মঙ্গল গ্রহে সময় দ্রুত চলে, কিন্তু কতটা দ্রুত
সময় যে আপেক্ষিক, তা বিশ্বাস না হলে এক মিনিট হাত-পা টানটান করে উপুড় হয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করুন। মনে হবে ওটাই জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ এক মিনিট! ওটা তো গেল মনের ব্যাপার বা সাইকোলজিক্যাল সময়। কিন্তু ঘড়ির কাঁটাও যে জায়গাভেদে পাল্টে যায়, তা কি জানেন?
আইনস্টাইন কবে বলে গেছেন, মহাকর্ষ বল যেখানে যত বেশি, সময় সেখানে তত ধীরে চলে। আর যেখানে গ্রাভিটি কম, সময় সেখানে দ্রুত চলে। এত দিন আমরা জানতাম মঙ্গল গ্রহে সময় পৃথিবীর চেয়ে একটু আলাদাভাবে প্রবাহিত হয়। কিন্তু ঠিক কতটা আলাদা? এবার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজির পদার্থবিজ্ঞানীরা সেই অঙ্কটাই নিখুঁতভাবে কষে বের করেছেন।
গবেষকেরা বলছেন, পৃথিবীর তুলনায় মঙ্গলে একটি পারমাণবিক ঘড়ি প্রতিদিন গড়ে ৪৭৭ মাইক্রোসেকেন্ড দ্রুত চলে। তবে সমস্যা হলো, এই গতি সব সময় এক থাকে না। পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে মোটামুটি বৃত্তাকার পথে ঘোরে, মঙ্গলের পথটা তেমন নয়। মঙ্গলের কক্ষপথ বেশ চ্যাপ্টা ডিম্বাকার আকৃতির। তাই সূর্যের কাছে বা দূরে থাকার ওপর ভিত্তি করে এই সময়ের পার্থক্য প্রতিদিন ২২৬ মাইক্রোসেকেন্ড পর্যন্ত কম-বেশি হতে পারে।
২০২৪ সালে বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখিয়েছিলেন, চাঁদের ঘড়ি পৃথিবীর চেয়ে প্রতিদিন ৫৬ মাইক্রোসেকেন্ড দ্রুত চলে। চাঁদের হিসাবটা বের করা সহজ ছিল, কারণ চাঁদ ও পৃথিবী একে অপরের কাছাকাছি এবং এদের কক্ষপথ মোটামুটি সুশৃঙ্খল।
কিন্তু মঙ্গলের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের পড়তে হয়েছে ফোর-বডি প্রবলেমে। এখানে সূর্য, পৃথিবী, চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ বল এবং ঘূর্ণন গতিকে আমলে নিতে হয়েছে। মঙ্গলের মহাকর্ষ বল পৃথিবীর প্রায় ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীতে আপনার ওজন ১০০ কেজি হলে মঙ্গলে হবে মাত্র ৩৮ কেজি। কম গ্রাভিটির কারণেই সেখানে সময় দ্রুত চলে।
এখন আপনার মাথায় একটা প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক। মাইক্রোসেকেন্ডের হিসাব জেনে আমার লাভ কী? লাভ আপনার না হলেও যাঁরা মঙ্গলে রোভার পাঠাচ্ছেন বা ভবিষ্যতে মানুষ পাঠাবেন, তাঁদের জন্য এটা জীবন-মরণের প্রশ্ন। পৃথিবীতে আমরা যে জিপিএস ব্যবহার করি, তা কাজ করে নিখুঁত সময়ের ওপর ভিত্তি করে। ঘড়ির কাঁটায় এক মাইক্রোসেকেন্ডের হেরফের হলে ম্যাপে আপনার লোকেশন বা অবস্থান কয়েক কিলোমিটার ভুল দেখাতে পারে। আলো ১ মাইক্রোসেকেন্ডে প্রায় ৩০০ মিটার পথ অতিক্রম করে। তাই সময়ের সামান্য ভুলেও মঙ্গলের বুকে নভোযান অবতরণের স্থান কয়েক কিলোমিটার সরে যেতে পারে। তাই মঙ্গলে জিপিএস বা নেভিগেশন সিস্টেম বানাতে হলে ঘড়ির এই দ্রুত চলাকে সমন্বয় করতেই হবে।
সবচেয়ে মজার তথ্যটা হলো বয়সের হিসাব। যেহেতু মঙ্গলে সময় পৃথিবীর চেয়ে দ্রুত চলে, তাই সেখানে আপনার বয়সও বাড়বে দ্রুতগতিতে। গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, আপনি যদি টানা ৫০ বছর মঙ্গলে কাটান, তবে পৃথিবীতে থেকে যাওয়া আপনার যমজ ভাইয়ের চেয়ে আপনি পুরো ৯ সেকেন্ড বেশি বুড়ো হয়ে যাবেন! শুনতে ৯ সেকেন্ড খুব কম মনে হতে পারে। কিন্তু মহাকাশবিজ্ঞানে যেখানে সেকেন্ডের হাজার ভাগের এক ভাগ দিয়ে রকেটের ল্যান্ডিং ঠিক করা হয়, সেখানে ৯ সেকেন্ড মানে বিশাল ব্যাপার। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে দ্য অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নাল-এ।