মহাবিশ্বের প্রথম আলো

আজকের মহাবিশ্ব তো আলোয় ভরপুর। অন্তত আমরা খালি চোখে তা–ই মনে করি। মেঘমুক্ত রাতের আকাশে মিটমিট করে তারারা আলো দেয়। যদিও মহাকাশের গভীরে তীব্র অন্ধকার আজও আছে, তবে সেই ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়।

প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে, সব দিকেই তো নক্ষত্ররা আছে। তাহলে অন্ধকার জায়গা আসবে কোথা থেকে? পরক্ষণেই চিন্তা করলে বোঝা যায়, নক্ষত্ররা আছে বেশ দূরে দূরে। দূরত্বের সঙ্গে আলোর তীব্রতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। দূরত্ব দ্বিগুণ হলে তীব্রতা হয়ে যায় চার ভাগের এক ভাগ। এই নিয়মের নাম বিপরীত বর্গীয় সূত্র। ফলে, এমনও জায়গা আছে, যেখানে নক্ষত্রের আলোরা আসতে আসতে সেই আলোদের তীব্রতা প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়।

কিন্তু জটিলতার এখানেই শেষ নয়। নক্ষত্রদের সংখ্যা আসলে এত বেশি যে এমন কোনো স্থান পাওয়া কঠিন, যেখানে অগুনতি নক্ষত্রের দুর্বল আলোগুলোর মিলিত রূপ নগণ্য হয়ে যাবে। মানে, পুরো মহাবিশ্ব আলোয় আলোয় ভরপুরই থাকার কথা। তবু দূর মহাকাশ অন্ধকার। এর পেছনে মূল কারণ মহাবিশ্বের প্রসারণ। মহাবিশ্বের সবটুকু জায়গাকে আলো দিয়ে ভরপুর করার মতো যথেষ্ট সময় এখনো পার হয়নি। নক্ষত্ররা এত দূরে দূরে আছে যে তাদের আলোগুলো মিলিত হয়ে উজ্জ্বল স্থান তৈরির সময় এখনো পায়নি। আর ক্রমাগত আরও দূরে তো সরছেই।

কিন্তু এ তো গেল গভীর মহাকাশের অন্ধকারের কথা। সব জায়গা কিন্তু অন্ধকার নয়। সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তবে একসময় কিন্তু মহাবিশ্বের পুরোটাই অন্ধকারের চাদরে আবৃত ছিল। আলোকিত অবস্থায় জন্ম হয়নি মহাবিশ্বের। ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগের বিগ ব্যাং নামের মহাবিস্ফোরণটি আর দশটা বিস্ফোরণের মতো আলোর বিচ্ছুরণ তৈরি করেনি।

মহাবিশ্ব কবে আলোকিত হয়েছিল, সেটা জানতে আমরা কাজে লাগাই আলোর ধর্মকেই। আলোর বেগের বিশালতা দেখে আমরা শিহরিত হই। প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। চাট্টিখানি কথা? কিন্তু মহাবিশ্বের মাপকাঠিতেই এই বেগ কিছুই নয়। এই বেগ অল্প বলেই আমরা এই মুহূর্তে যে সূর্যকে দেখছি, সেটা ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগের সূর্য। কারণ, সূর্য থেকে আলো আমাদের চোখে আসতে এই সময়টুকু লেগেই যায়। এই অসুবিধাই আবার সুবিধা। আমরা মহাবিশ্বের যত গভীরে তাকাব, তত অতীত দেখতে থাকব। এ কারণেই আমরা লাল বেটেলজিউস নক্ষত্রের ৬৪২ বছর আগের অবস্থা দেখছি। প্রতিবেশী অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথকে দেখছি ২৫ লাখ বছর আগের অবস্থায়।

এবার ঘড়ির কাঁটাকে একটু পেছনে ঘোরাই। চলে যাই মহাবিশ্বের শুরুর অবস্থায়। যেতে যেতে এমন এক জায়গায় পৌঁছাব, যে স্থানটা বর্তমানের চেয়ে ঘন ও উষ্ণ। এতটাই ঘন যে বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পরের মহাবিশ্বটা ছিল প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন কণায় পরিপূর্ণ স্যুপের মতো। উত্তাপের প্রভাবে কণাগুলো ছিল একে অপর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়।

একটু পর মহাবিশ্ব আরেকটু প্রসারিত হলো। তাপমাত্রাও একটু কমল। ঘনত্ব ও তাপমাত্রা এবার সূর্যের মতো নক্ষত্রদের কেন্দ্রের মতো হলো। মানে প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় এবার আয়নিত হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরির সুযোগ হলো। পরমাণুতে প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যার ভিন্নতা হলে তাকে আয়নিত অবস্থা বলে।

সূর্যের মতো নক্ষত্রদের কী হয়, তা আমরা জানি। হাইড্রোজেনরা জোড়া লেগে হিলিয়াম তৈরি হয়। মহাবিশ্বের সেই অবস্থাটিও নক্ষত্রের কেন্দ্রেই মতোই। ফলে একই ঘটনা ঘটল। প্রায় একই রকম চাপ ও তাপমাত্রা থাকায় এক প্রোটনবিশিষ্ট হাইড্রোজেনগুলো জোড়া লেগে লেগে তৈরি হলো দুই প্রোটনের হিলিয়াম। ক্রমে তৈরি হলো আরও বেশি প্রোটনের পরমাণুরাও। মানে আরও ভারী পরমাণু। পর্যবেক্ষণ বলছে, বর্তমানে মহাবিশ্বে প্রায় ৭৪ ভাগ হাইড্রোজেন, ২৫ ভাগ হিলিয়াম ও ১ ভাগ অন্যান্য পরমাণু আছে। এটা থেকে আমরা হিসাব করে বলতে পারি, মহাবিশ্ব এ অবস্থায় কতটা সময় ছিল। মানে, কতক্ষণ সময় ধরে পুরো মহাবিশ্বই নক্ষত্রের মতো ছিল।

হিসাব বলছে, সময়কালটা প্রায় ১৭ মিনিট। বিগ ব্যাংয়ের ৩ মিনিট থেকে প্রায় ২০ মিনিট পর পর্যন্ত। এ সময় হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হতে থাকে। নক্ষত্রেও ঘটা একই প্রক্রিয়াটির নাম নিউক্লীয় ফিউশন। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় গামা বিকিরণের ফোটন। সূর্যের ক্ষেত্রে এই আলোর কণাগুলো পরমাণু থেকে পরমাণুতে লাফিয়ে লাফিয়ে কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে চলে আসে। ছড়িয়ে পড়ে দূরে আকাশে। পৃথিবীতে। এই প্রক্রিয়ায় সময় লেগে যায় কয়েক অযুত বছর সময়। তবে প্রাথমিক মহাবিশ্বে গামা বিকিরণের এই আদি ফোটন কণাগুলোর যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কারণ, সব দিকই ছিল আরও বেশি উষ্ণ ও ঘন। এ কারণে আলোর কণা উপস্থিত থাকলেও মহাবিশ্ব ছিল অন্ধকার, অস্বচ্ছ (opaque)।

ওদিকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছিল। বিগ ব্যাংয়ের কয়েক লাখ বছর পরের কথা। মহাবিশ্বের উত্তাপ আরও কমল। প্রায় ৩ হাজার কেলভিন বা প্রায় ২৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (কেলভিনকে সেলসিয়াস স্কেলে নিতে চাইলে ২৭৩.১৫ বিয়োগ করুন)। এবার হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণুরা মুক্ত ইলেকট্রনকে আকর্ষণ করছে। পরিণত হচ্ছে স্বাভাবিক পরমাণুতে। আগে তো ছিল আয়নিত অবস্থায়। এটাই ছিল মহাবিশ্বের প্রথম আলোকোজ্জ্বল অবস্থা। ঘটনাটি বিগ ব্যাংয়ের ২ লাখ ৪০ হাজার থেকে ৩ লাখ বছর পরের সময়কালে ঘটা। সময়কালটিকে বলা হয় পুনর্মিলন যুগ (recombination era)। ইলেকট্রন ও প্রোটনের মিলনের কারণেই নামটি দেওয়া। তবে মিলন বললেই চলত। ‘পুনঃ’ কথাটা আসলে বাড়াবাড়ি। কারণ, এর আগে কখনো এই কণা দুটি মিলিত ছিল না। এই প্রথম ফোটন কণা ইলেকট্রন হিসেবে পরমাণুতে স্থির হয়ে ঠাঁই নেওয়ার সুযোগ পেল। মহাবিশ্বও অস্বচ্ছ ও অন্ধকার থেকে আলোকিত হতে প্রস্তুত হলো।

জ্যোতির্বিদেরা সর্বোচ্চ এই সময়ের আলোই দেখতে পারেন। এই আলোর অস্তিত্ব এখনো আছে। তবে সেই আগের রূপে নয়। প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর ধরে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। তার ফলে সেই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য লম্বা হয়ে গেছে। সরে গেছে লাল বর্ণের দিকে। অতিবেগুনি থেকে ক্রমেই সরে গেছে দৃশ্যমান আলোর পরিসরের দিকে। তাতেই থামেনি। দৃশ্যমান আলোর পরিসর ছাড়িয়ে আরও লম্বা হয়ে চলে গেছে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের দিকে। মানে, অতীতের সেই আলো এখনো মহাবিশ্বে আছে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ আকারে। এর একটি গালভরা নামও আছে। মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি (cosmic microwave background)।

তবে এত বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমরা মানুষেরা দেখতে পাই না। মাইক্রোওয়েভ আলো দেখতে পারলে আমরা কি দিন কি রাত, চতুর্দিক আলোয় ভরপুর দেখতে পেতাম।

আলোর প্রাথমিক এই স্ফূরণের পরও সবকিছু অন্ধকার। আলো বিকিরণ করার মতো নক্ষত্র যে এখনো আসেনি। আছে শুধু প্রারম্ভিক কিছু মৌলিক পদার্থ। পুনর্মিলন যুগ থেকে শুরু করে প্রথম নক্ষত্র তৈরি পর্যন্ত সময়কে বলে অন্ধকার যুগ। অন্ধকার যুগের শুরুতে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ৪ হাজার কেলভিন। সেই তাপমাত্রাই কমে এখন হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭ কেলভিন। অন্ধকার যুগের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ১৫ কোটি বছর। যুগের শেষে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা দাঁড়ায় ৬০ কেলভিন।

পরের ৮৫ কোটি বছর আগে দারুণ ঘটনা ঘটতে শুরু করল। হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামে গড়া বিশালবপু নক্ষত্রের জন্ম শুরু। ভারী মৌলিক পদার্থ না থাকায় প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম একীভূত হওয়ার সুযোগ পেল। ফলে আমাদের সূর্যের কয়েক শ গুণ পর্যন্ত ভারী নক্ষত্র তৈরি হলো। এই নক্ষত্রগুলোকে বলা হয় তৃতীয় প্রজন্মের বা প্রথম নক্ষত্র। এদের দেখার মতো শক্তিশালী টেলিস্কোপ এখনো বানানো সম্ভব হয়নি। পরোক্ষ হিসাব বলছে, এদের জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৫৬ কোটি বছর পর।

একসময় স্বাভাবিক নিয়মে এরা সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হলো। বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি হলো আরও ভারী নক্ষত্র। তাদের ভাগ্যেও ঘটল একই পরিণতি। এই সময়টায় পুরো মহাবিশ্বে আতশবাজির মতো শুধু নক্ষত্রের বিস্ফোরণ ঘটত। পুরো মহাবিশ্ব সেই আতশবাজির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল। এ সময়টার নাম পুনরায়নীকরণ যুগ। উত্তপ্ত প্লাজমা পদার্থ দিয়ে পুরো মহাবিশ্ব ভর্তি।

তারপর আরও অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে মহাবিশ্ব। আজ পুরো মহাবিশ্ব আলোকিত নয়। সেটা আমরা আগেই বলেছি। একসময় আবার মহাবিশ্ব অন্ধকারের দিকে চলে যাবে। তবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয় হলো, আমাদের চারদিকে আজও অস্তিত্বমান প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগের মহাবিশ্বের আলো। আমরা খালি চোখে সেটা দেখছি না, এই যা। শুধু আমরাই নয়, অন্য প্রাণীরাও দেখে না মাইক্রোওয়েভ আলো। যদিও অনেক প্রাণীই এমন আলো দেখে, যেটা আমরা দেখি না। যেমন অনেক প্রজাপতি অতিবেগুনি আলো দেখে। সাপসহ অনেক প্রাণীই আবার দেখে অবলোহিত আলো। বিস্তারিত নাহয় আমরা অন্য সময় জানি।

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, ফিজ ডট অর্গ, স্পেস ডট কম, কর্নেল ডট এজু, দ্য আটলান্টিক ডট কম