প্রকৃত ভরের খোঁজে

বস্তু কেন চলতে চলতে থেমে যায়?

কেন স্থির বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করলে চলতে শুরু করে?

প্রশ্নগুলো বেয়াড়া, তবে কিনা বেয়াড়া টাইপের প্রশ্ন থেকেই থলের বিড়ালের মতো যুগে যুগে বেরিয়ে এসেছে প্রকৃতির বিখ্যাত সব নিয়ম। নিউটনের আপেল পড়ার কথাই ধরুন। আপেল কেন মাটিতে পড়ে, এমন এক উদ্ভট প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে এসেছিল মহাকর্ষ নামের মহামূল্যবান পদার্থবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। মহাকর্ষনীতি, গতির সূত্র গড়ে উঠেছে নিউটনের হাতে। ভর, গতিবেগ, বল আর সময়কে মিলিয়ে তিনটি বিখ্যাত সূত্র দিয়েছিলেন নিউটন; কিন্তু ভরের সঙ্গে শক্তির যে সম্পর্ক কিংবা ভর যে ভেক বদল করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তা জানা ছিল না নিউটনের। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই আইনস্টাইন নামের আরেক মহাবিজ্ঞানীর হাতে পূর্ণতা পেয়েছিল ভরশক্তির মহামূল্যবান সমীকরণটি। এরও কয়েক শতাব্দী আগে গ্যালিলিও গ্যালিলি পড়ন্ত বস্তুর সূত্র দিয়ে ভর আর বেগের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু সে মানুষের চিরায়ত মুখের ভাষায়। তবে গণিত নামের সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ও সর্বজনীন ভাষায় প্রকৃতির রহস্যগুলোকে ছন্দোবদ্ধ করার প্রয়াস নিউটনই দেখেছিলেন প্রথম। কিন্তু যে প্রশ্নগুলো দিয়ে গোড়াপত্তন হয়েছিল এই লেখার, সে প্রশ্নের জবাব গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল যুক্তিতর্কের মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই।

অ্যারিস্টটলের প্রতিমূর্তি

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, স্থিরতাই বস্তুর স্বাভাবিক ধর্ম, শুধু বল প্রয়োগ করেই বস্তুকে গতিশীল করা সম্ভব। কোনো কোনো বস্তুতে যতক্ষণ পর্যন্ত বল প্রয়োগ অব্যাহত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা গতিশীল থাকবে। বল প্রয়োগ বন্ধ হলে থেমে যাবে গতিশীল বস্তু। এ যুগের হাইস্কুলপড়ুয়া একটা ছেলেও জানে এটা ঠিক নয়। কারণ, তারা নিউটনের গতিবিদ্যা পড়ে। নিউটন বলেছিলেন, বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু চিরকাল যেমনি স্থির থাকবে, তেমনি গতিশীল বস্তু বাধা না পেলে একই গতিতে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে। অ্যারিস্টটল আর নিউটনের গতিবিষয়ক তত্ত্বে আকাশ-পাতাল ফারাক। কারণ, নিউটনের হাতে ছিল গণিতের ভাষা আর পরীক্ষামূলক প্রমাণ। অ্যারিস্টটলের কালে যুক্তিতর্ক আর কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে যেটাকে ঠিক মনে করা হতো, সেটাই হয়ে উঠত অমর বাণী। সেই অমোঘ বাণী ঠিক না বেঠিক, সেটাকে পরীক্ষা করে যাচাই করার ভাবনা সেকালে কারও মাথায় আসেনি। অ্যারিস্টটলের জানা ছিল না মহাকর্ষ বল কী? মহাকর্ষ বলশূন্য কোনো স্থানের কল্পনা করাও তাঁর পক্ষে যেমন সম্ভব ছিল না, সম্ভব ছিল না মহাকর্ষীয় টানে বস্তু থেমে যাওয়া ব্যাপারটা অনুধাবন করাও। অ্যারিস্টটলের জানা ছিল না মৌলিক পদার্থ আর এদের অণু-পরমাণুর কথা। সব মিলিয়ে ভর এবং ভারত্ব নিয়ে পরিষ্কার কোনো চিত্র ছিল না অ্যারিস্টটলের মনে। তিনি মনে করতেন, মাটি, আগুন, পানি আর বাতাস দিয়েই মহাবিশ্বের তাবৎ বস্তু তৈরি। সুতরাং দাঁড়িপাল্লা ছাড়া আর কোনো উপায়ে বস্তুর ভর মাপার পদ্ধতি সেকালের দার্শনিকদের জানা ছিল না। দাঁড়িপাল্লা দিয়ে আমরা যে ভর মাপি, সেটা তো আসল ভর নয়; কিন্তু বস্তুর সত্যিকারের ভরের হদিস পেতে বহুদিন লেগেছে।

ভারী আর হালকা বস্তু নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল অ্যারিস্টটলীয় দর্শনে। মনে করা হতো, যেসব বস্তু স্বর্গীয়, সেগুলো উড়ে ওপর দিকে উঠে যায়, তার শেষ গন্তব্য হয় স্বর্গে। যেমন ধোঁয়া-বাষ্প এগুলোকে স্বর্গীয় বস্তু বলে মনে করতেন অ্যারিস্টটল। আর যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয়, তাদের পক্ষে সম্ভব নয় ওপরে উঠে স্বর্গের পথে চলে যাওয়া। ভারী বস্তু স্বর্গীয় না, তাই এদেরকে ওপর দিকে ছুড়ে মারলে আবার মাটিতে ফিরে আসে। যে বস্তু যত বেশি ভারী অ্যারিস্টটল বলেন, পৃথিবীর সঙ্গে সে বস্তুর সম্পর্ক তত বেশি ঘনিষ্ঠ; ঠিক ততটাই বেশি দূরত্ব স্বর্গের সঙ্গে। এ কারণেই বস্তু যত ভারী, তাকে ওপর থেকে ছেড়ে দিলে তত দ্রুত নিচে নেমে আসবে।

কিন্তু খটকা লেগেছিল পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও গ্যালিলির মনে। একটা ঝাড়বাতির দোলন তাঁকে ভাবিয়েছিল, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মাটিতে পড়ার জন্য ভারী এবং হালকা বস্তু দুই ধরনের বস্তুকেই সমান কসরত করতে হয়। তাই সমান বেগে তারা মাটিতে নামে। অনেকেই মনে করেন, গ্যালিলিও ইতালির পিসা নগরীতে যে হেলানো মিনারটা আছে, তার ওপরে উঠেছিলেন একটা ভারী আর একটা হালকা বস্তু নিয়ে। তারপর সেটা একই উচ্চতা থেকে একই সময়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন মাটির গন্তব্যের দিকে। গ্যালিলিও অবাক হয়ে দেখেছিলেন, দুটো বস্তুই একই বেগে নামছে এবং একই মুহূর্তে মাটি স্পর্শ করছে। পিসার হেলানো মিনারে উঠে তিনি পরীক্ষা করুন আর না–ই করুন, এমন একটা পরীক্ষা যে তিনি করেছিলেন, সেটা নিশ্চিত। তবে এই পরীক্ষার একটা শর্ত থাকবে। আমরা বায়ুর সমুদ্রে বাস করছি। যেকোনো পড়ন্ত বস্তুর ওপরে বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী চাপ কার্যকর থাকে। বস্তু যত ভারী, বায়ুর চাপ তার ওপর তত কম; বস্তু যত হালকা, তার ওপর তত বেশি ঊর্ধ্বমুখী চাপ প্রয়োগ করতে পারে বায়ুমণ্ডল। তাই গ্যালিলিওর এই পরীক্ষা করতে হলে বায়ুশূন্য স্থানের দরকার ছিল। পিসার হেলানো মিনারকে বায়ুশূন্য স্থানে নেওয়া অসম্ভব। তবে গ্যালিলিও যেভাবেই করুন তাঁর পরীক্ষাটি, যোগ্য উত্তরসূরি আইজ্যাক নিউটন একটা কাচের পাত্রকে বায়ুশূন্য করে তার ভেতর একটা সোনার কয়েন আরেকটি পালক দিয়ে গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্রগুলো আবার যাচাই করে দেখেছিলেন। নিশ্চিত হয়েছিলেন, অ্যারিস্টটল নন, গ্যালিলিও ঠিক কথা বলেছেন। তারপর সেই সূত্রগুলো গণিতের ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন নিউটন। পরে এর থেকেই জন্ম লাভ করে মহাকর্ষসূত্র আর গতিসূত্র।

হ্যাঁ, একটা সময় মনে করা হতো, মহাকর্ষীয় ভর আর বস্তুর আসল ভর এক। আদৌ তা নয়। মহাকর্ষীয় ভর বলে আমরা যেটাকে জানি, যার কারণে আমাদের ভারী আর হালকার অনুভূতি হয়, সেটা আসলে ওজন। মহাকর্ষ বলের প্রাবল্য যেখানে কম, সেখানে আপনার ওজন অনেক কম হবে, নিজেকে তত হালকা মনে করবেন আপনি। আর মহাকর্ষ প্রাবল্য খুব বেশি যেখানে, সেখান থেকে পা তুলতেই আপনি হিমশিম খাবেন। যেটাকে আমরা আসল ভর বা প্রকৃত ভর বলছি, সেটা সব সময়, সব স্থানে, সব ধরনের মহাকর্ষীয় প্রাবল্যে সমান। মহাকর্ষ বল তার ওপর দাদাগিরি করতে পারে না।

আইজ্যাক নিউটন

কিন্তু কী এই প্রকৃত ভর, কীভাবেই–বা এর পরিমাপ হলো? বস্তুর ভেতরে মোট যে পদার্থের পরিমাণ, সেটাই তার প্রকৃত ভর; কিন্তু একটু পরিষ্কার চিন্তা করলেই দেখা যাবে, এ ধারণা মার খেয়ে যাচ্ছে। বস্তুর ভেতর পদার্থ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, সেটা কী তার উপাদান? সেটা কি পরমাণু? পরমাণুকে একসময় মৌলিক কণিকা মনে করা হতো। কিন্তু পরে দেখা গেল, সব মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর যেটাকে আমরা দাঁড়িপাল্লায় মাপা ভর বলছি, সেটা সমান নয়। কারণ, পরমাণু নিজেই পদার্থের মৌলিক উপাদান নয়। এগুলো তৈরি ইলেকট্রন আর প্রোটন দিয়ে। অন্য দিকে প্রোটন নিউট্রন তৈরি হয় কোয়ার্ক দিয়ে। অর্থাৎ, ইলেকট্রন আর কোয়ার্কই হলো বস্তুর মৌলিক উপাদান। সব মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা এক নয়, প্রতিটির আলাদা। তাই এক মৌলের পরমাণুর সঙ্গে আরেক মৌলের পরমাণুর ভরের পার্থক্য দেখা দেবে, সেটা নিশ্চিত। আবার পরমাণুকে ভেঙেও যদি আপনি খণ্ড খণ্ড করেন, অর্থাৎ কোয়ার্ক আর ইলেকট্রনকে ভাগ করেন, দেখবেন তাদের ভরও এক নয়। ইলেকট্রন আর কোয়ার্কের ভরের পার্থক্য অনেক। তাই বস্তুর মোট পদার্থের পরিবর্তন দিয়েও ঠিকভাবে নাগাল পাওয়া যায় না প্রকৃত ভরের। সবই আমরা তুল্য ভর হিসেবে পাই।

তুল্য ভরটা আবার কী?

দাঁড়িপাল্লায় মাপার ভরই তুল্য ভর। দাঁড়িপাল্লার একদিকে একটা বস্তু রাখা হয়, সেটা ভর মাপার জন্য। অন্য পাল্লায় তখন রাখা হয় একটা তুল্য বস্তু। ধরুন, আপনার দাঁড়িপাল্লার একদিকে এক প্যাকেট চাল আছে। জানেন না সে প্যাকেটের ভর কত। আপনি সেটা জানতে চান। ধরা যাক, আপনার কাছে অনেকগুলো ১ কেজি ওজনের বাটখারা আছে। আপনি প্রথমে একটা বাটখারা দিয়ে দেখলেন। দাঁড়িপাল্লার দুটো পাল্লা সমান হলো না । এরপর আপনি একটি একটি করে বাটখারা বাড়াতে লাগলেন। ঠিক ১০টি বাটখারা চাপানোর পর দেখলেন, পাল্লা দুটি সমান হয়েছে। তার মানে, আপনি চালের প্যাকেটের ভর পেয়ে গেলেন ১০ কেজি। এটাই সেই তুল্য ভর বা আপেক্ষিক ভর। ভর বেশি হলে বস্তুকে ঠেলতে বেশি বল প্রয়োজন হবে, কম হলে বল লাগবে কম। এটা নিউটনের ভরবেগের সূত্রের সারকথা; কিন্তু নিউটন বলতে পারেননি ভরটা আসলে কী।

১৯০৫ সাল। আলবার্ট আইনস্টাইনের একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয় অ্যানালেন ডার ফিজিক–এ। শিরোনাম ‘জড়তা কি বস্তুর শক্তির ওপর নির্ভরশীল?’ কোটি টাকার প্রশ্ন? নিউটন যেটাকে ভরবেগ বলছেন, অ্যারিস্টটল যেটাকে জড়তা বলছেন, আইনস্টাইন সেটাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইনার্শিয়া (inertia) নামের একটা শব্দ ব্যবহার করে। প্রবন্ধে কিছুটা এগিয়ে গিয়েই আইনস্টাইন ইনার্শিয়াকে একটানে বস্তুর ম্যাস (Mass) বা ভর হিসেবে দেখান। প্রতিষ্ঠিত হয় সেই বিখ্যাত সমীকরণ।

আলবার্ট আইনস্টাইন

একই বছর আইনস্টাইন আরও চারটি পেপার প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল বিখ্যাত বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। অবশ্য পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণটি বিশেষ আপেক্ষিকতা নামের বৃক্ষ থেকে শাখা হিসেবে বেরিয়ে এসেছে। বস্তুর আপেক্ষিক ভরের কথা সবাই জানে তখন, কিন্তু প্রকৃত ভরটা বের করা যায়নি তখনো। কারণ, পরম কোনো রাশি পাওয়া যাচ্ছিল না, যেটা সব প্রসঙ্গকাঠামোর সাপেক্ষে একই মান দেয়; কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গের হিসাব থেকে বেরিয়ে আসে আলোর বেগ পরম রাশি। তারপর মাইকেলসন-মর্লির সেই বিখ্যাত ব্যতিচার পরীক্ষা থেকে প্রমাণ হয়, আলোর বেগ সব জায়গায় এক। গ্যালিলিও থেকে নিউটন—সবাই মনে করতেন, পৃথিবীর অন্য সব বস্তুর গতির মতো আলোর বেগ আপেক্ষিক। অর্থাৎ, একজন গতিশীল পর্যবেক্ষক যদি আলোকে মুখোমুখি আসতে দেখেন, তাহলে আলোর বেগ অনেক বেশি মনে হবে। আর আলোকে যদি তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখেন, তাহলে তাঁর কাছে মনে হবে আলোর বেগ অনেকটাই কম। কিন্তু মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষার পর এ বিষয়ে পরপর অনেকগুলো পরীক্ষা করা হয়। শেষমেশ প্রমাণিত হয়, আলোর বেগ অসীম নয় যেমন, তেমনি আপেক্ষিকও নয়। আলোর কণা বা তরঙ্গ ছুটে সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার বেগে। যেখান থেকেই দেখুন, যেখান থেকেই মাপুন, এর নড়চড় হবে না কখনো। সুতরাং পদার্থবিজ্ঞান তখন ইতিহাস তছনছ করে দেওয়া এক তত্ত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। অনেকেই কোমর বেঁধে লেগেছিলেন আপেক্ষিকতার রহস্য সন্ধানে, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে বার্নের পেটেন্ট অফিসের কর্মচারীটি সবাইকে টেক্কা দিয়ে নাড়িয়ে দিলেন পদার্থবিজ্ঞানের চিরচেনা জগৎটাকে। দেখালেন আলোর বেগ পরম হলে নতুন করে লিখতে হবে নিউটনের গতিবিদ্যার সূত্রগুলো। কোনো বস্তু যদি গতিশীল হয়, তার দৈর্ঘ্য কমে যায়, বেড়ে যায় তার ভর এবং ধীর হয়ে যায় তার ঘড়ি। এমন আজগুবি কথা বিজ্ঞানজগতে ফিসফিসানির মতো শুনলেও প্রমাণ ছিল না কোনো। আইনস্টাইন গণিতের ভাষায় বিজ্ঞানের ছন্দে সেটাকে এক মহাসংগীতের সুরে শোনালেন যেন।

নতুন প্রবন্ধে তিনি বললেন, যদি গতিশীল বস্তুর ভর বাড়ে, তাহলে এই ঘরের একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। আগে প্রকৃত ভর মাপার জন্য পরম কোনো তুল্য বস্তু ছিল না। এখন আছে আলোর বেগ। এটাকেই সমীকরণের মারপ্যাঁচে আবদ্ধ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। E=mc2 সমীকরণ নেই বাজিমাতটাই করেছিল। বলেছিল, বস্তুর প্রকৃত ভর জানা খুব সহজ। যদি তার শক্তির মান জানা যায়। অথবা যদি আপনার জানা থাকে বস্তুর ভর, তাহলে সেটার সঙ্গে আলোর বেগের বর্গ গুণ করলে পাওয়া যাবে তার শক্তি। শক্তি আর ভরের মধ্যে স্পষ্ট একটা সম্বন্ধ দেখিয়ে দিলেন আইনস্টাইন। যুগ যুগ ধরে ভরকে, জড়তাকে বস্তুর জন্য মৌলিক রাশি বলে মনে করতেন যাঁরা, তাঁদের আসন টলে গেল। ভর নির্ভরশীল হয়ে উঠল বস্তুর শক্তির ওপর। আগে ভর আর শক্তির সমীকরণের আলাদা আলাদা সংরক্ষণশীলতা নীতি ছিল। আইনস্টাইন তাঁর ভরশক্তির সমীকরণে দেখালেন, ভর আর শক্তি আলাদাভাবে সংরক্ষণশীলতার আওতায় না আনলেও চলে। এরা পরস্পরের পরিপূরক। তাই দুটিকে এক করে একটা সংরক্ষণশীলতার নীতি দাঁড় করানো যায়—ভরশক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি।

এই যে ভরশক্তির সমীকরণ আইনস্টাইন দাঁড় করালেন, এটার কথা কিন্তু আইনস্টাইনই প্রথম বলেননি। অর্থাৎ, E=mc2 নামের যে বিখ্যাত সমীকরণের জনক বলে আমরা জানি, এই সমীকরণের প্রবক্তা আইনস্টাইন নিজে নন। হেনরি পয়েনকেয়ার, যাঁকে মনে করা হতো বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য আইনস্টাইনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তিনিই এই সমীকরণের প্রথম প্রবক্তা; কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে আইনস্টাইনই কীভাবে মেরেকেটে বেরিয়ে গেলেন?

আসলে ভরের উৎস কী, এ প্রশ্নের জবাব ছিল না নিউটনীয় গতিবিদ্যায়। তারপর যখন তড়িৎগতিবিদ্যার জন্ম হলো স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের হাতে। তখন বিজ্ঞানীরা রায় দিলেন, নিউটনীয় বলবিদ্যার চেয়ে নতুন এই বলবিদ্যা আরও মৌলিক এবং পদার্থের অনেক গভীরের খবর এই বলবিদ্যা দিতে পারে। তখন অনেকেই ভাবলেন, বিদ্যুৎগতিবিদ্যার জগৎ থেকেই বেরিয়ে আসতে পারে বস্তুর ভরের কারণ। ১৮৮৮ সালের ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জে জে টমসন প্রথম কণাদের ভর নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন। তিনি দেখান, একটি চার্জিত গোলক যদি ঘুরতে থাকে, তাহলে সেটা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। সেই ক্ষেত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে গোলকটির ভেতরেই ঘুমিয়ে আছে তার ভর। তিনি একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। ধরা যাক, একটা টেনিস বল আপনি মাটিতে ছুড়ে আঘাত করলেন। সেটা মাটিতে বাউন্স করে বেশ কিছুটা ওপরে উঠে যাবে, কিন্তু পৃথিবীর মহাকর্ষ বল আবার বলটিকে মাটিতে নামিয়ে আনবে। মহাকর্ষীয় বল যেভাবে আকর্ষণ করে বলটিকে, তার জন্য যে গতিতে বলটার নিচে পড়া উচিত ছিল, সেই গতিতে নামতে পারবে না। বলটির পতনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বাতাসের বাধা। অর্থাৎ, বলটি শূন্যস্থানে পৃথিবীর টানে মাটিতে পড়ত, সেই বেগ অর্জন করতে পারবে না বাতাসের বাধার কারণে। বস্তু যত ভারী গতির সূত্রানুযায়ী তাকে গতিশীল করতে তত বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। বাতাসের বাধার কারণে মনে হবে বলটির ভর বেড়ে গেছে, বলটিকে স্বাভাবিক গতিতে পড়তে হলে আরও বেশি মহাকর্ষীয় টান দরকার হবে। বাড়তি এই যতটুকু ভর বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে, সেটাসহ মোট ভরই হলো বলটির কার্যকরী ভর। অন্যদিকে টেনিস বলটির নিজের ভেতরে যে ভর ঘুমিয়ে আছে, সেটিকে বলে স্থির ভর বা রেস্ট ম্যাস। এই স্থির ভরই হলো আসল ভর।

জে জে টমসন

টমসন বললেন, চার্জিত একটা গোলক যখন তার চারপাশে বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করে, তখন আরেকটা চার্জিত কণা যদি গোলকটার আকর্ষণে ছুটে যায়, তখন বিদ্যুৎক্ষেত্র দ্বারা সেটা বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং কণাটির ভর বেড়ে যাবে। তখন কণাটির ভর মাপলে যা পাওয়া যাবে, সেটা কার্যকরী ভর। সেই ভর কণাটির স্থির ভরের চেয়ে বেশ বেশি।

টমসন একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন বস্তুর ভরের বিষয়ে। ব্যাখ্যাটি বেশ জটিল। সেটার সঙ্গে বস্তুর চার্জ, ব্যাসার্ধ আর চুম্বকক্ষেত্র জড়িত; কিন্তু সেই ব্যাখ্যা পরিপূর্ণ ছিল না। পরের বছর আরেক ইংরেজ বিজ্ঞানী অলিভার হেভিসাইড দেখালেন বস্তুর কার্যকরী ভর হবে m=4E/3c2। এখানে E চার্জিত গোলটির বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের শক্তি। এরপর অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী ভিলহেম ভিন আর ম্যাক্স আব্রাহাম কৃষ্ণবস্তুর মধ্যে বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখান, যে ‘বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ভর’–এর কথা বলছেন টমসন বা অলিভার, সেটা শুধু চার্জিত বস্তু বা কণার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সব বস্তু বা কণার ক্ষেত্রে সেটা প্রয়োগ করা যাবে না। তখন এই বিজ্ঞানীদ্বয় শক্তি আর ভরের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করলেন; কিন্তু সফল হননি।

১৯০০ সালে এসে হেনরি পয়েনকার দিলেন এক নতুন সমীকরণের হদিস। তত দিনে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রকাশ করে ফেলেছেন। অন্যদিকে তেজস্ক্রিয় ক্ষয় নিয়ে গবেষণা করছেন মেরি কুরি। কুরি দেখালেন, তেজস্ক্রিয়া রশ্মি বিকিরণ করার মৌলের পরমাণুর ভর কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ, যে তেজস্ক্রিয় শক্তির বিকিরণ হচ্ছে, সেটার জন্ম হচ্ছে বস্তুর ভর থেকে। পয়েনকার ভর আর শক্তির সেই সম্পর্কটা বের করে ফেললেন, সেটা সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2। তখন বিজ্ঞানী মহল এই সমীকরণ হজম করতে পারেনি। কারণ, নিউটনীয় বলবিদ্যায় মোহ তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিজ্ঞানীসমাজ। পয়েনকার পারেননি নিউটনীয় বলবিদ্যার সাহায্যে এর ব্যাখ্যা দিতে কিংবা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাহায্য নিতে। সেই কাজগুলোই করলেন আইনস্টাইন। তিনি বিশেষ আপেক্ষিকতার অবতারণা করেন, যেটা পয়েনকারও করেছিলেন। স্থান–কাল আর ভরশক্তির যেমন সমন্বয় করেন বিশেষ আপেক্ষিকতায়, কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে বিরোধে যাননি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দিয়েও E=mc2-এর হিসাব বের করা যায় সহেজেই। সুতরাং, আইনস্টাইনই তাই ভরশক্তির সমীকরণের প্রতিষ্ঠাতা।

আইনস্টাইনের সমীকরণ যে ঠিক, চারপাশ থেকে তার প্রমাণ আসে। আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা ছাড়া এই সমীকরণ ব্যবহার করে বের করা যেত না নিউক্লিয়াসের ভর সমস্যার সমাধান। একটা পরমাণুর ভর হিসাব করে দেখা গেছে, একটা নিউক্লিয়াসের মোট ভর যা হওয়া উচিত, পরীক্ষা করে তার ভর শতগুণ বেশি পাওয়া যায়। বাড়তি এই ভরের হিসাব মেলে কেবল আইনস্টাইন প্রতিপাদিত ভরশক্তির সমীকরণ থেকেই।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান