চাঁদের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করা প্রথম তিন নভোচারীর একজন তিনি। চাঁদের কক্ষপথ থেকে তুলেছেন ‘আর্থরাইজ’, অর্থাৎ চাঁদের দিগন্তে পৃথিবী উদয়ের ছবি। তিনি উইলিয়াম অ্যান্ডার্স। অ্যাপোলো ৮ মিশনের এই মার্কিন নভোচারী গত ৭ জুন এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। মৃত্যুকালে নাসার সাবেক এই নভোচারীর বয়স ছিল ৯০ বছর।
দ্য সিয়াটল টাইমস পত্রিকার সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় অ্যান্ডার্স বিমানটি একাই চালাচ্ছিলেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের উত্তরে স্যান হুয়ান আইল্যান্ড আর্চিপেলাগোর অংশ—জোন্স আইল্যান্ড উপকূলে ক্র্যাশ করেছে। কেসিপিকিউ-টিভি সূত্রে রয়টার্স জানিয়েছে, এটি ছিল তাঁর মালিকানাধীন একটি পুরাতন এয়ারফোর্স সিঙ্গেল ইঞ্জিন টি-৩৪ মেন্টর বিমান।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার চিফ বিল নেলসন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পৃথিবীদয়ের সেই ছবি পোস্ট করে তাঁর মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন, ‘কোনো নভোচারী মানবজাতিকে যেটুকু উপহার দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, ‘তিনি তাঁর সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন। মানজাতিকে গভীরতম এক উপহার (পৃথিবীর উদয়ের ছবি) দিয়েছেন তিনি।’
উইলিয়াম অ্যালিসন অ্যান্ডার্সের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৭ অক্টোবর, হংকংয়ে। পরে তাঁর পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানাপোলিসে চলে আসে। সেখানকার নেভাল অ্যাকাডেমি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন এই এয়ারফোর্স পাইলট। ১৯৬৩ সালে যোগ দেন নাসায়। ১৯৬৮ সালের ২১ ডিসেম্বর অ্যাপোলো ৮-এ চড়ে তিনি, ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যান ও জেমস লাভেল চাঁদের কক্ষপথের উদ্দেশে ছুটে যান। এর আগে অ্যাপোলো ৭ পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরে ফিরে এসেছিল। অ্যাপোলো ৮-ই প্রথম ৩ লাখ ৮৬ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে মানুষকে নিয়ে যায় চাঁদের কক্ষপথে। এ মিশনের কমান্ডার তথা প্রধান ছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যান।
অ্যাপোলো ৮ যাত্রার কথা ছিল ১৯৬৯ সালে। কিন্তু রুশ-মার্কিন মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতার কারণে মিশনটি কিছুদিন এগিয়ে আনা হয়। নভোচারীরা প্রস্তুতির জন্য খুব বেশি সময়ও পাননি। প্রায় ৪০ বছর পর স্মৃতিচারণের সময় অ্যান্ডার্স বলেছিলেন, তাঁদের ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।
তাঁরা চাঁদকে দশবার প্রদক্ষিণ করেন। মানুষ টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার নমুনা। না, তাঁদের প্রদক্ষিণ করতে দেখেনি মানুষ। তবে প্রথম কোনো মানুষের তোলা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি দেখে বিস্ময়ে হকচকিয়ে গিয়েছিল গোটা পৃথিবী।
সেই অভিযানের পর আর কোনো মহাকাশ অভিযানে অংশ নেননি অ্যান্ডার্স। তবে ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস ও স্পেস কাউন্সিলে কাজ করেছেন। ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড তাঁকে নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে নরওয়েতে মার্কিন দূতের দায়িত্বও পালন করেছেন।
মঙ্গলে গেলে চীন বা কোনো দেশকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে মার্কিনিদের বিজয় হিসেবে যাওয়া উচিত নয়। বরং গোটা মানবজাতির প্রতিনিধি হিসেবে যাওয়া উচিত নতুন গ্রহে।—উইলিয়াম অ্যান্ডার্স, নভোচারী, অ্যাপোলো ৮
শেষ জীবনে তিনি একটি ফিলানথ্রোপিক বা নৃতত্ত্ব দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা শিক্ষা ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করতেন। ১৯৫৫ সালে ভ্যালেরির সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। ছয় সন্তানের জনক এই নভোচারী বলতেন, ‘মঙ্গলে গেলে চীন বা কোনো দেশকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে মার্কিনিদের বিজয় হিসেবে যাওয়া উচিত নয়। বরং গোটা মানবজাতির প্রতিনিধি হিসেবে যাওয়া উচিত নতুন গ্রহে।’
উইলিয়াম অ্যান্ডার্সের মতো মানুষেরাই যুগ যুগ পথ দেখিয়েছে মানুষকে। দেখিয়েছে স্বপ্ন, আশা। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।