মহাবিশ্বে কত গ্যালাক্সি আছে?

নাসা
আমাদের পৃথিবীর অবস্থান যে গ্যালাক্সিতে, তার নাম মিল্কিওয়ে। এই গ্যালাক্সির মধ্যেও কোটি কোটি নক্ষত্র আছে। আছে ধুলাবালি ও গ্যাস। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ বা ৯.৫×১০১৭ কিলোমিটার।

প্রচুর গ্যাস, ধূলিকণা এবং কোটি কোটি নক্ষত্রের বিশাল সংগ্রহকে বলা হয় গ্যালাক্সি। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে গ্যালাক্সির মধ্যে এই সব কিছু এক সঙ্গে আবদ্ধ থাকে। গ্যালাক্সিগুলো কোটি কোটি কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। একেকটি গ্যালাক্সি এত বড় যে এর দূরত্ব পরিমাপ করা হয় আলোকবর্ষে।

মহাবিশ্বের যেসব বস্তু অনেক দূরে অবস্থিত, সেগুলোর দূরত্ব বোঝাতে মাইল বা কিলোমিটারের পরিবর্তে আলোকবর্ষ ব্যবহার করা হয়। শুনতে বছর বা সময়ের একক মনে হলেও আলোকবর্ষ মূলত দূরত্বের একক। আসলে এক বছরে আলো যে দূরত্ব যেতে পারে, তা-ই এক আলোকবর্ষ। জানেন নিশ্চয়ই, আলো এক সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। তাহলে নিজেই হিসেব করুন তো, আলো এক বছরে কত দূর যেতে পারে? হিসেব করলে মিলিয়ে নিতে পারেন। এক আলোকবর্ষ মানে ৯.৫×১০১২ কিলোমিটার।

কথা হলো, এরকম কতগুলো গ্যালাক্সি আছে মহাবিশ্বে? সেটাই জানব আমরা। তবে চলুন, আগে একটু জেনে নিই, গ্যালাক্সি আসলে কী? কিংবা কতটা বড় একেকটি গ্যালাক্সি? একটি গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র ছাড়াও আরও কী কী থাকতে পারে, তা আগেই বলেছি। এবার আরেকটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। সেজন্য আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়েতে যেতে হবে।

আমাদের পৃথিবীর অবস্থান যে গ্যালাক্সিতে, তার নাম মিল্কিওয়ে। এই গ্যালাক্সির মধ্যেও কোটি কোটি নক্ষত্র আছে। আছে ধুলাবালি ও গ্যাস। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ বা ৯.৫×১০১৭ কিলোমিটার। আর নক্ষত্র আছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি।

রাতের আকাশে তাকালে দেখা যায়, মিটিমিটি করে অনেক অনেক তারা বা নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। সত্যি বলতে, খালি চোখে দুই থেকে পাঁচ হাজারের বেশি তারা দেখা যায় না। এরা প্রত্যেকেই আমাদের সূর্যের মতো একেকটি অগ্নিগোলক। অনেক দূরে বলে এদের এত ছোট দেখা যায়।

 আমাদের সূর্যও আর সব তারার মতোই। আর আগেই বলেছি, এরকম প্রায় ১০ হাজার কোটি তারা আছে মিল্কিওয়েতে। পৃথিবী যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তেমনি সূর্যও ঘোরে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে। তবে সূর্য ঠিক বৃত্তাকার পথে ঘোরে না। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভেতরে সূর্যের চলার পথটি খানিকটা তরঙ্গ বা ঢেউয়ের মতো।

অন্ধকার রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকলে অনেক সময় খালি চোখেই আকাশজুড়ে একটি আলোর পাতলা অস্পষ্ট ব্যান্ড দেখা যায়। ওটাই আসলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। গ্রামে গেলে এটা সহজেই দেখা যায়। কারণ, গ্রামে শহরের মতো এত আলো নেই। অর্থাৎ আলোকদূষণ কম। খালি চোখে তাকালে মিল্কিওয়েকে পাতলা ব্যান্ডের মতো দেখায়, কারণ আমাদের গ্যালাক্সিটির আকৃতি একটা পাতলা ডিস্কের মতো। আমরা শুধু ডিস্কের কিছু অংশ দেখতে পাই। আমরা যদি এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে তাকাই, তাহলে গ্যালাকটিক কোর নামে একটি উজ্জ্বল অঞ্চল দেখতে পাব। এখানকার নক্ষত্রগুলো অনেক কাছাকাছি থাকে। এ কারণেই ওরকম দেখায়।  

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সর্পিল বাহু আছে। এরকম সর্পিলাকার বাহুবিশিষ্ট আরও অনেক গ্যালাক্সি আছে মহাবিশ্বে। এ ধরনের গ্যালাক্সিগুলোকে বলে সর্পিলাকার গ্যাল্যাক্সি। 

যদিও সব গ্যালাক্সি এরকম নয়। মহাবিশ্বে এমন অনেক গ্যালাক্সি আছে, যেগুলো মসৃণ, ডিম্বাকৃতির আলোর বলের মতো দেখায়। খানিকটা আলো দিয়ে তৈরি ফুটবল বা রাগবি বলের মতো। এগুলোকে আমরা বলি উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি। এ ধরনের গ্যালাক্সির বেশিরভাগই শীতল এবং লালচে নক্ষত্রে ভরা। আবার এমন অনেক গ্যালাক্সিও আছে, যাদের নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নেই। এগুলোকে অনিয়মিত বা অনিয়ত গ্যালাক্সি বলে। 

এবারে শুরুর সেই প্রশ্নটিতে ফেরা যাক। মহাবিশ্বে এরকম কতগুলো গ্যালাক্সি আছে? আসলে মহাবিশ্বের মোট গ্যালাক্সির সংখ্যা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। বলা যায়, প্রায় অসম্ভব। কারণ অনেক গ্যালাক্সি এত ছোট যে আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তারপরেও বিজ্ঞানীরা গ্যালাক্সির সংখ্যা হিসেব করার একটি কৌশল বের করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টানা ১১ দশমিক ৩ দিন হাবল স্পেস টেলস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশের একটি নির্দিষ্ট অংশ পর্যবেক্ষণ করেন। কাছের এবং দূরের অনেক গ্যালাক্সি থেকে আলো সংগ্রহ করেন টেলিস্কোপের সাহায্যে। মহাবিশ্বের এই ছোট্ট অংশ পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রায় ১০ হাজার গ্যালাক্সির সন্ধান পান। এরপর এই সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে পুরো মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি কত হতে পারে, তা অনুমান করেন। সে হিসেবে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি থাকার সম্ভাবনা আছে। গুগলে সার্চ করলেও এই সংখ্যাটিই দেখাবে। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। 

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এই হিসাব কতটা সঠিক? কিংবা প্রশ্নটা এভাবেও করা যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হিসেবটা এভাবে করলেন কেন? কারণ, মহাবিশ্ব সবদিকে সুষম। অনেক অনেক দূর থেকে যদি আমাদের গ্যালাক্সি যেদিকে, সেদিকে তাকাই; তাহলে মহাবিশ্বটাকে যেরকম দেখাবে, অন্য যেকোনো দিকে তাকালেও একইরকম দেখাবে। তাই মহাবিশ্বের একটি অংশে কী পরিমাণ গ্যালাক্সি আছে, সে হিসাব করে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের মোট গ্যালাক্সির হিসেব করা হয়েছে।  

আগেই বলেছি, এমন অনেক গ্যালাক্সি আছে, যেগুলোকে আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি মাথায় রেখেছেন। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, পর্যবেক্ষণ করা যায় না কিন্তু মহাবিশ্বে আছে, এমন গ্যালাক্সির সংখ্যা প্রায় দুই ট্রিলিয়নের মতো হতে পারে। 

তবে আরও একটি সম্ভাবনা আছে। আসলে সরলভাবে বললে, মহাবিশ্বে ঠিক কতটি গ্যালাক্সি আছে, তা সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা কঠিন। কারণ, মহাবিশ্ব ঠিক কত বড়, সেটাই আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। নিয়মিত বাড়ছে মহাবিশ্ব। প্রতিমুহূর্তে জন্ম হচ্ছে অসংখ্য গ্যালাক্সির। আবার মহাবিশ্বের এমন অঞ্চলও আছে, যেখান থেকে কোন আলো এখনও আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। সেই অঞ্চল সম্পর্কে আমরা আসলে কিছুই জানি না।

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, মহাবিশ্ব অসীম হতে পারে। অসীম, তবে নিজের ভেতরে আবদ্ধ। ঠিক একটা বেলুনকে ফোলালে যেরকম মনে হয়, সেরকম। আর গ্যালাক্সিগুলো আছে এই বেলুনের পিঠে। অসীম এই বেলুনটি প্রতিমুহূর্তে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। এ কথার মানেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। এরকম হলে মহাবিশ্বের মোট গ্যালাক্সির সংখ্যাও হতে পারে অসীম। 

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন ডট কম ও স্কাইনাইট ম্যাগাজিন ডট কম