অতীতে যে বড় উল্কার সংঘর্ষে পৃথিবীর আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তা আমরা জানি। প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে আনুমানিক ১০ কিলোমিটার ব্যাসের উল্কাপিণ্ড (KT উল্কা) পৃথিবীতে পড়েছিল, যার ফলে ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৮ সালে সাইবেরিয়ার তুংগুস্কায় একটি উল্কা পড়ে, যার প্রভাবে প্রায় কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বনের সব গাছ উৎপাটিত হয়ে যায়। মনে করা হয়, ভূমির ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার ওপরে ৫০ থেকে ৮০ মিটার ব্যাসের একটি উল্কাপিণ্ডের বিস্ফোরণে এটি ঘটে। সাইবেরিয়ার ওই জায়গা এতই দুর্গম ছিল যে সেই শক্তিশালী ঘটনা কোনো মানুষ স্বচক্ষে দেখেনি। যদিও ৫০০ কিলোমিটার দূরেও এর শব্দ শোনা গিয়েছিল।
১৯৯৮ সালে NASA ঘোষণা দেয়, পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক এ রকম এক কিলোমিটার ব্যাসের বড় উল্কাপিণ্ড অন্তত ৯০ শতাংশ জ্যোতির্বিদদের চিহ্নিত করতে হবে। মার্কিন দেশের নিউ মেক্সিকো, অ্যারিজোনা ও হাওয়াইতে বসানো বেশ কয়েকটি দুরবিন এই পর্যবেক্ষণে অংশগ্রহণ করে এবং পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে এই বিভাগের প্রায় ১০০ শতাংশ উল্কা আবিষ্কার করা যায়।
মানবজাতির জন্য কোনো একটি বড় বিপদ মানুষকে এক করবে, এ রকম একটি আশা অনেকেই পোষণ করতেন, কিন্তু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের এককভাবে লড়াই তাদের আশাহত করেছে।
কোন ধরনের উল্কাকে জ্যোতির্বিদেরা ঝুঁকিপূর্ণ ভাবছিলেন?
যেসব গ্রহাণু আমাদের থেকে ০.০৫ জ্যোতির্বিদ্যা একক দূরত্বের মধ্যে আসবে, সেগুলো। এক জ্যোতির্বিদ্যা একক হলো পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব। আর ০.০৫ জ্যোতির্বিদ্যা একক হলো পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের ২০ গুণের মতো। ১৯৯৮ সালের পর জ্যোতির্বিদেরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা ১৪০ মিটার ব্যাসের ওপরের সব গ্রহাণুকে চিহ্নিত করবেন। কম ব্যাসের গ্রহাণু বা উল্কাপিণ্ড, যেগুলো পৃথিবীর খুব কাছাকাছি আসে বলে মনে করা হচ্ছে, সেগুলোর খুব অল্প অংশই পর্যবেক্ষকেরা আবিষ্কার করতে পেরেছেন। কাজেই অজানা ছোট উল্কাপিণ্ডের পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনাটা রয়ে গেছে। যদিও বিজ্ঞানীরা প্রায়ই নতুন গ্রহাণু দেখছেন। তবে আবিষ্কৃত নিকটবর্তী গ্রহাণুর কোনোটিই আগামী ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক নয় বলে মনে করা হচ্ছে। JPL-এর একটি ওয়েবসাইট আছে, যেখানে আবিষ্কৃত বস্তুসমূহ কোন সময় পৃথিবীর কাছাকাছি আসবে, সেটার একটা টেবিল আছে। আগ্রহী পাঠক সেটা দেখে নিতে পারেন এই ঠিকানায়— https://cneos.jpl.nasa.gov।
প্রতিবছর পৃথিবীতে মহাকাশ থেকে আসা প্রায় ১৫ হাজার টন গ্রহাণু বস্তু জমা হয়। এগুলোর বেশির ভাগই আসে খুবই ছোট ধূলিকণার মতো জিনিস থেকে। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে ১ মিলিমিটার আকারের ধূলিকণা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আছড়ে পড়ে। আমরা রাতের আকাশে যেসব উল্কারেখা দেখি, সেগুলো এই ছোট মহাজাগতিক ধূলিকণার জন্যই। অন্যদিকে ১০০ মিটার ব্যাসের উল্কা আমরা প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার বছরে একবার আশা করতে পারি।
এসব উল্কা আসছে কোথা থেকে?
এদের মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো দূরপাল্লার ধূমকেতুসমূহ, যাদের শুরু সুদূর ওর্ট মেঘ থেকে, প্রায় ১০ হাজার জ্যোতির্বিদ্যা একক দূরত্ব থেকে। এসব ধূমকেতুর পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনা কম, উপরন্তু বৃহস্পতি গ্রহও তাদের হাত থেকে আমাদের কিছুটা রক্ষা করে। এরপর রয়েছে অল্প পর্যাবৃত্ত সময়ের ধূমকেতুরা, যাদের অপসূর বৃহস্পতির কাছাকাছি এবং যারা প্রতি পাঁচ–ছয় বছরে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। মনে করা হয়, এদের মধ্যে কিছু পৃথিবীকে নিয়মিত আঘাত করে। এরপর আসছে গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে আসা গ্রহাণুরা। আমরা মনে করছি, পৃথিবীর সঙ্গে বেশির ভাগ সংঘর্ষ এদের সঙ্গেই হয়। কিছু গবেষণা দেখাচ্ছে, বৃহস্পতি দূরের ধূমকেতু থেকে আমাদের রক্ষা করলেও কাছের ধূমকেতু বা গ্রহাণু থেকে হয়তো রক্ষা করতে সক্ষম নয়।
এদের থেকে বাঁচার উপায় কী?
বিজ্ঞানীরা বসে নেই। তাঁরা সমাধানের পর সমাধান দিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমে প্রস্তাব ছিল পারমাণবিক বোমা। এই বোমা গ্রহাণুর কিছু ওপরে বিস্ফোরিত করলে হয় তার শক্তিতে গ্রহাণু তার কক্ষপথ থেকে সরে যাবে, অথবা ভেতরে ঘটালে গ্রহাণু থেকে উদ্গিরিত গ্যাস রকেটের মতো কাজ করবে এবং গ্রহাণুকে গ্যাসের উল্টো পথে চালনা করবে। একটি বড় মহাকাশযান দিয়ে সরাসরি আঘাতের ধারণাও আছে। ২০০৫ সালে নাসার Deep Impact মহাকাশযান সফলভাবে Temple 1 নামে একটু ছোট ধূমকেতুকে আঘাত করে। যদিও এতে Temple 1-এর কক্ষপথের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এ রকমভাবে কোনো গ্রহাণুকে যে সরাসরি আঘাত করা সম্ভব, সেটা প্রমাণিত হলো। আরও প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে একটি মহাকাশযানকে গ্রহাণুর চারপাশে প্রদক্ষিণ করানো, পারস্পরিক মাধ্যাকর্ষণের ফলে তাতে গ্রহাণুর কক্ষপথ বদলাবে। রয়েছে লেজার রশ্মি দিয়ে কিংবা সূর্যের আলোকে লেন্সের মাধ্যমে ঘন করে গ্রহাণুকে উত্তপ্ত করে তার গতিপথ বদলানো।
নিকটবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ গ্রহাণু আবিষ্কার ও ভবিষ্যতের পৃথিবী অভিমুখী গ্রহাণুদের ধ্বংসের উপায় নির্ধারণ করে জ্যোতির্বিদেরা মানবজাতির এবং সমগ্র পৃথিবীর বেঁচে থাকার উপায় দেখাচ্ছেন। আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও গঠন, নক্ষত্রদের শক্তির উৎস, কৃষ্ণগহ্বর—এসব রহস্যের সমাধান যেমন জ্যোতির্বিদ্যার অংশ, পৃথিবীর সুরক্ষাও এই বিজ্ঞানের একটি বিভাগ। আমার আশা এইভাবে জ্যোতির্বিদ্যা পৃথিবীর সব মানুষকে এক করার একটি উপায় বলে একদিন স্বীকৃতি পাবে।