মহাকাশ
মহাবিশ্বের রহস্য এবং জেমস ওয়েব
নাসা প্রথম দফায় জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা পাঁচটি ছবি প্রকাশ করে। ছবিগুলোকে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। কী আছে এ ছবিগুলোতে, প্রতিটি ছবি তুলতে জেমস ওয়েব কোন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে—তারই অনুপুঙ্খ বিবরণ…
‘আকাশভরা সূর্য-তারা’ দেখেনি পৃথিবীতে এমন মানুষ মেলা ভার। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলেই মেঘহীন আকাশে তারা ঝকমক করতে শুরু করে। বুদ্ধিমান মানুষ, কৌতূহলী মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই অপার বিস্ময়ে আকাশের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো যেমন দেখছে, তেমনি গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনেক প্রাকৃতিক ঘটনারই রহস্য উন্মোচন করে ফেলেছে। মহাবিশ্বের মহাজাগতিক ঘটনাবলি বৈজ্ঞানিক উপায়ে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার যে জ্যোতির্বিজ্ঞান—তার ইতিহাস অনেক পুরোনো। খালি চোখে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করার আদি সময় আমরা পার হয়ে এসেছি গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও যখন আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কার করে ফেললেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের আকাশে নতুন সূর্যোদয় হলো। এর আগের প্রায় আড়াই হাজার বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার ধরন বদলে গেল গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের মাধ্যমে।
পরবর্তী কয়েক শ বছরের মধ্যে একের পর এক তৈরি হতে থাকল অনেক শক্তিশালী টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য তৈরি হলো অবজারভেটরি বা মানমন্দির। পৃথিবী থেকেই এসব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে বসানো টেলিস্কোপ যত শক্তিশালীই হোক, তাদের কিছু গুণগত সীমাবদ্ধতা কিছুতেই দূর করা সম্ভব হয়নি। যেকোনো টেলিস্কোপের প্রধান কাজ হলো মহাকাশ থেকে আসা আলো অনুসন্ধান করে শনাক্ত করা এবং সেই আলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা। সুদূর মহাকাশ থেকে আলো পৃথিবীতে আসার সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল মহাকাশের আলোর কিছু অংশ শোষণ করে ফেলে। আবার কিছু অংশ পৃথিবীর ধূলিকণার গায়ে লেগে বিক্ষিপ্ত হয়। আলোর স্ক্যাটারিং থিওরি বা বিক্ষেপণের তত্ত্ব থেকে আমরা জানি যে আলোর বিক্ষেপণের ফলেই দিনের বেলায় পৃথিবীর আকাশ নীল দেখায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কারণে মহাকাশের মহাজাগতিক ঘটনাগুলো নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কোটি আলোকবর্ষ দূরের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসতে আসতে উজ্জ্বলতা হারায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কারণে দীপ্তমান তারাগুলোও মিটমিট করতে থাকে পৃথিবীর আকাশে। ফলে মহাকাশের অনেক রহস্যই অধরা থেকে যায় পৃথিবীতে স্থাপিত সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপগুলোতেও। অনেক উঁচু পাহাড়ের ওপর মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেখানে টেলিস্কোপ স্থাপন করেও এ সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
এত সব অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসংখ্য আবিষ্কার, মহাবিশ্বের অসংখ্য রহস্যের সমাধান পৃথিবীতে স্থাপিত টেলিস্কোপের মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা করে ফেলেছেন। তাতে আনন্দ যেমন আছে, অতৃপ্তিও আছে। অতৃপ্তি হলো যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল প্রেরণা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয়েছে স্যাটেলাইট যুগ। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে কৃত্রিম স্যাটেলাইট পাঠাতে শুরু করেন। শুরু হয় মহাকাশকে জানার নতুন পদ্ধতি। ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এর মাধ্যমে স্থাপিত হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরেকটি নতুন যুগ—স্যাটেলাইট টেলিস্কোপের যুগ।
প্রায় ১৩ মিটার লম্বা ও ৪ দশমিক ৩ মিটার চওড়া ১১ টন ভরের হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘণ্টায় প্রায় ২৭ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে ৩২ বছর ধরে। প্রতি সপ্তাহে হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে প্রায় ১৫০ গিগাবিট ডেটা। হাবল টেলিস্কোপের পাঠানো ডেটা থেকেই আমরা নিশ্চিত হয়েছি, মহাবিশ্ব কী হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। হাবল টেলিস্কোপের ডেটার সাহায্যে আমরা প্রমাণ পেয়েছি ব্ল্যাকহোলের। বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন বিশালাকৃতির ব্ল্যাকহোল। হাবল আমাদের খুঁজে দিয়েছে অনেক নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা। হাবল টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দিয়েছে আশ্চর্য গতি। এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে হাবলের সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে।
কিন্তু এটুকুতে খুশি হয়ে বসে থাকা বিজ্ঞানীদের কাজ নয়। হাবল টেলিস্কোপের যেটুকু দুর্বলতা আছে, সেটুকু দূর করে মহাকাশে আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ স্থাপনের পরিকল্পনা বিজ্ঞানীরা করছেন অনেক বছর থেকে। যেমন হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি ঘুরছে বলে অনেক সময় পৃথিবী নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় হাবল টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। আবার হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার সময় ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্টের একটা অংশের কাছ দিয়ে যায়। তখন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হাবল টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতিতে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ সৃষ্টি করে, যা ডেটা সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটায়। হাবল টেলিস্কোপের ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার অতি দূর নক্ষত্র থেকে আসা ক্ষীণতম আলো থেকে যে ছবি নির্মাণ করে, তা খুবই অনুজ্জ্বল আর অস্পষ্ট। এসব ত্রুটি দূর করে সম্পূর্ণ নতুন একটি স্যাটেলাইট নির্মাণ করে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, যার নাম জেমস ওয়েব।
২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর জ্যোতির্বিজ্ঞানে শুরু হয় নতুন বিপ্লব। সেদিন পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও অনেক গুণ শক্তিশালী নতুন টেলিস্কোপ—জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। হাবল টেলিস্কোপের সঙ্গে জেমস ওয়েবের গঠনে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। হাবল টেলিস্কোপের আকার যদি একটি ৫০ সিটের বাসের সমান হয়, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আকার একটি টেনিস কোর্টের সমান। হাবলের দর্পণের ব্যাস ২ দশমিক ৪ মিটার, জেমস ওয়েবের দর্পণের ব্যাস ৬ দশমিক ৫ মিটার। হাবলে যে ক্যামেরাগুলো আছে সেগুলো অতিবেগুনি আলো, দৃশ্যমান আলো এবং নিয়ার-ইনফ্রারেড বা দৃশ্যমান আলোর কাছের অবলোহিত আলোর তরঙ্গ শনাক্ত করে ছবি তুলতে পারে। জেমস ওয়েবের ক্যামেরাগুলো কাজ করে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোকতরঙ্গে। হাবল টেলিস্কোপ যেখানে পৃথিবী থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, সেখানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে, চাঁদের অক্ষের কাছাকাছি দূরত্বে। এর ফলে মহাকাশের অনেক ভেতরে চোখ রাখা সম্ভব হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের।
মহাকাশে পূর্বনির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করার পর গত ছয় মাস ধরে চলছিল প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষাগুলোর বিভিন্ন ধাপ। এখন সেসব ধাপ সফলভাবে পার হয়ে মূল বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। শুরুতেই বিশ্বব্যাপী হইচই ফেলে দিয়েছে। ৩০ বছর আগে হাবল টেলিস্কোপ যে রকম হইচই ফেলে দিয়েছিল মহাকাশের নতুন নতুন তথ্য ও ছবি দিয়ে। সে রকম আরও অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব বিশ্ববাসীকে উত্তেজনায় টান টান করে দিয়েছে তার প্রথম কয়েকটি ছবি প্রকাশিত হতে না হতেই।
এ বছরের ১২ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম পাঁচটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রায় এক দশক প্রস্তুতির পর এক হাজার কোটি ডলারের টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে যে উদ্দেশ্যে, সেই উদ্দেশ্য সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে। প্রথম প্রকাশিত ছবিগুলো থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এত দিন আগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাকাশের যেসব চিত্র আবছা দেখা গিয়েছিল, এবার তা স্পষ্ট হলো। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ছবিগুলো হাবল টেলিস্কোপের ছবিগুলোর চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি স্পষ্ট।
ঠিক কী কী বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য ঠিক করে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে? বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলোকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম লক্ষ্য হলো, একেবারে শৈশবের মহাবিশ্বের স্বরূপ উদ্ঘাটন। বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলোর আলোর সন্ধান করতে পারলে বোঝা যাবে কীভাবে এই গ্যালাক্সিগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, গ্যালাক্সিগুলোর বিবর্তন অনুসন্ধান। প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলো থেকে বর্তমান যুগের গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে কী কী বিবর্তন হয়েছে এবং কীভাবে হয়েছে। তৃতীয় লক্ষ্য হলো, নক্ষত্রগুলো কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে—একেবারে প্রথম পর্যায় থেকে শুরু করে তাদের গ্রহ-উপগ্রহসহ নক্ষত্রজগতের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে, তা খুঁজে বের করা। আর চতুর্থ লক্ষ্য হলো, আমাদের সৌরজগৎসহ অন্য গ্রহ-উপগ্রহগুলোর বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম পরীক্ষা করে দেখা এবং আমাদের পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহ বা উপগ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।
পৃথিবীর কাছাকাছি হওয়ায় হাবল টেলিস্কোপ সরাসরি আমাদের সূর্যের দিকে তাকাতে পারে না। ফলে সূর্যের কাছের গ্রহ বুধ ও শুক্রের খুব বেশি তথ্য হাবল সরাসরি সংগ্রহ করতে পারেনি। জেমস ওয়েবের সে সীমাবদ্ধতা নেই। আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আছে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের শক্তিশালী ক্যামেরাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করতে পারে এবং সেই আলোতে ছবি তুলতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করার দরকার কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আলোর পদার্থবিজ্ঞান কিছুটা বুঝতে হবে। আলোর গতিবেগ শূন্য মাধ্যমে যে সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লাখ কিলোমিটার, তা আমরা জানি। আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে আলোর শক্তি তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। আলো যখন কোনো উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে একই মাধ্যমে চলতে থাকে, তখন এর গতিবেগের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু আলোকতরঙ্গ হলো বিদ্যুৎ–চুম্বক তরঙ্গ, যার কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্য একে অপরের বিপরীত অনুপাতিক। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি বেড়ে যায়, কম্পাঙ্ক কমে যায়। হাবল টেলিস্কোপ থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্ব যখন প্রসারিত হচ্ছে, একই সঙ্গে আলোর তরঙ্গও প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে সময়ের সঙ্গে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান আলোর বর্ণালির সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে লাল আলোর আর সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে বেগুনি আলোর। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেলে তা হয়ে পড়ে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো। এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তির সীমানার বাইরে। অর্থাৎ অবলোহিত আলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়ে লাল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় রেড শিফট বা লাল সরণ। আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে গিয়ে বেগুনি বা নীল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় ব্লু শিফট। এই রেড শিফটের পরিমাণ হিসাব করে জানা যায় মহাবিশ্ব কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে এবং সেই সময়ে আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে। সেই দূরত্বের হিসাব থেকে সময়ের হিসাব বের করা যায়। আলো এক সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার যায়। সে হিসাবে আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে, সেই দূরত্বকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ। এখন কোনো একটি নক্ষত্র যদি পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে থাকে, সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে এক বছর। যেমন সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। এ সময়কে আলোর গতি দিয়ে গুণ করলে আমরা সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বের করতে পারি। একইভাবে আমরা বলতে পারি, পৃথিবী থেকে যখন আমরা সূর্যকে দেখি, তখন আসলে দেখি ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড অতীতের সূর্য। অনুরূপভাবে আমরা বলতে পারি, আকাশে যেসব সূর্য-তারা আমরা দেখি, সেগুলো থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে যদি কোটি বছর লাগে, তাহলে সেগুলো কোটি বছর আগের নক্ষত্র আমরা দেখছি।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ইনফ্রারেড ক্যামেরা কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি থেকে ভেসে আসা অবলোহিত আলো শনাক্ত করতে পারে। কোটি বছরের সফর শেষে এই আলো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নায় এসে প্রতিফলিত হয়। ইনফ্রারেড ওয়েভ ডিটেক্টর সেই আলো শনাক্ত করে। সেখান থেকে তৈরি হয় গভীর মহাকাশের ছবি। শুধু তা–ই নয়, ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ থেকে মহাবিশ্বে ভাসমান সব ধরনের অণুর ধর্ম বিশ্লেষণ করে দেখতে পারবে পৃথিবীর অন্য কোনো সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে প্রাণী আছে কি না।
এই টেলিস্কোপের প্রোগ্রাম ডিজাইনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা (NASA), ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ইসা (ESA), কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি সিসা (CSA)। টেলিস্কোপের সায়েন্স অপারেশন সেন্টার, যেখান থেকে মহাকাশের বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে স্থাপিত স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট। এখান থেকে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলোও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গত ১২ জুলাই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের যে কটি ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো বাছাই করেছেন স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন একটি জগতের পর্দা সরে গেল এই ছবিগুলোর মাধ্যমে।
পাঁচটি ছবির একটি হলো SMACS 0723। এই ছবিটি তোলা হয়েছে টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে। এ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার গ্যালাক্সি। সামনের উজ্জ্বল গ্যালাক্সির দল পেছনের গ্যালাক্সির আলোকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে। সামনের গ্যালাক্সির বয়স আমাদের পৃথিবীর বয়সের কাছাকাছি ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন বছর বা ৪৬০ কোটি বছর। পেছনের গ্যালাক্সি দল তৈরি হয়েছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর আগে অর্থাৎ ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর আগে। জেমস ওয়েব এই গ্যালাক্সিগুলোর অনেক ডেটা সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। এই ডেটা থেকে আমরা বুঝতে পারব, কীভাবে প্রথম প্রজন্মের গ্যালাক্সিগুলো গঠিত হয়েছিল। এই গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যেই থাকতে পারে সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সি, যেগুলো তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি বছরের মধ্যে—মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর দিকে। জেমস ওয়েবের এই ছবির ডেটা থেকে আমরা এত দিনের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি।
প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? বিগ ব্যাংয়ের পর প্রথম কিছুক্ষণ (সময় তখনো শুরু হয়নি) সবকিছু অন্ধকার ছিল। পদার্থ যদি কিছু থেকে থাকে, তা ছিল সব ডার্ক ম্যাটার। ডার্ক ম্যাটার কোনো আলো নির্গমন ও প্রতিফলন করে না। অথবা ছিল নিউট্রাল হাইড্রোজেন কিংবা হিলিয়াম। তারপর কয়েক শ মিলিয়ন বছর পর (প্রায় ১০ কোটি বছর) পর গ্যাসগুলো ধীরে ধীরে জোট বাঁধতে বাঁধতে গ্যাসীয় নক্ষত্রের সৃষ্টি হলো। প্রথম আলোর আবির্ভাব হলো। এই আলোর বিকিরণের ফলে আয়নিত হলো নিউট্রাল গ্যাস। মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে গ্যাস থেকে ফুটন্ত তরল, তারপর গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ–উপগ্রহের স্ট্রাকচার পেল। এগুলো আমরা নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব থেকে জানি। কিন্তু সরাসরি তেমন জোরালো প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে নেই। জেমস ওয়েব আমাদের সেই প্রমাণ জোগাবে বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।
প্রকাশিত দ্বিতীয় ছবিটি স্টিফেন্স কুইনটেট (Stephans Quintet)। এই ছবি হলো এ পর্যন্ত জেমস ওয়েবের তোলা সবচেয়ে বড় ছবি। এর ব্যাস চাঁদের ব্যাসের এক–পঞ্চমাংশ। ১৫ কোটি পিক্সেলের এই ছবিতে আছে পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি গ্রুপ—পরস্পরের কাছাকাছি আসছে ২৯০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জে। এই ছবি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, এর কেন্দ্রে আছে একটি সুপারম্যাসিভ বা প্রচণ্ড ভরসম্পন্ন ব্ল্যাকহোল। সেখান থেকে একটি নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে। এখান থেকে যে ডেটা পাওয়া গেছে, সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের জন্ম কীভাবে হয়, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের জন্মও কীভাবে হয়।
তৃতীয় ছবিটি কারিনা নেবুলার (CARINA NEBULA) সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং বৃহত্তম নেবুলা হচ্ছে কারিনা নেবুলা। নেবুলা হচ্ছে নক্ষত্রের জন্মভূমি। গ্যাস ও ধূলিকণা যেখান থেকে নক্ষত্রের জন্ম হয়। নক্ষত্রের উপাদানগুলোর ভেতরের অনেক তথ্য জানা যাবে এখান থেকে। কারণ, ইনফ্রারেড রে শনাক্ত করে বিশ্লেষণ করার উপায় আছে জেমস ওয়েবে। এ থেকে নক্ষত্র কীভাবে সৃষ্টি হয়, তা আরও ভালোভাবে জানা যাবে। কারিনা নেবুলা সাউদার্ন কনস্টেলেশন কারিনা থেকে ৭ হাজার ৬০০ আলোকবর্ষ দূরে। এই ছবিতে যতগুলো ছোট ছোট উজ্জ্বল বিন্দু দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সবই নতুন নক্ষত্র। শত শত নতুন নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। আরও অনেক পরিষ্কার ঘটনা দেখা যাচ্ছে যেগুলো নতুন তথ্য দেবে আমাদের।
চতুর্থ ছবি সাউদার্ন রিং নেবুলা (SOUTHERN RING NEBULA)। এটা প্ল্যানেটারি নেবুলা, যেখানে আছে গ্যাসের মেঘ যা সম্প্রসারিত হচ্ছে চারদিকে। গ্যাসগুলো মৃতপ্রায় নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে অথবা দুটি মৃতপ্রায় নক্ষত্র একটি অন্যটির চারপাশে ঘুরছে। এর ব্যাস প্রায় অর্ধ-আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষের অর্ধেক)। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় দুই হাজার আলোকবর্ষ। ফেনার মতো কমলা রঙের যে কোষগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হাইড্রোজেন অণু। দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে হাইড্রোজেন অণু তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রে যে নীল রঙের অংশ দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আয়নিত গ্যাস। ডান পাশের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, দুটি নক্ষত্র ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে কেন্দ্রে। এখান থেকে যে ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের মৃত্যু কীভাবে হয়। নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ এর আগে কখনো হয়নি।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তার বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অনুসারে মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহে অনুসন্ধান চালাচ্ছে, সেখানে কোথাও কোনো প্রাণ ধারণের উপাদান পাওয়া যায় কি না। প্রাথমিক ছবিগুলোর মধ্যে আমাদের সৌরজগতের বাইরের এক বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ WASP-96 b-তে পানির অস্তিত্বের প্রমাণ প্রকাশ করেছে। আমাদের সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে এই বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ। শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহের গ্যাসীয় উপাদান বিশ্লেষণ করার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা আছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের, এই ছবি তারই প্রমাণ।
মহাকাশ দেখার এত দিনের শক্তিশালী মাধ্যম হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা দিয়েছিল, সেই ধারণা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার জন্য আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের চোখের সামনে এনে দিচ্ছে মহাকাশের গভীর থেকে গভীরের চিত্র। আগে যা আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়েছে, এখন সেগুলো বাস্তবে চলে আসতে শুরু করেছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের মহাবিশ্বের অনেক নতুন রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
সূত্র: ১. মারিয়া আরিয়াস/দ্য কসমস অ্যাজ উই হ্যাভ নেভার সিন বিফোর, নিউ সায়েন্টিস্ট, ৯ জুলাই ২০২২
২. মার্টিন বারস্টো/দ্য কনভারসেশন ১৩ জুলাই, ২০২২
৩. কার্ল গ্ল্যাজারব্রুক ও সাইমন ড্রাইভার/দ্য কনভারসেশন, ১৩ জুলাই ২০২২
৪. বিজ্ঞানচিন্তা, নভেম্বর ২০২১; ৫. webb.nasa.gov
ক্যাপশন: আবদুল্লাহ আল মাকসুদ