মহাকর্ষ: টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না

এই লেখাটা যাঁরা বিছানায় শুয়ে, বসে কিংবা মাটিতে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন মহাকর্ষ কী। অন্তত এটুকু নিশ্চয়ই জানেন, মহাকর্ষের টান না থাকলে এই লেখাটা পড়তে হতো মহাকাশে ভাসতে ভাসতে। আসলে মহাকর্ষই পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সূর্যে শক্তি নিঃসরণ বা মহাকাশের দানব কৃষ্ণগহ্বরও তৈরি হচ্ছে ওই বলের কারণেই। কথিত আছে, নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার জন্যও দায়ী ওই বল। তবে প্রেমে পড়ার সঙ্গে যে মহাকর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই, সাফ সাফ সেটি জানিয়ে দিয়েছেন আইনস্টাইন। কিন্তু মহাকর্ষকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য কি এটুকুই যথেষ্ট?

আমরা জানি, আমাদের চারপাশের জগতে এই বলটা কাজ করছে। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না এই বলটা অদ্ভুত। জাত-ধর্মেও অন্যদের চেয়ে আলাদা। অসামাজিক। কারণ, মহাবিশ্বের অন্যান্য মৌলিক বলের প্যাটার্নের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সেগুলোর সঙ্গে মহাকর্ষের কোনো মিল নেই। প্রথমত, অন্যান্য বলের তুলনায় মহাকর্ষ খুবই দুর্বল। আবার এই বল কখনো বিকর্ষণ করে না, সব সময় আকর্ষণ করে। শুধু কি তাই, কোয়ান্টাম জগতের সঙ্গেও এই বলকে খাপ খাওয়ানো যায় না। মোদ্দা কথা, মহাকর্ষ টানে সবাইকে, কিন্তু অন্যদের সঙ্গে বাঁধনে জড়ায় না। ঠিক দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী বাঙালি স্পাই মাসুদ রানার মতো।

আবার অন্য মৌলিক বলগুলোর সঙ্গে খাপ না খাওয়ার ব্যাপারটাও বেশ রহস্যময়। বিজ্ঞানীদের জন্য হতাশাজনকও বটে। কারণ, বিজ্ঞানীরা সবকিছুতে প্যাটার্ন খোঁজেন। অপরূপ মহাবিশ্বের বিচিত্রতা ও জটিলতা দেখলে অভিভূত না হয়ে আমাদের উপায় থাকে না। তার মধ্যে কোনো প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া গেলে বিষয়টা বোঝা যায়। যেমন আপনার পরিচিত কোনো মানুষের কথা চিন্তা করুন। তার ফেসবুক প্রোফাইল দেখলে যতটা না চেনা সম্ভব, তার চেয়ে বেশি চেনা বা বোঝা যাবে তার ইন্টারনেট ব্রাউজিং হিস্ট্রির প্যাটার্ন পরীক্ষা করলে। এভাবে মহাবিশ্বকে বোঝার বা ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা গেছে, মহাকর্ষ অন্য সব বলের এই প্যাটার্নের সঙ্গে খাপ খায় না।

অন্যান্য বলের তুলনায় মহাকর্ষের দুর্বলতা কতটুকু, তা বুঝতে আরেকটা পরীক্ষা করা যায়। সে জন্য দরকার হবে একটি চিরুনি ও ছোট ছোট টুকরা করে কাটা কিছু কাগজ।

সবকিছুকে কোনো প্যাটার্নে খাপ খাওয়ানোর ইচ্ছা পদার্থবিদদের অনেক দিনের। এর একটি কারণ, তাঁরা পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছুকে একত্র করে একটিমাত্র তত্ত্বের ভেতরে আনতে চান। অর্থাৎ একটিমাত্র তত্ত্ব দিয়ে মহাবিশ্বের সবকিছু ব্যাখ্যা করতে চান তাঁরা। একে বলা হয় থিওরি অব এভরিথিং বা সবকিছুর তত্ত্ব। এই চাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা মহাকর্ষ। সেটিই একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা যাক।

 কখনো কি ভীষণ বিস্ময়ে ভেবেছেন, আপনি পৃথিবীতে আটকে আছেন কেন? মহাকাশে ছিটকে পড়ছেন না কেন? এর একটিই উত্তর, মহাকর্ষ। এই বলটাই আপনাকে ভূপৃষ্ঠে আটকে রেখেছে। মহাকর্ষ ছাড়া আমরা কেউই পৃথিবীতে আটকে থাকতে পারতাম না, থাকতে হতো মহাশূন্যে ভেসে। অবশ্য তখন মহাবিশ্বও পরিণত হতো ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিশালাকৃতির গ্যাস আর ধূলিকণায়। মহাকর্ষ না থাকলে গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ বলে কিছু থাকত না। কাজেই বলতেই হচ্ছে, মহাকর্ষের প্রভাব বলেন আর প্রতিপত্তি বলেন, তা বিশাল, বিপুল। অনেক বড় পরিসরের। অথচ মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষই সবচেয়ে দুর্বল। কিন্তু কতটা দুর্বল?

সেটি শুনলেও অনেকের চোখ কপালে উঠে যেতে পারে। মোটা দাগে বললে, অন্য তিনটি মৌলিক বলের তুলনায় প্রায় ১০৩৬ ভাগ দুর্বল এই মহাকর্ষ। অর্থাৎ ১/১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগ। এত বড় সংখ্যা উপলব্ধি করা সহজ নয়। একটু সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনার কাছে একটি পেঁপে আছে। পেঁপেটা কেটে চার ভাগ করলে এর প্রতিটি টুকরা হবে পেঁপেটির এক–চতুর্থাংশ। পেঁপেটাকে ১০৩৬ ভাগ করা হলে প্রতিটি টুকরোর আকার হবে পেঁপের একটি অণুর চেয়েও ছোট। আর পেঁপের একটি অণুর সমান টুকরার আকার করতে চাইলে আপনাকে প্রায় ২০ লাখ পেঁপে কেটে সমান ভাগে টুকরা করতে হবে। বোঝা গেল, ব্যাপারটা?

অন্যান্য বলের তুলনায় মহাকর্ষের দুর্বলতা কতটুকু, তা বুঝতে আরেকটা পরীক্ষা করা যায়। সে জন্য দরকার হবে একটি চিরুনি ও ছোট ছোট টুকরা করে কাটা কিছু কাগজ। শুকনা চিরুনিটা দিয়ে আপনার মাথার শুকনো চুল কিছুক্ষণ আঁচড়ে কাগজের টুকরার কাছে ধরুন। দেখা যাবে, কাগজের টুকরাগুলোকে চিরুনিটা আকর্ষণ করছে। কিছু কাগজ চিরুনির সঙ্গে লেগেও যাবে। এর কারণ স্থির বিদ্যুৎ। চিরুনির সামান্য বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বলও কাগজের টুকরাগুলোকে চিরুনির সঙ্গে আটকে রাখে। অথচ কাগজের টুকরাগুলোর ওপর পৃথিবীর মহাকর্ষ কাজ করছে। কিন্তু গোটা পৃথিবীর মহাকর্ষও চিরুনির সেই আকষ৴ণ ঠেকাতে পারছে না। এতে বোঝা যায়, বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বলের তুলনায় মহাকর্ষ কত দুর্বল। একটি ছোট চুম্বক লোহাজাতীয় কিছুর কাছে ধরলে তা বিশাল পৃথিবীর মহাকর্ষকে বুড়ো আঙুল দেখাবে।

অনেকে হয়তো ভাবছেন, মহাকর্ষ যদি এত দুর্বলই হয়, তাহলে মহাবিশ্বে তার গুরুত্ব আসলে কী? শক্তিশালী অন্য বলের কাছে মহাকর্ষ কি ধরাশায়ী হবে না? তাহলে গ্রহ আর নক্ষত্রগুলোকে মহাকর্ষ কীভাবে নিদি৴ষ্ট কক্ষপথে ধরে রেখেছে? অন্যান্য বলের প্রভাবে সেগুলো ছিটকে যাচ্ছে না কেন? কিংবা অন্য বলগুলো যদি এত শক্তিশালী হয়, তাহলে তারা মহাকর্ষের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে মহাকর্ষ বলকে মহাবিশ্ব থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারছে না কেন?

এর উত্তর হলো, অনেক বড় পরিসরে মহাকর্ষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার বিপুল ভরের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ এই বল। দুর্বল ও সবল পারমাণবিক বল কাজ করে কেবল অতিক্ষুদ্র পরিসরে। কাজেই এ দুটি বলের সিংহভাগই শুধু অতিপারমাণবিক পরিসরে উপলব্ধি করা যায়। অন্যদিকে গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথের চলাফেরায় বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বলের বড় কোনো ভূমিকা নেই। কারণ, বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বল দ্বিমুখী, কিন্তু মহাকর্ষ একমুখী।

মহাকর্ষ শুধু বস্তুকে আকর্ষণ করে বা টানে, বিকর্ষণ করে না। এর কারণ, বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বলের সঙ্গে দুই ধরনের বৈদ্যুতিক চার্জ জড়িত। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক। একইভাবে দুর্বল ও সবল পারমাণবিক বলেরও বৈদ্যুতিক চার্জের মতো ধর্ম রয়েছে, যাদের বলা হয় হাইপারচার্জ ও কালার। এগুলোর মানও ভিন্ন ভিন্ন। অন্যদিকে মহাকর্ষের মান সংশ্লিষ্ট বস্তুর ভরের সঙ্গে সম্পর্কিত। অবশ্য মহাকর্ষকেও অন্য বলগুলোর মতো ভাগ করা যায়। অর্থাৎ বস্তুর ভরকে মহাকর্ষের চার্জ হিসেবে কল্পনা করা যায়, যার মাধ্যমে বস্তুটি কতটুকু মহাকর্ষ অনুভব করবে, তা নির্ধারিত হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, মহাবিশ্বে শুধু এক ধরনের ভরই দেখা যায়। ঋণাত্মক বা নেগেটিভ ভর বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। কাজেই কোনো কণা বা বস্তুকে মহাকর্ষ বিকর্ষণ করে না।

বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মানে দাঁড়ায়, মহাকর্ষকে বাতিল করা যায় না। কিন্তু বৃহৎ পরিসরে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বলের ক্ষেত্রে তা ঘটতে দেখা যায়। সূর্যের বেশির ভাগ যদি ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ দিয়ে গঠিত হতো এবং পৃথিবী যদি বেশির ভাগ ঋণাত্মক চার্জ দিয়ে গঠিত হতো, তাহলে এই দুইয়ের মধ্যে যে আকর্ষণ দেখা যেত, তার পরিমাণ হতো বিপুল। তাহলে আমাদের গ্রহটাকে অনেক আগেই সূর্য গিলে ফেলত। কিন্তু পৃথিবী গঠিত হয়েছে প্রায় সমপরিমাণ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ দিয়ে। আবার সূর্যও গঠিত হয়েছে সমপরিমাণ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জে। তাই তারা বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয়ভাবে পরস্পরকে সেভাবে প্রভাবিত করে না। পৃথিবীর প্রতিটি ধনাত্মক ও ঋণাত্মক কণার উভয়েই সূর্যের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক কণা দিয়ে আকর্ষিত ও বিকর্ষিত হয়। তাই সব বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বল বাতিল হয়ে যায়।

তবে এটা হঠাৎ ঘটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বল এতই শক্তিশালী যে তা চার্জগুলোর মধ্যে ভারসাম্য না আসা পর্যন্ত সেগুলো সামনে–পেছনে টানতে থাকে। মহাবিশ্বের জন্মের শুরুর দিকে (মহাবিশ্বের বয়স তখন প্রায় চার লাখ বছর) প্রায় সব পদার্থই কার্যত চার্জনিরপেক্ষ পরমাণুতে এসে স্থির হয়েছিল। এভাবে ভারসাম্যে এসেছিল বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বল। তারপর থেকে পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে কোনো বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বল আর অবশিষ্ট নেই। আবার দুর্বল ও শক্তিশালী পারমাণবিক বল বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে পারে না। তাই চারটি বলের মধ্যে একটি বলই বাকি থাকে, আর সেটি মহাকর্ষ। এ কারণে গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথগুলোকে বৃহৎ পরিসরেও নিয়ন্ত্রণ করে মহাকর্ষ। কারণ, অন্যান্য বল ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে। আর মহাকর্ষ আকর্ষণধর্মী হওয়ার কারণে একে কখনো বাতিল করা যায় না।

সুতরাং মহাকর্ষের দুটি কৌতূহলী ও অমীমাংসিত ধর্ম দেখা যাচ্ছে। প্রথমটা হলো অন্য বলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এই বলটা খুবই দুর্বল। দ্বিতীয়ত, বলটা শুধু আকর্ষণ করে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কণার চার্জের ওপর নির্ভর করে অন্য বলগুলো আকর্ষণ, বিকর্ষণ দুটিই করে। দেখা যাচ্ছে, নানা দিক দিয়ে মহাকর্ষ বেশ অস্বাভাবিক। তাহলে প্রশ্ন আসে, মহাকর্ষ এ রকম আলাদা কেন? এর একমাত্র উত্তর, আমরা জানি না।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের মাধ্যমে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা না করতে পারার দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাকর্ষকে খাপ খাওয়াতে গেলে মহাকর্ষও কোনো কণার মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় বলে কল্পনা করে নিতে হয়।

এবার আসি বলের প্যাটার্নের কথায়। মহাকর্ষ বাদে অন্য তিনটি বলের মধ্যে একধরনের প্যাটার্ন দেখা যায়। সেই প্যাটার্নের সঙ্গে মহাকর্ষ পুরোটা নয়, সামান্য কিছুটা খাপ খায়। সেটি মাথায় রেখে মহাকর্ষকে অন্যান্য বলের মতো করে ভাবা যায়। অন্য বলগুলোর চার্জের মতো ভাবা যেতে পারে বস্তুর ভরকে। সব কণা, পদার্থ এবং অন্য তিনটি মৌলিক বলকে ব্যাখ্যা করা হয় কোয়ান্টাম মেকানিকসের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম মেকানিকসে সবকিছুকে কণা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এমনকি বলগুলোকেও কণা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় এ তত্ত্বে। যেমন একটি ইলেকট্রন আরেকটি ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেওয়ার কারণে দ্বিতীয় ইলেকট্রনটির যে চলাচল হয়, তার জন্য কোনো বল বা অদৃশ্য কোনো প্রভাব ব্যবহার করা হয় না। বরং পদার্থবিদেরা মনে করেন, এই মিথস্ক্রিয়ার কারণ একটি ইলেকট্রন আরেকটি ইলেকট্রনের দিকে একটি কণা ছুড়ে দেয়, যার মাধ্যমে তার কিছু ভরবেগ স্থানান্তরিত হয়। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে বলবাহী এই কণাকে বলা হয় ফোটন। অন্যদিকে দুর্বল বলের বলবাহী কণার নাম ডব্লিউ ও জেড বোসন। এই বলবাহী কণা বিনিময়ের মাধ্যমে দুর্বল বল কাজ করে। আর শক্তিশালী বল বিনিময় হয় গ্লুয়ন কণার মাধ্যমে।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের এই কাঠামোকে বলা হয় কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই মডেল প্রাকৃতিক জগতের অধিকাংশকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য রকম সফল। কোয়ান্টাম কণার দৃষ্টিভঙ্গিতে জগতের অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায়। এমনকি আমরা আগে দেখিনি এমন অনেক কিছুর ভবিষ্যদ্বাণীও করা যায়। যেমন এই মডেল ব্যবহার করেই হিগস বোসন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে ২০১২ সালে কণাটি শনাক্ত করাও সম্ভব হয়েছে। আবার দুর্বল বল কেন ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ করে, তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় এ মডেল থেকে। আসলে এ বলবাহী কণার ভর অনেক বেশি। সে কারণে কণাটির চলাচল সীমাবদ্ধ। এত সফলতা সত্ত্বেও স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, একই উপায়ে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন?

কোয়ান্টাম মেকানিকসের মাধ্যমে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা না করতে পারার দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাকর্ষকে খাপ খাওয়াতে গেলে মহাকর্ষও কোনো কণার মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় বলে কল্পনা করে নিতে হয়। পদার্থবিদেরা এই হাইপোথেটিক্যাল কণার একটি গালভরা নামও দিয়েছেন—‘গ্র্যাভিটন’। বাংলায় বলা যায় মহাকর্ষ কণা। এ কণার অস্তিত্ব যদি সত্যিই থাকে, তাহলে আপনি শুয়ে, বসে বা দাঁড়িয়ে যেখানেই থাকুন না কেন, আপনার দেহ থেকে অনবরত অতিক্ষুদ্র বলের মতো গ্র্যাভিটন কণা ছুটে যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠের দিকে। আবার ভূপৃষ্ঠ থেকেও একই রকম কোয়ান্টাম কণা ছুটে আসছে আপনার দিকে। এই দুই মহাকর্ষ কণা বিনিময়ের কারণে আপনি পৃথিবীর বুকে আটকে থাকতে পারছেন। আবার পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরে বেড়াতে পারছে, তার কারণও ওই গ্র্যাভিটন কণার অবিরাম স্রোত দুইয়ের মধ্যে বিনিময় হচ্ছে। এভাবে মহাকর্ষকে বেশ ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু এ ধারণার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গ্র্যাভিটনের অস্তিত্ব পুরোটাই কাল্পনিক। বাস্তবে এ রকম কোনো কণার খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। অন্য বলগুলোর সঙ্গে মহাকর্ষের এই আপাত–অসংগতির অর্থ হতে পারে, আমরা যে প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছি, সেটি সঠিক নয়, অথবা বড় কোনো কিছু আমরা এখনো বুঝতে পারছি না। কোনটা ঠিক? তা–ও অমীমাংসিত।

দ্বিতীয় কারণটি হলো, মহাকর্ষকে ব্যাখ্যার জন্য আমাদের কাছে চমৎকার ও কার্যকর একটি তত্ত্ব আছে। সাধারণ আপেক্ষিকতা। ১৯১৫ সালে তত্ত্বটি প্রণয়ন করেন আইনস্টাইন। তারপর থেকে নানাভাবে নিজের সফলতার পরিচয় দিয়েছে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এ তত্ত্বে মহাকর্ষকে দুটি বস্তুর মধ্যে কোনো বলের টান হিসেবে ভাবা হয় না, বরং ভাবা হয় স্থানের বিকৃতির ফল হিসেবে। এর মানে কী? আইনস্টাইন স্থানকে পরম না ধরে গতিশীল প্রবাহ বা নমনীয় চাদরের মতো করে কল্পনা করলেন। এভাবে মহাকর্ষকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ তত্ত্ব বলে, কোনো বস্তু বা শক্তির উপস্থিতিতে তার চারপাশের নমনীয় চাদরের মতো স্থান বেঁকে যায়। এতে বস্তুটির কাছের বস্তুগুলোর গতিপথ বদলে যায়। আইনস্টাইনের চিত্রমতে, মহাকর্ষ বল বলে কিছু নেই, আসলে পুরোটাই স্থানের বিকৃতি বা বক্রতার ফল।

নিউটন বলেছিলেন, মহাকর্ষ বলের টানে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুযায়ী, পৃথিবী সে কারণে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে না। এর আসল কারণ সূর্য তার চারপাশের স্থানকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। তাই পৃথিবীর কাছে যেটা সরলপথ, সেটি আসলে একটি বৃত্তাকার পথ (বা উপবৃত্তাকার) বলে মনে হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মহাকর্ষীয় ভর কোনো চার্জ নয়, বরং কোন বস্তু তার চারপাশের স্থানকে কতটুকু বক্র করতে পারে তার পরিমাণ। তত্ত্বটাকে যতই উদ্ভট বলে মনে হোক না কেন, এটা স্থানীয় মহাকর্ষ, মহাজাগতিক মহাকর্ষ এবং মহাবিশ্বের অনেক অদ্ভুত পরিঘটনা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। এ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, আলো কেন বস্তুর চারপাশে বেঁকে যায় এবং আপনার জিপিএস কেন কাজ করে। এমনকি কৃষ্ণগহ্বরের ভবিষ্যদ্বাণী করে তত্ত্বটি।

সমস্যা হলো সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব বেশ ভালোভাবে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তাই আমাদের ধারণা হয়েছে, এটাই সম্ভবত প্রকৃতির সঠিক ব্যাখ্যা। ঝামেলা হলো এ তত্ত্বটাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মতো অন্য কোনো মৌলিক তত্ত্বের সঙ্গে একত্র করা সম্ভব হয়নি। অথচ কোয়ান্টাম মেকানিকসও প্রকৃতির সঠিক ও নির্ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে বলে আমরা মনে করি।

সমস্যাটার কারণ কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুযায়ী, মহাবিশ্বের চিত্র একটু আলাদা। এ তত্ত্বে স্থানকে সমতল পটভূমি হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, স্থান গতিশীল ও নমনীয়, যা সময়ের সঙ্গে মিলে স্থান-কাল গঠন করে। কাজেই বস্তুর ভর বা শক্তি স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। তাহলে প্রশ্ন আসে, কোন চিত্রটা সঠিক? মহাকর্ষ কি স্থানের বক্রতা নাকি কণার মধে৵ অজানা উড়ন্ত কোয়ান্টাম বল? মহাবিশ্বের সবকিছুই আসলে কোয়ান্টাম মেকানিকসের নিয়ম মেনে চলে। তাই মহাকর্ষও যদি সেই নিয়ম মেনে চলে, তাহলে বিষয়টা আমাদের জন্য বোধগম্য হয়ে উঠত। কিন্তু গ্র্যাভিটন বা মহাকর্ষ কণা এখন পর্যন্ত কাগজে–কলমেই সীমাবদ্ধ। গ্র্যাভিটন নামের কোনো কোয়ান্টাম কণার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আরও সমস্যা আছে। কোয়ান্টাম মেকানিকস এবং আপেক্ষিকতার মিলনে নতুন যে তত্ত্ব পাওয়া যাবে, তার পোশাকি নাম কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ। কিন্তু সমস্যা হলো সেটি কেমন হবে? কেউ জানে না। পদার্থবিজ্ঞানীরা মাঝেমধ্যে তাত্ত্বিকভাবে এ ধরনের কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেন, পরে সেগুলো পরীক্ষামূলকভাবে পাওয়া যায়। সম্প্রতি লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে পাওয়া হিগস বোসন এমন একটি কণা। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস আর আপেক্ষিকতাকে একীভূত করতে পদার্থবিদেরা এখন পর্যন্ত যতবার চেষ্টা করেছেন, ততবারই ব্যর্থ হয়েছেন। এসব চেষ্টায় অসীমের মতো কিছু ফল পাওয়া গেছে, যা অর্থহীন। তবে আশার কথা হলো, তাত্ত্বিকেরাও কম যান না। তাঁরাও নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকেন। তাই একদিন হয়তো ভালো কোনো আইডিয়া তাঁদের মাথায় উঁকি দিতেও পারে, যার মাধ্যমে এই বিপরীতধর্মী তত্ত্ব দুটিকে একত্র করা যাবে। তাঁদের এসব চেষ্টার ফসলের মধ্যে রয়েছে স্ট্রিং থিওরি এবং লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি। তবে এই তত্ত্ব দুটি সঠিক কি না, তা–ও আমরা জানি না। কারণ সেগুলো পরীক্ষা করে দেখাও কঠিন। তত্ত্ব দুটি পরীক্ষামূলকভাবে সত্যি প্রমাণ করতে আমাদের অবিশ্বাস্য রকম বড় পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর দরকার। একেকটা অ্যাকসিলারেটরের আকৃতি হবে আমাদের সৌরজগতের সমান। সেটি এই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে বানানো অসম্ভব।

সংক্ষেপে বললে, মহাকর্ষ বল তার সঙ্গীদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। মহাবিশ্বের অন্যতম বড় রহস্য এটা। এই জটিল ধাঁধা সমাধানে আমরা কী করছি?

মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার একটি পন্থা হলো পরীক্ষা করে দেখা। তারপর চৌকস কোনো আইডিয়া দিয়ে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা। সে হিসেবে আমরা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিকসের মধ্যে কোনটা সঠিক এবং কোনটা অকার্যকর, তা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। যেমন আমরা যদি পরীক্ষা করে দেখতে পাই, দুটি বস্তু পরস্পরের মধ্যে গ্র্যাভিটন কণা বিনিময় করছে, তাহলে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হবে যে মহাকর্ষ হলো কোয়ান্টাম পরিঘটনা।

সেটি সম্ভব হলে অবশ্যই অনেক বড় ঘটনা হতো। কিন্তু এই পরীক্ষা করা যে কতটা জটিল, সেটি একবার ভেবে দেখুন। মনে আছে নিশ্চয়ই, মহাকর্ষ চারটির মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল বল। এমনকি ক্ষুদ্র একটি চুম্বকের বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার জন্য গোটা পৃথিবীর মহাকর্ষও যথেষ্ট নয়। ওই ক্ষুদ্র চুম্বকের বলের কাছেও পৃথিবীর মহাকর্ষ হেরে যায়। দুটি কণাকে একসঙ্গে রাখা হলে সেগুলোর মধ্যকার মহাকর্ষ বল প্রায় শূন্য হতে দেখা যায়। আর তখন সেখানে বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয়, দুর্বল ও সবল পারমাণবিক বল অনেক বেশি শক্তিশালী।

কাজেই গ্র্যাভিটন কণা দেখার জন্য আমাদের অনেক ভারী বস্তু দরকার। সেই বস্তুগুলোর হতে হবে মহাজাগতিক ভরের, যাতে অন্য বলগুলো ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। এই অতিভারী বস্তুকে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে ফেললেই গ্র্যাভিটন বা মহাকর্ষ কণা পর্যবেক্ষণ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সে জন্য হাতের কাছে যেকোনো বস্তু টনকে টন জড়ো করে, তা দিয়ে অতিভারী বস্তু তৈরি করে সংঘর্ষ ঘটালে হবে না। আমাদের দরকার দানবীয় অতিভরের কোনো কৃষ্ণগহ্বরের মতো বস্তু বা দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ।

এ রকম মহাজাগতিক অতিভারী দুটি বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়েই কেবল মহাকর্ষকে হয়তো কোয়ান্টাম পরিঘটনা হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব। কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি, এ রকম কিছু করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমাদের বাজেট বলেন আর সামর্থ্য, কোনোটাতেই কুলাবে না। তার চেয়ে হয়তো মৃত নক্ষত্রের কথা ভাবা অনেক বেশি বাজেটবান্ধব। মজার ব্যাপার হলো, এসব ক্ষেত্রে আমরা ভাগ্যবান। মহাবিশ্বে হরহামেশাই উদ্ভট সব ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। তার মধ্যে আছে কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ। মাঝেমধ্যে এ রকম ঘটনা ঘটে মহাকাশে। ভালোমতো খুঁজলে এমন কিছু হাতের নাগালে পেয়েও যেতে পারেন।

তবে এসব ঘটনা আমাদের ইচ্ছেমতো ঘটে না। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিও হয় না। অবশ্য কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটতে দেখা গেছে। দুটি কৃষ্ণগহ্বর পরস্পরের কাছাকাছি চলে এলে, তারা একে অন্যকে শুষে নিতে বা গিলে ফেলার চেষ্টা করে। ঠিক এ ঘটনাই মহাকাশে খুঁজে দেখেন বিজ্ঞানীরা। মহাকাশের বিভিন্ন জায়গায় দুটি কৃষ্ণগহ্বর পরস্পরকে কেন্দ্র করে সর্পিলভাবে ঘুরতে শুরু করে ক্রমেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। একসময় দুটির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে। ফলে হয়তো চতুর্দিকে তীব্র বেগে গ্র্যাভিটন কণা বেরিয়ে আসতে পারে। আসলে সেটি ঘটে কি না, তা আমাদের পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়। কৃষ্ণগহ্বর থেকে সত্যিই যদি কোনো গ্র্যাভিটন কণা বেরিয়ে আসে, তা–ও শনাক্ত করা খুব কঠিন। মহাকর্ষের দুর্বলতার কারণে আপনার ভেতর দিয়ে গ্র্যাভিটন কণা চলে গেলেও কিছুই টের পাবেন না। মহাবিশ্বে নিউট্রিনো নামের একটি অদ্ভুতুড়ে ও অসামাজিক কণা আছে। কয়েক আলোকবর্ষজুড়ে পুরু সিসার পাত ভেদ করেও এই কণাটি চলে যেতে পারে। কারণ, এই কণা সহজে অন্য কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না। কিন্তু গ্র্যাভিটনের তুলনায় নিউট্রিনোকে সামাজিক কণা বলা যায়। কারণ, গণনায় দেখা গেছে, বৃহস্পতি গ্রহ আকৃতির কোনো ডিটেক্টর দিয়ে গ্র্যাভিটন কণা খোঁজা হলে তীব্র গ্র্যাভিটন উৎসের কাছেও প্রতি ১০ বছরে মাত্র একটি কণা পাওয়া যেতে পারে। কাজেই গ্র্যাভিটনের কাছে নিউট্রিনো দুগ্ধপোষ্য শিশু।

প্রশ্ন হলো একটি গ্র্যাভিটন কণা যদি আলাদা করে দেখা অসম্ভব হয়, তাহলে মহাকর্ষ আসলে কোয়ান্টাম পরিঘটনা কি না, তা বোঝা সম্ভব হবে কীভাবে? সে ক্ষেত্রে আরেকটি উপায় আছে। এমন কোনো ভৌত পরিস্থিতি অনুসন্ধান করা দেখা, যেখানে দুটি তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী মিলবে না। সেটি হতে পারে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে অনুসন্ধান চালানো। অবশ্য সেটি খুব একটি বাস্তবসম্মত প্রস্তাব নয়।

আপেক্ষিক তত্ত্বমতে, কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে রয়েছে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু। এই বিন্দুতে পদার্থের ঘনত্ব এতই বেশি যে সেখানে মহাকর্ষ ক্ষেত্র অসীম। আক্ষরিক অর্থেই ব্যাপারটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। কারণ, এখানে স্থান-কাল এমনভাবে বিকৃত হয়ে যায় যে তা বোধগম্য হয় না। এ রকম পরম বিন্দুর অস্তিত্বের ব্যাপারে সাধারণ আপেক্ষিকতায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকসের বিরোধী। কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতি অনুসারে, কোনো একক বিন্দুতে (পরম বিন্দুর মতো) যেকোনো কিছুকে আলাদা করা অসম্ভব। কারণ, সেখানে সব সময় কিছু না কিছু অনিশ্চয়তা থেকে যায়। কাজেই এই পরিস্থিতিতে দুটি তত্ত্বের একটি অকার্যকর হয়ে যায়। যদি জানা যেত কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে আসলে কী ঘটে, তাহলে কোয়ান্টাম মেকানিকস এবং মহাকর্ষকে একত্রে জোট বাঁধার জন্য কিছু ক্লু হয়তো পাওয়া যেত। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, সরেজমিনে কৃষ্ণগহ্বর পরিদর্শন করা কিংবা সেখানে গিয়ে সশরীর টিকে থাকা, পরীক্ষাটা সম্পন্ন করা, তারপর ফলাফলটা ঝুলিতে ভরে কৃষ্ণগহ্বরের অতি শক্তিশালী মহাকর্ষকে পাশ কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসা এখন পর্যন্ত অসম্ভব।

তবে এসব ব্যবহার করে গ্র্যাভিটন আবিষ্কার করা না গেলেও কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ থেকে অনেক কিছুই জানা যায়। কারণ, মৃত্যুচুম্বনের জন্য পরস্পরের দিকে সর্পিল গতিতে ধেয়ে আসা কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ থেকে জন্ম হয় মহাকর্ষ তরঙ্গের। গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষ তরঙ্গ হলো ত্বরণপ্রাপ্ত ভরের কারণে সৃষ্ট স্থানের ভেতর মৃদু ঢেউ। গোসলের সময় বাথটাবে বা কোনো শান্ত পুকুরের পানিতে হাত রাখলে, চারদিকে যেমন ছোট ছোট ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, স্থানের ভেতর দিয়ে মহাকর্ষ তরঙ্গও অনেকটা সেভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অতিভারী বস্তুগুলো স্থানের ভেতর চলাচল করলেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে। এই চলমান ভর খোদ স্থানকেও বাঁকিয়ে দিতে পারে। তা এমন এক উত্তেজনা বা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে, যা তরঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

মজার ব্যাপার হলো মহাকর্ষ তরঙ্গ তার চলার পথে সামনে যা পায়, তাকেই সংকুচিত ও প্রসারিত করতে করতে এগিয়ে যায়। তাই মহাকর্ষ তরঙ্গের সামনে একটি বৃত্ত পরিণত হয় উপবৃত্তে, বর্গ পরিণত হয় আয়তক্ষেত্রে। কথাটা শুনতে মজার মনে হচ্ছে তাই না? এই বইটা পড়ার সময় কোনো মহাকর্ষ তরঙ্গ যদি আপনার দেহ ও বইটাকে ভেদ করে চলে যায়, তাহলে দুটির আকৃতিই বিকৃত হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবেন না। একেবারে ভুতুড়ে ব্যাপার! আসলে মহাকর্ষ তরঙ্গস্থানকে বিকৃত করে ১০-২০ গুণ। এর মানে হলো আপনার কাছে যদি ১০২০ মিলিমিটার লম্বা একটি লাঠি থাকে, আর তার ভেতর দিয়ে মহাকর্ষ তরঙ্গ চলে যায়, তাহলে লাঠিটা ছোট হবে মাত্র এক মিলিমিটার। এই সংকোচন এতই ছোট যে তা শনাক্ত করা বেশ কঠিন।

তবে বিজ্ঞানীরা কম যান না। তাঁরা বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমান আর ধৈর্যশীলও বটে। তাই তাঁরা মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার উপায়ও বের করেছেন। এমনই পরীক্ষা চালানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোতে। লাইগোর পূর্ণ রূপ লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি। সেখানে চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দুটি টানেল পরস্পরের সমকোণে স্থাপন করা হয়েছে। টানেলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্বের পরিবর্তন মাপার জন্য আছে একটি লেজার। মহাকর্ষ তরঙ্গ এর ভেতর দিয়ে চলে গেলে সেখানকার স্থান একদিকে প্রসারিত হয়, আবার অন্যদিকে সংকুচিত হয়। তার প্রভাব টানেলের লেজার রশ্মিতেও পড়বে। লেজার রশ্মির ব্যতিচার পরিমাপ করে পদার্থবিদেরা নিশ্চিত হন, কোনো মহাকর্ষ তরঙ্গ সেখানকার স্থানকে সংকুচিত ও প্রসারিত করেছে কি না।

যুক্তরাষ্ট্রের দুটি জায়গায় প্রায় ৬২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে এ রকম দুটি টানেল স্থাপন করা হয়। ২০১৬ সালে সেখানে প্রথমবার মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় ১০০ বছর আগে এমন তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আইনস্টাইন। তবে এখান থেকে মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে, সে ব্যাপারে কোনো কোয়ান্টাম চিত্র পাওয়া যায় না। কারণ, মহাকর্ষ তরঙ্গ আর মহাকর্ষ কণা বা গ্র্যাভিটন এক জিনিস নয়। এটা অনেকটা আলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করার মতো, আলো যে ফোটন দিয়ে তৈরি, তা প্রমাণ করা নয়। তবু একে অনেক বড় ধরনের আবিষ্কার বলতেই হবে।

তাহলে রহস্যময় মহাকর্ষের সঠিক ব্যাখ্যা কী? এই বলটা দুর্বল কেন? কেন সেটি অন্য বলগুলোর মতো নয়? এর কারণ এমনও হতে পারে, মহাকর্ষ হয়তো বিশেষ কোনো বল। মহাকর্ষকে অন্য বলের মতো হতে হবে কিংবা একটিমাত্র তত্ত্ব দিয়েই সবকিছু ব্যাখ্যা করতে হবে, এমনটা না–ও হতে পারে। বড় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আমাদের মন খোলা রাখতে হবে। কারণ, মহাবিশ্বের মৌলিক কিছু সত্য সম্পর্কে আমরা এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা এমন কিছু অনুমান করেছি, যা পরবর্তী সময়ে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিংবা নিদি৴ষ্ট বা বিশেষ কিছু শর্ত সাপেক্ষে তা সত্য। এমনও হতে পারে, আমাদের আগের জানা যেকোনো কিছুর চেয়ে মহাকর্ষ ভিন্ন কিছু। যার কথা আমরা আগে কখনো ভাবতে পারিনি। কিংবা কে জানে উল্টোটাও হয়তো সত্যি। মনে রাখতে হবে, আমাদের লক্ষ্য হলো মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে বুঝতে পারা। তাই এটা আসলে কেমন, সে সম্পর্কে অনেক বেশি অনুমান করা বাদ দিতে হবে।

কখনো যদি দেখা যায়, মহাকর্ষ বিশেষ কিছু এবং অন্যান্য মৌলিক বলের চেয়ে এটা একেবারেই আলাদা, সেটিই জোগান দিতে পারে মহাবিশ্বের বৃহৎ চিত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ক্লু। এর মানে হয়তো মহাকর্ষ গভীর কিছু, যা মহাবিশ্বের নকশার মধ্যে গেঁথে আছে। মাঝেমধ্যে আমরা নিয়ম ছাড়াও ব্যতিক্রম থেকেও অনেক বেশি শিখতে পারি। এসব রহস্য ব্যাখ্যায় আমাদের কাছে বর্তমানে আইডিয়ারও কমতি নেই।

মহাকর্ষের দুর্বলতা ব্যাখ্যার জন্য মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটি আইডিয়া হলো অতিরিক্ত মাত্রার ধারণা। এ ধারণামতে, আমরা চার মাত্রা নয়, তার চেয়ে বেশি মাত্রার বিশ্বে বাস করি। কিছু পদার্থবিদ বলেন, মহাকর্ষ অন্য মাত্রাগুলোতে চলে যাওয়ার কারণে দুর্বল হয়ে গেছে। অতিরিক্ত মাত্রাগুলোকে আমলে নিলে মহাকর্ষ আসলে অন্য বলগুলোর মতোই শক্তিশালী। কিন্তু সেটিও ঠিক নয়, বেঠিক তা প্রমাণ করার উপায়ও এখনো আমাদের জানা নেই। তাই মহাকর্ষ এখনো আমাদের কাছে বড় একটি রহস্য।

মহাকর্ষের এই রহস্য বোঝা সম্ভব হলে মহাবিশ্ব ও চারপাশের জগৎকে বোঝার ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রভাব পড়বে। মনে রাখতে হবে, মহাকর্ষ বিশাল বিপুল দূরত্বে কাজ করতে পারে। এটিই একমাত্র ও প্রধানতম বল, যা মহাবিশ্বের আকৃতি এবং তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।

মহাকর্ষ যে স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়, সেটিও কিছু চমৎকার সম্ভাবনার ইঙ্গিত করে। এই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে এই সৌরজগতের বাইরে অন্য কোনো নক্ষত্র ব্যবস্থায় যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের পাশ্ব৴বর্তী নক্ষত্রের দূরত্বও অনেক বেশি। কিন্তু মহাকর্ষের রহস্য ভেদ করা সম্ভব হলে হয়তো স্থানকে কীভাবে বাঁকাতে হয় কিংবা ওয়ার্মহোল কীভাবে তৈরি করতে হয় বা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তা বুঝে ফেলতে পারব। সেটি সম্ভব হলে মহাবিশ্বের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানোর আমাদের এত দিনের যে অদম্য ইচ্ছা, তা একদিন সত্যি হতে পারে। তখন স্থান-কালের চাদর ভাঁজ করে মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে চলে যাওয়া যাবে চোখের পলকে। সেটি সত্যে পরিণত করার মূল চাবিকাঠি হলো মহাকর্ষ। কাজেই রহস্যময় হলেও মহাকর্ষ বল শুধু আমাদের মাটিতে আটকে রাখে, সে কথা কে বলল! বড় প্রেম যেমন শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে, বিপুল পরিসরের মহাকর্ষ বলও তাই। এই বলের কাঁধে চেপে হয়তো আমরা আকাশ-বাতাস, গ্রহ-তারকা ভেদ করে একদিন দূরে, বহুদূরে চলে যেতে পারব। আর সেই সম্ভাবনা নির্ভর করছে ভবিষ্যতের কোনো বিজ্ঞানীর হাতে মহাকর্ষের রহস্য সমাধানের ওপর। কে জানে, এই লেখার পাঠকদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সেই বিজ্ঞানী।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: উই হ্যাভ নো আইডিয়া/ জর্জ চ্যাম ও ড্যানিয়েন হোয়াইটসন;

গ্র্যাভিটি/মার্কাস চোন; উইকিপিডিয়া