শনি গ্রহের অদ্ভুত রহস্য

সৌরজগতের আটটি গ্রহের মধ্যে একমাত্র শনিই মানুষের অপবাদের শিকার। এ গ্রহকে বলা হয় দুর্ভাগ্যের প্রতীক। তাই খারাপ সময় বা দুর্ভাগ্য বোঝাতে ‘শনির দশা’ আমাদের প্রবাদে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু সৌরজগতের গ্রহগুলোকে নিয়ে যদি কোনো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে শনির মাথাতেই উঠত বিজয়ীর মুকুট। কারণ তার চারপাশে জড়ানো রঙিন বলয়গুলো যেন প্রকৃতির এক অনন্য শিল্পকর্ম।

অসাধারণ সুন্দর এই বলয়গুলো শনিকে সৌরজগতের অন্য সব গ্রহ থেকে আলাদা করে এক রাজকীয় রূপ দিয়েছে। শনির বলয়গুলো দেখতে নিরেট মনে হলেও, এগুলো আসলে অসংখ্য ছোট ছোট বরফ কণা, ধুলো আর পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি। এদের আকার এক কণার সমান থেকে শুরু করে ১০ মিটার পুরু হতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বলয়গুলো সম্ভবত কোনো চাঁদ বা ধূমকেতু শনির খুব কাছে চলে আসার পর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে তৈরি হয়েছে। আলোর প্রতিফলন আর শনির মাধ্যাকর্ষণের টানে এরা গ্রহের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু শনি শুধু তার বলয়ের জন্যই বিখ্যাত নয়, এর আছে আরও অনেক মজার ও রহস্যময় কিছু ব্যাপার।

শনিগ্রহ আমাদের পৃথিবী থেকেও খালি চোখে দেখা যায়। পৃথিবী থেকে একে একটি উজ্জ্বল, সোনালি তারার মতো দেখায়। ছোট টেলিস্কোপ দিয়েও এর বলয়গুলো দেখা সম্ভব। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি সেই ১৬১০ সালে প্রথম টেলিস্কোপ দিয়ে শনিগ্রহের বলয় দেখেছিলেন।

সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ শনি। বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, শনির চাঁদ বা উপগ্রহের সংখ্যা ২৭৪টি। এদের মধ্যে টাইটান সবচেয়ে বড় এবং সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাঁদ। টাইটানই একমাত্র চাঁদ, যেখানে ঘন বায়ুমণ্ডল এবং তরল মিথেন ও ইথেনের হ্রদ ও নদী আছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, টাইটানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এখনো তেমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। এছাড়া, শনির আরও কিছু অদ্ভুত চাঁদ আছে, যেমন মিমাস। এটি দেখতে অনেকটা ডেথ স্টারের মতো!

শনিগ্রহে একটি দিন মাত্র ১০ ঘন্টা ২৯ মিনিটের! এর মানে হলো, অতি দ্রুত গতিতে নিজের অক্ষের চারপাশে ঘুরছে শনি। কিন্তু এ গ্রহে একটি বছর হতে সময় লাগে আমাদের হিসেবে ২৯.৫ বছর। তাই শনিগ্রহে যদি আপনার জন্ম হতো, তাহলে পরের জন্মদিনটা পালন করার জন্য অপেক্ষা করতে হতো পাক্কা ৩০ বছর।

আরও পড়ুন

শনিগ্রহ আমাদের পৃথিবী থেকেও খালি চোখে দেখা যায়। পৃথিবী থেকে একে একটি উজ্জ্বল, সোনালি তারার মতো দেখায়। ছোট টেলিস্কোপ দিয়েও এর বলয়গুলো দেখা সম্ভব। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি সেই ১৬১০ সালে প্রথম টেলিস্কোপ দিয়ে শনিগ্রহের বলয় দেখেছিলেন। আর গত শতকে, মানে ১৯৮০ সালে নাসার ভয়েজার মিশন প্রথমবারের মতো শনিগ্রহের কাছাকাছি গিয়ে চমৎকার সব ছবি তুলে আনে। আরও পরে ক্যাসিনি মহাকাশযান ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শনিগ্রহ এবং এর চাঁদগুলো নিয়ে গবেষণা করে অসংখ্য নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছে।

একটু আগে বলেছি, আকারের দিক থেকে সৌরজগতে বৃহস্পতির পরেই এর অবস্থান। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বৃহস্পতি শনির চেয়ে তিনগুণ ভারী হলেও আকারে মাত্র ১.২ গুণ বড়। মানে শনি যেন অনেকটা তুলতুলে একটা গ্রহ—আকারে বড়, কিন্তু ভর তেমন নয়। এর রহস্য কী?

অনেক গবেষণার পর সে রহস্যও ভেদ করা হয়েছে। আসলে শনির ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক কম। হিসেবে দেখা গেছে, পৃথিবীর চেয়ে প্রায় আট গুণ কম ঘনত্ব রয়েছে শনির। শুধু তাই নয়, অন্যান্য গ্যাসীয় গ্রহগুলোর চেয়েও এর ঘনত্ব কম। আসলে আমাদের পুরো সৌরজগতে শনিই সবচেয়ে কম ঘনত্বের গ্রহ। সে কারণে এক অদ্ভুত ব্যতিক্রমী গ্রহ এটি। শনিই একমাত্র গ্রহ যার গড় ঘনত্ব পানির চেয়েও কম।

কিন্তু শনির ঘনত্ব পানির চেয়ে কম হলেও এর মানে এই নয় যে গ্রহটা কোনো বিশাল বাথটাবে ভাসবে। কারণ শনির অনেক ভর থাকার, তার মাধ্যাকর্ষণ বল খুবই শক্তিশালী। তাই শনিকে ভাসাতে গেলে এমন একটি বাথটাব দরকার হবে, যার ভর শনির তুলনায় অনেক বেশি।

এখানে ‘গড়’ শব্দটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোনো গ্রহের ঘনত্ব সব জায়গায় একরকম থাকে না। গ্যাসীয় গ্রহগুলোর বাইরের দিকে থাকে হালকা বায়ুমণ্ডল, আর কেন্দ্রে থাকে খুবই চাপযুক্ত ও ঘন কেন্দ্র। পুরো গ্রহ জুড়ে একই ঘনত্ব পাওয়া যায় শুধু ছোট ছোট গ্রহাণুতে। সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভারী জিনিসগুলো কেন্দ্রে আর হালকা জিনিসগুলো বাইরে সাজানোর মতো যথেষ্ট বড় নয়।

এই সাজানোর প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ডিফারেনসিয়েশন। সৌরজগৎ তৈরির শুরুর দিকে এটা ঘটেছিল। পাথুরে বস্তুগুলোর গলিত অবস্থায় থাকার সময় ভারী মৌলগুলো কেন্দ্রে চলে যায় আর হালকাগুলো উপরে ভেসে ওঠে। ঠিক যেমন তেল আর ভিনেগার—জোরে নাড়লে মিশে যায়, কিন্তু ছেড়ে দিলে ভিনেগার নিচে আর তেল উপরে জমা হয়। সৌরজগৎ গঠনের সময় সবকিছু মেশানো অবস্থায় ছিল, কিন্তু পরে গলিত অবস্থায় থাকার সময় সব আলাদা হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

শনি গ্রহও এভাবে আলাদা হয়েছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এর কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবীর মতো ধাতব কোর। আর তার চারপাশে সম্ভবত পাথুরে স্তর। কিন্তু তার বাইরে থেকে শুরু হয়েছে বিশাল গ্যাসের ঘূর্ণি। এ অংশের প্রায় পুরোটাই হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম বা মহাবিশ্বের সবচেয়ে হালকা দুটো পদার্থ দিয়ে গঠিত। আসলে এত হালকা পদার্থ দিয়ে তৈরি বলেই পুরো গ্রহের গড় ঘনত্ব পানির চেয়েও কম। যদিও শনির যেকোনো অংশ তুলে নিলে পানির সমান ঘনত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

গ্রহগুলো গোলাকার, তাই তাদের ভর আর আকার জানলে ঘনত্ব বের করা খুবই সহজ। নাসার হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটারে গ্রাম হিসেবে বুধ গ্রহের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। আর শনির সবচেয়ে কম (প্রায় ০.৬৮৭ গ্রাম প্রতি ঘন সেন্টিমিটার)। পানির ঘনত্ব প্রায় ১ গ্রাম/ ঘন সেন্টিমিটার। দেখতেই পাচ্ছেন, শনির ঘনত্ব পানির চেয়েও কম।

এখন প্রশ্ন হলো, শনি যদি পানির চেয়ে কম ঘনত্বের হয়, তবে কি এটি সত্যিই একটি বিশাল বাথটাবের পানিতে ভাসবে?

তাত্ত্বিকভাবে এর উত্তর হলো, হ্যাঁ, ভাসবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। কারণ, শনির নিজস্ব ভর অনেক বেশি। আবার এর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও প্রবল। ভাবছেন, পানির ভাসার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?

গ্যাসীয় গ্রহগুলোর বাইরের দিকে থাকে হালকা বায়ুমণ্ডল, আর কেন্দ্রে থাকে খুবই চাপযুক্ত ও ঘন কেন্দ্র। পুরো গ্রহ জুড়ে একই ঘনত্ব পাওয়া যায় শুধু ছোট ছোট গ্রহাণুতে। সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভারী জিনিসগুলো কেন্দ্রে আর হালকা জিনিসগুলো বাইরে সাজানোর মতো যথেষ্ট বড় নয়।

পৃথিবীতে পানির চেয়ে হালকা জিনিসগুলো ভেসে থাকে। টেনিস বল, ডায়েট কোলার ক্যান, সার্ফবোর্ড—সবই পানির উপর ভাসে। সেটা সম্ভব হয় কারণ বস্তু আর পানির ঘনত্বের পার্থক্য একটা ভাসমান বল তৈরি করে, যা মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে শক্তিশালী। পৃথিবীর মহাসাগরে একটি সার্ফবোর্ড ভেসে থাকার কারণ হলো, সার্ফবোর্ডের তুলনায় পৃথিবীর ভর অনেক বেশি এবং পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ সার্ফবোর্ডকে খুব বেশি টানে না।

কিন্তু শনির ঘনত্ব পানির চেয়ে কম হলেও এর মানে এই নয় যে গ্রহটা কোনো বিশাল বাথটাবে ভাসবে। কারণ শনির অনেক ভর থাকার, তার মাধ্যাকর্ষণ বল খুবই শক্তিশালী। তাই শনিকে ভাসাতে গেলে এমন একটি বাথটাব দরকার হবে, যার ভর শনির তুলনায় অনেক বেশি। বাথটাবটা শনির ভরের তুলনায় এত বেশি হতে হবে যে শনির নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তাতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তাই আমাদের দরকার একটা বিশাল পানির গোলক, যার নিজস্ব প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ আছে। এর একটা বিশাল পানির গোলক তৈরি করতে গেলেই কিছু সমস্যা দেখা দেবে। পানির গোলকটা তখন নিজেই সূর্যের মতো আচরণ করবে। কারণ, পানির ঘনত্ব সূর্যের হাইড্রোজেন চেয়ে বেশি। তাই এটি নিজের মহাকর্ষীয় টানে এতই সংকুচিত হয়ে যাবে যে সেখানে পারমাণবিক ফিউশন শুরু হয়ে যাবে। সেটা একটি তারায় পরিণত হবে! তাহলে তখন সেই বিশাল বাথটাবে আর পানি থাকবে না, বরং হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের প্লাজমা হয়ে যাবে। তাতে সেখানে কিছুই ভাসবে না, বরং সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।

সূত্র:

দ্য মিল্কিওয়ে স্মেলস অব রাম অ্যান্ড রাস্পসবেরি/ ড. জিলিয়ান স্কুডার

উইকিপিডিয়া

নাসা ডট গভ.

আরও পড়ুন