মহাবিশ্ব কোটি কোটি গ্রহ দিয়ে ভর্তি। এর কিছু ঘুরছে নক্ষত্রের চারপাশে। কিছু ভেসে বেড়াচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। নক্ষত্র শনাক্ত বা পর্যবেক্ষণ করা যতটা সহজ, গ্রহ পর্যবেক্ষণ ততটা সহজ নয়। গ্রহ থেকে আলো নির্গত হয় না। গ্রহ শনাক্তের পদ্ধতি তাই বেশ জটিল। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরে ৫ হাজার ১৭৯টি গ্রহ বা এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করেছেন।
সৌরজগতে যে আটটি গ্রহ আছে সেগুলো গঠনের দিক থেকে তিন ধরনের। স্থলজ, গ্যাসীয় দাবনীয় গ্রহ অথবা বরফ দানবীয়। বিজ্ঞানীরা যেসব এক্সোপ্ল্যানেট খুঁজে পেয়েছেন, সেগুলোর মাঝে এই তিন ধরনের গ্রহ আছে। পাশাপাশি আরও একধরনের গ্রহের প্রাচুর্য্য আছে মহাবিশ্বে। বিজ্ঞানীরা যেগুলোর নাম দিয়েছেন সুপার আর্থ বা অতি-পৃথিবী।
নাম শুনে মনে হতে পারে, পৃথিবীর সাথে এধরনের গ্রহের মিল আছে। আসলে সেরকম নয়। নাসার বিবৃতি অনুসারে, পৃথিবীর থেকে ভারী কিন্তু নেপচুন বা ইউরেনাসের চেয়ে হালকা গ্রহগুলোকে সুপার-আর্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরা গ্যাস, পাথর বা এদের মিশ্রণে তৈরি হতে পারে। সাধারণ আকারে এসব গ্রহ আকারে পৃথিবীর প্রায় ১০ গুণ পর্যন্ত হয়। পৃথিবীর চেয়ে প্রায় দেড় থেকে ১০ গুণ হয় এদের ভর।
প্রথম খুঁজে পাওয়া সুপার আর্থ
সর্বপ্রথম সৌরজগতের বাইরে গ্রহ বা বহিসৌরগ্রহ আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৪ সালে। বিজ্ঞানীরা দেখেন, ২ হাজার ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে একটি পালসারকে কেন্দ্র করে ঘুরছে দুইটি গ্রহ। পালসার হচ্ছে শক্তিশালী চুম্বকীয় নিউট্রন নক্ষত্র, যা ঘূর্ণায়মান অবস্থায় বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে।
দুইটি গ্রহই পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি ভারী। এই ভর গ্যাসীয় বা বরফ দানবীয় গ্রহ হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়। বিজ্ঞানীরা সেবারই প্রথম নতুন ধরনের গ্রহের সন্ধান পান। সেটার বৈশিষ্ট্য সৌরজগতের কোন গ্রহের সঙ্গে মেলে না। তাঁরা এর নাম দেন, সুপার আর্থ।
এগুলো যেহেতু পালসারের চারপাশে ঘুরছিল, তাই এদের পুরোপুরি গ্রহ বলা যায় না। গ্রহ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, স্বাভাবিক নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরতে হবে। এরকম প্রথম পুরোপুরি সুপার আর্থ হচ্ছে, গ্লিস ৮৭৬ডি (Gliese 876d)। ২০০৫ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। গ্লিস ৫৮১ নামের একটি লাল বামন নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে গ্রহটি।
সুপার আর্থের প্রাচুর্য্য
২০০৯ সালে মহাকাশে কেপলাস স্পেস টেলিস্কোপ পাঠায় নাসা। কেপলারের মূল লক্ষ্য ছিল, এক্সোপ্ল্যানেট অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ। নক্ষত্রের সামনে দিয়ে গ্রহ পার হওয়ার সময় তার উজ্জ্বলতা কিছুটা কমে যায়। পরে আবার বাড়ে। মূলত নক্ষত্রের আলোর এই উজ্জ্বলতা বাড়া-কমার ব্যাপারটি লক্ষ্য করার মাধ্যমে গ্রহ শনাক্ত করে কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ। একে বলা হয় ট্রানজিট পদ্ধতি।
টেলিস্কোপটি ব্যবহার করে মাত্র দুই বছরে ৩০০টিরও বেশি সুপার আর্থের সন্ধান পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। কেপলার স্পেস টেলিস্কপের মাধ্যমেই জানা গেল গ্যালাক্সিতে সুপার আর্থ ধরনের গ্রহের প্রাচুর্য্য আছে। নাসার তথ্য অনুযায়ী, ১৯ অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৫৮৫টিই সুপার-আর্থ ধরনের গ্রহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের খুঁজে পাওয়া মোট গ্রহের প্রায় ৩০ শতাংশই সুপার আর্থ।
সুপার আর্থে কী বসবাসযোগ্য?
কোন গ্রহ বাস করা যাবে কিনা বা সেখানে প্রাণের বিকাশ সম্ভব কিনা, তা চট করে বলা যায় না। বিশেষ করে গ্রহের ধরন থেকে এটা বোঝার কোন সুযোগ নেই। প্রাণের ধরন, গ্রহের আবহাওয়া, তাপমাত্রা এসব নানা বিষয়ের উপর বাসযোগ্যতা নির্ভর করে।
এখন পর্যন্ত জলীয়, বরফে ঢাকা, এমনকি গলিত লাভায় আচ্ছাদিত সুপার আর্থের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া পৃথিবীর চেয়ে ৩-৪ গুণ ভরের গ্রহগুলো খুবই ঘন ও হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে সক্ষম। গ্রহেরপৃষ্ঠ ঠিক থাকলেও বায়ুমণ্ডলের কারণে সেখানে মানুষের বসবাস করার সুযোগ কম।
তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীর চেয়ে মাধ্যাকর্ষণ বেশি হওয়ায় সুপার-আর্থ গ্রহের টপোগ্রাফি বা ভূ-সংস্থান হবে বিস্ময়কর। সাগর-মহাসাগর হবে পৃথিবীর তুলনায় আরও গভীর ও বড়। ফলে তৈরি হতে পারে বিশাল দ্বীপপুঞ্জ। নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলের মাঝে থাকলে এখানে ভিন্ন ধরনের জীববৈচিত্র্য গড়ে ওঠাও তাই বিস্ময়কর নয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: নাসা, ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস