পৃথিবী ও আকাশ
চাঁদে ভ্রমণ
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামে এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…
জাহাজ ছাড়ার জন্য তৈরি হতে বললেন ক্যাপ্টেন, কিন্তু কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার?
আমাদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল যে চাঁদে বায়ু নেই। অল্প একটু বেড়িয়ে আসার জন্য আন্তঃগ্রহ যাত্রী কেউ রকেট-জাহাজ ছাড়লে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু অনিবার্য। তার ভেতরের বায়ু বেড়ে ফাঁকা মহাশূন্যে বেরিয়ে যাবে, ফুসফুস ও ভেতরের অন্যান্য অঙ্গ যাবে ফেঁসে।
কিন্তু এমন বেপরোয়া কাজের কথা কেউ ভাবে না। বিশেষ একটি মহাশূন্য পোষাক প্রত্যেকের মাপসই করে বানানো হয়েছে; দেখতে অনেকটা ডুবুরিদের পোষাকের মতো। আসলে সামনে কাচ লাগানো হেলমেটসুদ্ধ পোষাকগুলো ডুবুরি-পোষাকের চেয়ে অনেক ভালো। ডুবুরি যখন জলের নিচে নামে, তার হেলমেটে লাগানো থাকে একটা দড়ি।
চমৎকার জিনিস আমাদের মহাশূন্য-পোষাক। এটা পরে যেখানে খুশি যাওয়া চলে, কেননা এতে শ্বাসে অক্সিজেন গ্রহণ আর নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণের জন্য নানা রাসায়নিক দ্রব্য আছে। হেলমেটের ভেতরের বাতাস সব সময় তাজা আর সহজে গ্রহণ করা যায়।
হেলমেটের সামনের দিক, অর্থাৎ মুখটা পাতলা; কিন্তু অত্যন্ত শক্ত কাচের—যে কাচ ভাঙে না। ভেতরে খুদে একটা রেডিও রিসিভার ও ট্রান্সমিটারের দৌলতে সঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ চালাতে পারি; প্রতিটা রেডিও একই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে বাঁধা। খুদে অথচ শক্তিশালী ব্যাটারি থেকে তার গিয়েছে পোষাকের বায়ু ও জ্বালানিরোধী বস্ত্র উপাদানে, তাতে উত্তাপ টিকে থাকে, প্রচণ্ড শৈত্যকেও ভয় পাওয়ার কারণ নেই। দরকার মতো তাপ নিয়ন্ত্রণ করা চলে।
চমৎকার পোষাক বটে। তবু আতঙ্কে একবার সেটার দিকে তাকালাম। কী বেঢপ দেখতে! এ পোষাকে খোলসের মধ্যে কচ্ছপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরতে হবে।
আমাদের দ্বিধা দেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর হেসে উঠলেন।
‘ভয় পাবেন না, পোষাকটার মধ্যে ঢুকে পড়ুন। হাঁটা কেন, ওটা পরে গঙাফড়িঙের মতন লাফাতে পারবেন।’
সবাই তৈরি হলো, এবার নির্গমনের পালা। সত্যি, হাঁটতে একেবারে কষ্ট হচ্ছে না। সারা শরীরে একটা ঝরঝরে ভাব, মনে হলো আমাদের পেশিগুলো আরও জোরালো হয়েছে।
দরজার কাছে এলাম। ট্রামগাড়ি, এমনকি যাত্রীবিমানের মতো মামুলি দরজা নয়। দরজাটা গোটা একটা ঘরের সামিল। কেবিন থেকে সে ঘরে ঢুকলাম, ক্যাপ্টেন সাবধানে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
হ্যাঁ, ভাবলাম, রকেট থেকে হাওয়া ঝটকায় যাতে বেরিয়ে না যায়, তাই এটা তিনি করলেন। তারপর পাম্পগুলো কাজ শুরু করল, আমাদের নির্গমনপথ থেকে মূল্যবান হাওয়া বের করে দিতে লাগল। দরজাটার নাম এয়ারলক বা বায়ুবন্ধ। এবার বাইরের দরজাটা খোলা হলো, মই বেয়ে নেমে পা দিলাম চন্দ্রপৃষ্ঠে।
ওখানে ওটা কী? আমাদের আগেই কে যেন এখানে এসেছে, চাঁদে প্রথম মানুষ আমরা নই! দূরে ঠিক আমাদের রকেটযানের মতোই আর একটা পালিশ-করা জিনিস রোদে ঝকঝক করছে।
‘ক্যাপ্টেন।’ সবাই আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘আপনি না বলেছিলেন...’
হাত তুলে ক্যাপ্টেন থামালেন আমাদের। যেখানে আমরা অবতরণ করেছি, ঠিক সেখানেই চাঁদে আরেকটা রকেটের উপস্থিতি ক্যাপ্টেন কী করে বোঝাবেন, দেখা যাক।
‘উত্তেজিত হবেন না,’ বললেন তিনি। হেলমেটে স্পষ্ট শোনা গেল তাঁর গলা। ‘সব ঠিক আছে। এটা একটা সোভিয়েত রকেট, এখানে রয়েছে মাস ছয়েক।’
‘এত দিন? তবে লোকজন কোথায়?’
হেসে উঠলেন ক্যাপ্টেন।
‘লোকজন নেই। যে রেডিও-সঙ্কেত মেনে আমরা এসেছি, ঠিক সে-রকম সঙ্কেত অনুসারে মহাশূন্য হয়ে পৃথিবী থেকে চাঁদে এসেছে স্বয়ংক্রিয় রকেটটা। এটা পাঠানো হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে, পথে ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মতো আপনা থেকে বেগ বাড়িয়েছে বা কমিয়েছে। ক্যাপ্টেন ছিলেন পৃথিবীতে, বিশেষ পাইলটের একটা কেবিনে। কেবিনটা ঠিক আমাদের রকেটের কেবিনের মতো।’
‘আর তিনি কে?’
‘আমিই। সত্যি বলছি আপনাদের, স্বয়ংচালিত রকেট নামার বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলাম। পরীক্ষাটা খুব কড়া: অবতরণের সময়ে ভেঙে চৌচির হলে আমাদের অভিযান অনেক বছর পিছিয়ে যেত। চলত আরও গণনা, পরীক্ষা আর পরীক্ষামূলক ওড়া। মারা যাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকলে আমাদের সরকার চাঁদে লোক পাঠাতেন না। কিন্তু সব ঠিকমতো চলল, নামল রকেটটা—‘চন্দ্রগত হলো’ বলা চলে না কিম্বা হয়তো বলা চলে, কী মনে করেন? ‘চন্দ্রগত হলো’ নিরাপদে, আর ঠিক এক সেকেন্ড পরেই রকেটের সেল্ফ-রেকর্ডিং যন্ত্র থেকে এল সঙ্কেত।’
‘কী মজার। আরও বলুন ক্যাপ্টেন, বাধা দিয়েছি বলে লজ্জিত।’
ওখানে ওটা কী? আমাদের আগেই কে যেন এখানে এসেছে, চাঁদে প্রথম মানুষ আমরা নই! দূরে ঠিক আমাদের রকেটযানের মতোই আর একটা পালিশ-করা জিনিস রোদে ঝকঝক করছে।
‘আন্তঃগ্রহ ভ্রমণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে হাতে দিলেন ডিপ্লোমা, মহাশূন্য-পোতের পাইলটের সার্টিফিকেট সেটা। আর তাই আমরা সবাই এখানে হাজির হয়েছি। যাক গে, শুনুন। আমার রেডিও নির্দেশ মেনে স্বয়ংচালিত রকেটটা, অটোরকেটটা, খুদে একটা ট্যাঙ্ক ছাড়ল। কয়েক শ ঘণ্টা চালানোর মতো জ্বালানি তাতে ছিল। ওটা আমার রেডিও নির্দেশে চলে চাঁদের এ অংশটাকে চক্কর মারল, তারপর তার টেলিভিশন-ট্রান্সমিটার থেকে ঝড়-মহাসাগরের একটা নিখুঁত ছবি পেলাম। দেখা গেল, অবতরণের পক্ষে জায়গাটা খাসা। ইচ্ছে করেই অটোরকেটের কাছে নেমেছি, ওর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে জ্বালানি, খাবার আর জল আছে; আমাদের যাত্রীবাহী জাহাজটায় এতখানি মাল নেওয়া যেত না। সবচেয়ে বড় কথা হলো ট্যাঙ্কটা বেশ ভালো অবস্থায় আছে, চাঁদের উপরিভাগে অনুসন্ধান চালানো যাবে ওটা দিয়ে।’
‘হুররে!’ একসঙ্গে আমরা সবাই হাঁক ছাড়লাম। ‘আমাদের চন্দ্র সঙ্গীকে দেখা যাক, অনেক কাজ দিয়েছে জিনিসটা।’
‘আর ভবিষ্যতেও অনেক কাজ দেবে,’ যোগ করলেন ক্যাপ্টেন।
রওনা হলাম বটে, কিন্তু হঠাৎ থামতে হলো। কী মুশকিল। বড় একটা ফাটল বা খাদ সামনে, যাওয়ার উপায় নেই। প্রায় ত্রিশ মিটার গভীর, চওড়ায় সাত মিটার, যতদূর চোখ যায় ডানে আর বাঁয়ে তার বিস্তার। এটাকে পেরিয়ে বা ঘুরে যাওয়ার সাধ্য নেই আমাদের। কিংকর্তব্য? ব্রিজ একটা বানাতে হবে না কি? কী দিয়ে বানাব?
কিন্তু ব্যাপার দেখো তো! গভীর খাদটার দিকে বৃদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী চটপট দৌড়েছেন, যেন লাফিয়ে পার হওয়ার মতলব।
‘মারা পড়বেন, মারা পড়বেন আপনি!’ চেঁচিয়ে তাঁর দিকে হাত নাড়তে লাগলাম আমরা।
কিন্তু প্রফেসর একটা লাফ মারলেন, অনায়াসে খাদটা পার হয়ে খাড়া পাড়ের প্রায় পাঁচ মিটার দূরে নামলেন।
তারপর আমাদের দিকে ঘুরে চেঁচালেন: ‘আমার দেখাদেখি লাফ মারুন।’
ভড়কে গেলাম বটে, তবে লাফ মেরে খাদটা পার হলাম পাখির মতো। একটি খেলুড়ে লোক এমন লাফ দিলেন যে প্রথম খাদটা ছাড়িয়ে প্রায় আট মিটার দূরে আরেকটা খাদে গিয়ে পড়লেন। কপাল ভালো, এ খাদটা তত গভীর নয়। কোনো চোট লাগল না তাঁর। কিছুক্ষণ পরেই হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলেন, নিজের অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে তাঁর কী হাসি!
আমরা সবাই প্রফেসরের দিকে চাইলাম।
‘ব্যাপারটা কী বলুন তো? এতখানি লাফিয়ে এলাম কী করে?’
‘পৃথিবীর চেয়ে চাঁদ অনেকখানি ছোট, মহাকর্ষও কম,’ প্রফেসর বললেন। ‘পৃথিবীর তুলনায় এখানকার মহাকর্ষ শক্তি ৬ ভাগ কম, তার মানে সবকিছুর ওজন ৬ ভাগ কম। পৃথিবীতে আমার ওজন ষাট কিলোগ্রাম, এখানে মাত্র দশ। কিন্তু মাংসপেশিগুলো আছে ঠিক আগের মতো। তাই পৃথিবীতে যতখানি, তার ৬ গুণ বেশি লাফাতে পারি এখানে। তার ওপর, এখানে হাওয়া নেই, তাই বস্তুর গতিতে বাধা পড়ে না।’
ব্যাপার স্যাপার যা, তাতে সবাই বেজায় খুশি। মালুম হলো, একেবারে কিছু না করেই আমাদের শক্তি ৬ গুণ বেড়ে গেছে।
চাঁদের মাটিতে খোশমেজাজে আর রোয়াবে পা দিয়ে কৌতূহলী চোখে চারদিকে তাকালাম। শুধু ধুধু বিরস সমভূমি, ধূলোয় ভরা। ধূলো ওড়ে, তারপর নেমে আস্তে আস্তে বসে যায়। ধূলোর মেঘ সৃষ্টি করার হাওয়া নেই। সূর্যালোকে কালো-বাদামি মাটি এত চকচকে যে তাকালে কষ্ট হয়।
আকাশের পানে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের চেনা সূর্যদেবকে। পৃথিবী থেকে দেখতে যেমন, হুবহু তাই। কেন, তা বোঝা কঠিন নয়: সূর্য থেকে দূরত্বের তুলনায় পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব অত্যন্ত কম। এক হাজার মিটার এবং ১৯৮ মিটার দূর থেকে একটা টেলিগ্রাফের খুঁটি দুজনের কাছে সমান আকারের মনে হবে।
আকাশের চেহারাটা কিন্তু বেশ আলাদা। আসার আগেই জানতাম যে চাঁদের আকাশ কালো, কিন্তু এখন দেখছি অনেক তারা, যেগুলো সূর্যালোকে অস্পষ্ট হয়ে যায়নি।
সবচেয়ে ছোট তারাগুলো পর্যন্ত দৃশ্যমান, এমন কি সূর্যগোলকের কাছের তারাগুলোও। পৃথিবীতে বায়ুকণা সূর্যের আলোয় দীপ্ত হয়ে তারাদের আলো ঝাপসা করে দেয় বলে দিনের বেলায় আমরা তাদের দেখি না। কিন্তু চাঁদে বাধ্য দেওয়ার মতো কিছুই নেই, তাই সবচেয়ে অপ্রখর তারার রশ্মিও চোখে পড়ে।
দিগন্তে বেশ নিচুতে উজ্জল বড় কাস্তেটা কী? পৃথিবী থেকে দেখা চাঁদের কাস্তের মতো চেহারা, কয়েক গুণ বড়, এই যা।
কোনো একটা গ্রহ না কি?
গ্রহই বটে। ওটা হলো আমাদের আপন পৃথিবী, যে পৃথিবী ছেড়ে এসেছি। কপালগুণে ছেড়ে এসেছি অল্প সময়ের জন্য। চাঁদ থেকে দেখছি পৃথিবীকে, নিজের উপরিভাগে প্রতিফলিত সূর্যরশ্মি পৃথিবী পাঠাচ্ছে আমাদের দিকে। নিজের চোখে দেখলাম, পৃথিবী হলো একটি জ্যোতিষ্ক; চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং অন্যান্য গ্রহদের মতোই একটি জ্যোতিষ্ক।
পৃথিবীর কাস্তেকে প্রাণভরে তারিফ করা হয়েছে। এবার অটোরকেটকে দেখতে হবে।
পায়ের ওপর বেশ স্থিরভাবে অটোরকেট দাঁড়িয়ে। এক পায়ের একটা বোতাম টিপলেন ক্যাপ্টেন। অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয়ের একটা হালকা সিঁড়ি সড়সড় করে নেমে এল, ক্যাপ্টেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে চাবি দিয়ে দরজা খুললেন। পিছু পিছু আমরা ঢুকলাম রকেটে, মনে অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে।
চাঁদ একটা দিক সর্বদা পৃথিবীর দিকে রাখে, সেটাকে আমরা বলি চাঁদের মুখ। কিন্তু চাঁদ শুধু পৃথিবীকে মুখটা সর্বদা দেখায় কেন? কারণ, দীর্ঘ কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সময় নিজের মেরুদণ্ডে মাত্র একটা পাক খায় চাঁদ
ভেতরে নতুন কিছু চোখে পড়ল না। শুধু যেখানে যাত্রীরা বসে সেখানে জ্বালানি, খাবার আর জল রাখা হয়েছে। পাইলটের কেবিন আমাদের রকেটে যেমন। সবকটা যন্ত্রপাতিতে বিশেষ রিলে আছে, যেগুলো পৃথিবী থেকে পাঠানো রেডিও-সঙ্কেত ধরে বাড়িয়ে চালান করে রকেটের যন্ত্রে।
এবার বাড়ি গেলে হয়। ক্যাপ্টেন বললেন। ‘রাতের খাওয়া সেরে শোওয়া যাবে।’
‘শোওয়া, মানে? সূর্য তো এখনো বেশ উঁচুতে!’
প্রফেসর কথাটা শুনে হেসে উঠলেন।
‘সূর্যাস্তের জন্য সবুর করে থাকলে ঘুমোনো চলবে না অনেকক্ষণ। চান্দ্র-দিনের মেয়াদ পৃথিবীর হিসেবে ৩৫০ ঘণ্টা। সূর্য দিগন্তের দিকে চলেছে বটে, তবু অস্ত যেতে যেতে কয়েকটি পার্থিব দিন কেটে যাবে।’
চাঁদের দিন এত দীর্ঘ কেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, রকেটে ফেরা না পর্যন্ত বলবেন না।
বিরাট রকেটযানের কাছে এলাম, বাইরের দরজা খুলে ক্যাপ্টেন আমাদের ঢোকালেন, ঢোকার সময়ে একে একে আমাদের গুণলেন, সবাই ফিরেছে কি না জানার জন্য। তারপর বাইরের দরজা বন্ধ করে লকে বাতাস আনার জন্য পাম্প চালালেন। তখনি শুধু জাহাজের ভেতর-দরজা খুলে দিলেন। মহাশূন্য-পোষাক খুলে মনে হলো আড়মোড়া ভাঙাটা কী মধুর ব্যাপার, এ পোষাকে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছি অস্বচ্ছন্দ গতিতে।
রাতের খাবার খেয়ে আরামি কোল্যাসিক্স বাঙ্কে শুয়েছি, প্রফেসর চাঁদের বৃত্তান্ত শোনালেন।
‘চাঁদ একটা দিক সর্বদা পৃথিবীর দিকে রাখে, সেটাকে আমরা বলি চাঁদের মুখ। কিন্তু চাঁদ শুধু পৃথিবীকে মুখটা সর্বদা দেখায় কেন? কারণ, দীর্ঘ কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সময় নিজের মেরুদণ্ডে মাত্র একটা পাক খায় চাঁদ। ব্যাপারটা যদি স্পষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে সহজ একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারো। দুই রঙের একটা বল নাও—এক দিক লাল, অন্য দিকটা নীল। টেবিলের ওপরের দোয়াতদানটা ধরো আমাদের পৃথিবী। এবার দোয়াতদানের চারদিকে বলটা এমন ভাবে ঘোরাও যাতে লাল গোলার্ধটা সব সময় তার দিকে থাকে। দেখবে যে দোয়াতদানের চারদিকে ঘোরাবার সময় হাতে বলটা নিজের মেরুদণ্ডে পুরো একটা পাক খাবে। অন্য জিনিস দিয়েও পরীক্ষা করতে পারো। যেমন দোয়াতদানের চারদিকে একটা ঘড়ি এমন ভাবে চালাও, যাতে ছয়ের সংখ্যাটা সব সময়ে দোয়াতদানের দিকে থাকে। যে সময়টাকে আমরা পৃথিবীর মানুষেরা বলি চান্দ্র মাস, সেটা চাঁদের মানুষ বলবে চান্দ্র দিন, অবশ্য চাঁদের মানুষ যদি থাকে। চাঁদের রাত্রি আর দিনের দৈর্ঘ্য সাড়ে উনত্রিশ পৃথিবী-দিনের সমান, আলো-আঁধারে, রাত্রি-দিনে সেটা সমান ভাবে বিভক্ত।’
‘তাহলে এখানকার রাত মানে ৩৫৪ ঘণ্টা?’
‘ঠিক তাই। নিজেরাই দেখবে।’
পাটিগণিতের সহজ একটা গুণফলে অবিলম্বে আমরা বুঝলাম যে গোটা একটি পৃথিবী-বর্ষে আছে প্রায় ১৩টা চান্দ্র দিন মাত্র। চাঁদে লোক থাকলে তারা গোটা বছরে দেখত তেরোটা সূর্যোদয় আর তেরোটা সূর্যাস্ত মাত্র।
আজকে যা সব দেখেছি, তা নিয়ে তোলাপাড়া করতে করতে অনেকক্ষণ ঘুম এল না চোখে।