফদানব না পাওয়া পর্যন্ত যথেষ্ট কৌতূহল সৃষ্টি হয়নি।

জার্মান জ্যোর্তিবিদ উইলিয়াম হর্শেল ১৭৮১ সালের ১৩ মার্চ টেলিস্কোপে জেটা টাউরি তারার কাছে একটা অস্বাভাবিক দুর্বল বস্তু দেখতে পান। তিনি এটি কয়েক রাত পর্যবেক্ষণ করেন। জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা প্রথমে ধারণা করেছিলেন, তিনি একটি ধূমকেতু দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু পরে এটাকে দূরবর্তী একটি গ্রহ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। নাম দেওয়া হয় ইউরেনাস।

ইউরেনাস একমাত্র গ্রহ, যার নাম রোমান দেবতার পরিবর্তে গ্রীক দেবতার নামে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় ইউরেনাসকে একটি খুব অস্বাভাবিক গ্রহ হিসাবে দেখানো হয়েছে। সৌরজগতের অন্য গ্রহগুলি যেখানে লাটিমের মতো ঘুরছে, সেখানে ইউরেনাস সৌরতলের সঙ্গে কাত হয়ে আছে। এটা সূর্য থেকে দূরতম গ্রহই শুধু নয়, সৌরজগতের শীতলতম গ্রহও বটে। গ্রহটি সূর্যকে ২.৮ বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে প্রদক্ষিণ করে ও সূর্যের চারিদিকে ঘুরে আসতে সময় লাগে ৮৪ বছর। গ্রহটিতে একটানা ৪২ বছর রাত ও ৪২ বছর দিন বিরাজ করে। এর বায়ুমণ্ডল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও মিথেনের, উপগ্রহ পরিবার ও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রসমৃদ্ধ বিশাল, বৈশিষ্ট্যহীন, ফ্যাকাশে নীল বর্ণের। এই নীল রংটা আসে মূলত মিথেন থেকে।

জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত এসব অস্বাভাবিকতা সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে ইউরেনাসের খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা তেমন করেননি বিজ্ঞানীরা। একমাত্র একটি রোবট প্রোব পাঠানো হয়েছিল, ১৯৮৬ সালে যখন মার্কিন ভয়েজার ২ সৌরজগতে ভ্রমণকালে ইউরেনাসের পাশ দিয়ে যায়, তখন। তবে চলতি বছরের প্রথম দিকে যুক্তরাস্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমি প্রকাশিত প্রতিবেদনে মহাকাশ সংস্থা নাসাকে পরবর্তী দশকে একটি মিশন ইউরেনাসে পাঠানোর আহ্বান জানায়, এবং বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে বলে।

বৃহষ্পতি ও শনিসহ অভ্যন্তরীণ সব গ্রহেই অনেক বার প্রোব পাঠানো হয়েছে। এমনকি দূরবর্তী ও ক্ষুদ্র প্লূটোতেও জরিপ হয়েছে। লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেই ফ্লেচার বলছেন, ইউরেনাস থেকে কম জানাশোনার সৌরজগতের অল্প কিছু জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে শুধু। কাজেই ইউরেনাস অভিযান আমাদের জ্ঞানের এই শূন্যতাকে পূর্ণ করবে। তাঁর মতে, ইউরেনাস ও বৃহস্পতির মতো গ্রহের অবশ্যই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এর গঠন, প্রকৃতি ও উৎস তুলনামূলক রহস্যময়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্যাট্রিক আরউইন বলেন, একটা তত্ত্ব মতে, অতীতে একটা প্রকাণ্ড বস্তু, সম্ভবত কোনো বড় গ্রহাণু ইউরেনাসকে আঘাত করে। এটি ইউরেনাসের জন্ম থেকে আর কোনো অভ্যন্তরীণ তাপ অবশিষ্ট রাখেনি। এটিই তাকে সৌরজগতের শীতলতম গ্রহে পরিণত করেছে। বৃহষ্পতি, শনি, এমনকি নেপচুনেরও এখনও অভ্যন্তরীণ কিছু তাপ রয়েছে। তাঁর ওপর এরা সূর্য থেকে যে শক্তি আহরণ করে, তার চেয়ে বেশি শক্তি বিকিরণ করে। কিন্তু ইউরেনাস এমনটা করে না। মনে করা হয়, এর সমস্ত অভ্যন্তরীণ তাপ উধাও হয়ে গেছে। কারণ সম্ভবত বড় মাত্রার আঘাতের প্রভাব এর ভেতরের অংশটিকে বাইরে নিয়ে আসে। বাইরে এসে অভ্যন্তরের তাপ মহাশূন্যে দ্রুত বিকিরিত হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।

তবে দূরবর্তী হওয়ায় ইউরেনাস মিশন লক্ষ্যে পৌঁছাতে বৃহষ্পতির মাধ্যাকর্ষণ সহায়তা প্রয়োজন হবে। এ ধরনের কৌশল সৌরজগতে অন্য অনেক মিশনে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে মহাকাশযান তার পথিমধ্যের কোনো গ্রহের কাছ দিয়ে যায়। এতে ক্যাপসুলটি শক্তি অর্জন করে ও অনেক যন্ত্র বহণ করতে পারে। ইউরেনাস মিশনে এই মাধ্যাকর্ষণ সহায়তা বা গ্রাভিটি অ্যাসিস্ট ব্যবহার করে ২০৩১ বা ২০৩২ সালে জুপিটারে পৌঁছাতে পারে। প্রোবের ডিজাইন ও চার বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি তহবিল যোগাড় করে, প্রোব নির্মাণ ও ১৩-বছরের অভিযান উৎক্ষেপণের জন্য নাসার এক দশক সময় প্রযোজন হবে।

প্রধান যানের ইউরেনাসকে প্রদক্ষিণের ও জরিপের এবং মাঝে মাঝে কাছের উপগ্রহসমূহ ও রিংসমূহকে কাছ থেকে পরিদর্শনের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে বেশিরভাগ মতামতে। অন্য নক্ষত্রের কাছে বরফদানবদের উপস্থিতি একটা সাধারণ ব্যাপার কেন, তার ব্যাখ্যার প্রমাণ খুঁজে দেখা ছাড়াও ইউরেনাসের অন্যান্য রহস্যের সমাধান, পাশাপাশি গ্রহটি এত শীতল হওয়া ও গ্রহের ঘূর্ণণের অক্ষ পাশের দিকে কাত হওয়ার কারণগুলোও জানার চেষ্টা করা হবে এ মিশনের লক্ষ্য। সেজন্য একটি সঙ্গী প্রোব ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করিয়ে তার উপাদান সম্বন্ধে পরীক্ষা চালানো হবে। তবে বরফদানব অভিযানে আবশ্যিকভাবে অন্য সংস্থা, যেমন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইসা) অংশগ্রহণ দরকার হবে। কিন্তু নাসা মঙ্গল গ্রহ থেকে শিলা পৃথিবীতে আনা, বৃহষ্পতির বরফঢাকা উপগ্রহ ইউরোপাতে ২০২৪-এ প্রোব প্রেরণ ইত্যাদি বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে। তাই দেখার বিষয় হলো, ইউরেনাসের জটিল পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য প্রোব নির্মাণ ও মিশন পাঠানোর কাজে নাসা যথেষ্ট দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে কি না।

সূত্র: রবিন ম্যাকির/জার্নি টু দ্য মিস্ট্রি প্ল্যানেট: হোয়াই ইউরেনাস ইজ দ্য নিউ টার্গেট ফর স্পেস এক্সপ্লোরেশন, দ্য গার্ডিয়ান, ১৬ জুলাই ২০২২০

লেখক: ভূতত্ত্ববিদ