সাক্ষাৎকার

মহাকাশে ভেসে বেড়ানো দুর্দান্ত ব্যাপার —জোসেফ এম আকাবা, প্রধান নভোচারী, নাসা

প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করলেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবা। এ সফরে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তৃতা দেন। এ ছাড়াও বেশ কিছু বিদ্যালয়ে ও প্রতিষ্ঠানে তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এই নভোচারী। এ ছাড়াও এ সফরে তিনি আর্টেমিস অ্যাকর্ডসে বাংলাদেশের যোগদানের ব্যাপারে আলোচনা করেন। এ নীতিমালা নাসা ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা আরও জোরদারে সাহায্য করতে পারে। পাশাপাশি এ সফরে বিজ্ঞানচিন্তাকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের মহাকাশযাত্রা, জীবনযাপনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল হোসাইন। ছবি তুলেছেন আশরাফুল আলম

বিজ্ঞানচিন্তা:

নভোচারী হতে কোন বিষয়টা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে? জীবনের কোন ঘটনা আপনাকে এ পথে নিয়ে এসেছে?

জোসেফ এম আকাবা: আমার নভোচারী হওয়ার যাত্রাটা দীর্ঘ। আমার প্রথম অনুপ্রেরণা জাগে যখন দাদা আমাকে অ্যাপোলো অভিযানের অংশ হিসেবে চাঁদে নভোচারীদের হেঁটে চলার পুরোনো ফিল্ম দেখাতেন।

আমি ভাবতাম, বাহ্‌, এ তো খুব চমৎকার! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি বা ধরনের বই পড়তেও খুব পছন্দ করতাম। এ ধরনের পড়াশোনা মহাকাশে যাওয়ার কল্পনা ও চিন্তা জোগাত। কিন্তু জীবন আমাকে ভিন্ন পথে নিয়ে গেল। নভোচারী হওয়ার আগে স্কুলশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের গণিত ও বিজ্ঞান পড়াতাম।

সেই সময় নাসা কিছু শিক্ষককে পূর্ণকালীন নভোচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য খুঁজছিল। তাই নভোচারী হওয়ার পেছনে বলা যায় আমার জীবনে বিশেষ কোনো বাঁক ছিল না, বরং এ এক অভিযাত্রা—বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা, আমার শিক্ষা, সব মিলে। তারপরই একজন শিক্ষক থেকে নভোচারী হওয়ার দারুণ সুযোগটা চলে আসে। আমি আসলে অনেক ভাগ্যবান।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি ২০০৪ সালে নাসার নভোচারী হিসেবে নির্বাচিত হন। এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল? সে জন্য নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছেন?

জোসেফ এম আকাবা: নভোচারী হওয়া বেশ কঠিন। কারণ, অনেকেই আবেদন করেন। কিন্তু আমরা নিয়োগ দিই অল্প কয়েকজনকে। কাজেই নভোচারী হওয়ার জন্য আপনার অভিজ্ঞতা নাসার জন্য কতটা সহায়ক, তা তুলে ধরাই সবচেয়ে কঠিন দিক। আমার মতে, সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ ছিল আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরা, যার মাধ্যমে অন্যান্য আবেদনকারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারি। প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ—স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সঙ্গে ছিল বেশ কয়েকটি ইন্টারভিউ।

পুরো প্রক্রিয়াটা খুব চ্যালেঞ্জিং। তারপর আপনি যদি ভাগ্যবান হন, তারা আপনাকে নির্বাচন করবে। আমার বেলায়, আমি স্কুলশিক্ষক থেকে নভোচারী হয়েছি, যার অর্থ হলো, এখন আমি আবার ছাত্র। কারণ, নভোচারী হওয়ার জন্য যা যা শেখা দরকার, সবকিছু শিখতে হবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

নাসার মহাকাশ অভিযানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে আপনাকে কী ধরনের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়েছে?

জোসেফ এম আকাবা: নভোচারী হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ খুব কঠিন। নিয়োগের পর প্রথম দিকে আপনাকে ‘নভোচারী প্রার্থী’ হিসেবে সম্বোধন করা হবে। আর মহাকাশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই প্রশিক্ষণ প্রায় দুই বছরের। আপনি মৌলিক কিছু দক্ষতা অর্জন করবেন, স্পেসওয়াক (মহাশূন্যে মহাকাশযান থেকে বাইরে বের হওয়া) কীভাবে করতে হয়, তা শিখবেন। রোবোটিক হাত ওড়ানো শিখতে হবে। উচ্চ কার্যক্ষমতাসম্পন্ন জেট ওড়ানো শিখতে হবে—পাশাপাশি বাড়াতে হবে যোগাযোগ দক্ষতা। এভাবে স্বল্প সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা তৈরি হবে। আপনাকে দুই বছর ধরে এই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এরপর মহাকাশ মিশনে নিয়োগ দেওয়া হবে। তারপর আরও ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ। অর্থাৎ প্রথম মহাকাশ মিশনের জন্য প্রস্তুত হতে আপনার প্রায় চার বছরের প্রশিক্ষণ লাগবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

তিনটি মিশনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ৩০৬ দিন থাকাসহ আপনি অনেকগুলো মহাকাশ মিশনে গিয়েছেন। মহাকাশে থাকাকালে আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত ও অনুভূতিগুলো কী?

জোসেফ এম আকাবা: হ্যাঁ, মহাকাশে যাওয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর। আমার তো অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত আছে। এর মধ্যে একটি প্রিয় মুহূর্ত ছিল স্পেস শাটলে আমার প্রথম ফ্লাইট। সেদিন আমরা দুজন পৃথিবী ছেড়ে গেলাম। সে জন্য ৮ দশমিক ৫ মিনিট সময় লাগে। স্পেস শাটলটা তখন কাঁপছিল। জানেনই তো, এ জন্য আগে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, সিমুলেটরে (প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) ছিলাম। কিন্তু তখন বাস্তবে প্রথম এর মধ্যে ছিলাম।

সেটা দারুণ এক মুহূর্ত ছিল। ৮ দশমিক ৫ মিনিট পর আমি মহাকাশে পৌঁছালাম। প্রথমবার স্পেস স্টেশন দেখলাম, এত বিশাল! ল্যাবরেটরি, মহাকাশে নির্মিত আমাদের বাড়ি ছিল অবিশ্বাস্য! এটি সম্ভবত মহাকাশে থাকার আমার প্রথম স্মৃতিগুলোর একটি। কিন্তু মহাকাশে ভেসে বেড়ানোটা একটা দুর্দান্ত ব্যাপার!

জানালার বাইরে তাকিয়ে আমাদের সুন্দর গ্রহটা দেখা—এসব স্মৃতি আমি কখনো ভুলব না; বিশেষ করে দুপুরে খাবারের সময়। দারুণ রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার। এটাই সম্ভবত আমাদের মিশনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ ছিল। আমি নিশ্চিত, আমার হৃদ্‌যন্ত্রের কম্পন খানিকটা বেড়ে গিয়েছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা:

ভয় কাজ করেনি?

জোসেফ এম আকাবা: মনে হয় না। আমরা অবশ্য বেশ উত্তেজিত ছিলাম; বিশেষ করে (নভোযান) উৎক্ষেপণের সময়। সময়টা ছিল উত্তেজনা পূর্ণ। সম্ভবত এটি ছিল আমাদের মিশনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। আমি নিশ্চিত, আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ওটা আসলে ভয় নয়, উত্তেজনা। ধরুন, আপনার সব ধরনের প্রশিক্ষণ রয়েছে। আপনি মিশন পরিচালনার জন্য প্রস্তুত। স্বীকার করছি, প্রথম স্পেসওয়াকের জন্য যখন দরজার বাইরে গিয়েছি, তাঁরা দরজা খুলে দিলেন। এখন মহাকাশ স্টেশন থেকে মহাকাশে যাচ্ছি। প্রথম মিনিটে কিছুটা ভয় কাজ করছিল। তারপর আপনার প্রশিক্ষণের প্রয়োগ শুরু। যা শিখেছি, গিয়ে সে কাজ করা। তাই ভয়ের চেয়ে উত্তেজনাই ছিল বেশি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

স্পেসওয়াক সম্পর্কে বলছিলেন। স্পেসওয়াকের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিক ও আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

জোসেফ এম আকাবা: আমাদের করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোর একটি সম্ভবত স্পেসওয়াক। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টনে আমাদের বড় একটি সুইমিংপুল আছে। সেটায় মহাকাশ স্টেশনের একটি মডেল রয়েছে। আমরা যে হ্যান্ডরেইল (সিঁড়ির হাতল) ধরি, একই ধরনের সবই এতে রয়েছে। যে সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করব, তার সব রয়েছে। আসলে স্পেসওয়াকের আগে সেগুলো ব্যবহার করে বারবার প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

এসব প্রশিক্ষণ খুব সহায়ক, কিন্তু কঠিন। প্রশিক্ষণের সময় আমরা সকাল নয়টায় পানির নিচে যেতাম, আর বেলা ৩টায় পানির ওপর উঠে আসতাম। এভাবে প্রায় ছয় ঘণ্টা পানির নিচে থাকতাম, কোনো খাবার ছাড়াই। সামান্য পানি (খাওয়ার পানি) ছিল। এরপর বাস্তবে যখন স্পেসওয়াক করবেন, তখন আপনি জানেন যে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো সেই ছয় বা সাত ঘণ্টা ধরে প্রতিটি কাজে আপনার মনোযোগ দেওয়া। স্পেসওয়াকের সময় আসলে সেটাই করতে হয়।

আর এতে অনেক প্রস্তুতির দরকার। যখন কোনো কাজ পরিচালনা করতে হয়, তখন সে প্রস্তুতিই আপনাকে সফল করে তোলে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

মহাকাশ স্টেশনে থাকার সময় আপনি কোন ধরনের পরীক্ষা বা গবেষণায় যুক্ত ছিলেন?

জোসেফ এম আকাবা: আমাদের মহাকাশ ও মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার মূল কারণ বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম পরিচালনা করা।

সেই বিজ্ঞানের একটি অংশ হচ্ছে পৃথিবীতে জীবনকে উন্নত করবে, এমন কাজ করা। তাই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পৃথিবীতে কাজ করা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মহাকাশ স্টেশনে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাই, যাতে পৃথিবীতে আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারি। আমরা কীভাবে আরও অনুসন্ধান করতে পারি, সেটি কাজের আরেকটি বিষয়। যেমন আমরা কীভাবে চাঁদে-মঙ্গল গ্রহে যাওয়া শিখতে পারি, তা নিয়ে গবেষণা হয়।

আমার সবচেয়ে স্মরণীয় গবেষণাগুলোর একটি মহাকাশে উদ্ভিদ জন্মানো। সেটা মজার ছিল। একটি বীজ নিলাম, তারপর পানি দিলাম, আর উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা নথিভুক্ত করলাম। আমরা আসলেই তিন জাতের লেটুসগাছ জন্মাতে পেরেছি। সেগুলো চাষাবাদ করতে পেরেছি। তারপর সেগুলো খেয়েছি।

কিন্তু যখন আমরা চাঁদে যেতে চাই, মঙ্গল গ্রহে যেতে চাই, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করা শিখতে পারব। কাজেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা আরও অনেক গবেষণাই মহাকাশে করছি—মানবদেহ সম্পর্কে শেখা, কোষ নিয়ে কাজ করে নতুন ওষুধ তৈরি করা, যা আমরা পৃথিবীতে ব্যবহার করতে পারি।

কাজেই চমৎকার অনেক বৈজ্ঞানিক কাজ করেছি, যা নভোচারী হিসেবে আমাদের প্রাথমিক কাজ। আমরা পৃথিবীতে থাকা বিজ্ঞানীদের কান, চোখ ও হাত হিসেবে কাজ করি।

বিজ্ঞানচিন্তা: আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বসে গবেষণা করার বিষয়টি আপনার কেমন লাগে?

জোসেফ এম আকাবা: মহাকাশ স্টেশনে বৈজ্ঞানিক কাজ পরিচালনা করা দারুণ ব্যাপার। আপনি জানেন, প্রযুক্তি ও ওষুধ খাতে যারা সত্যিকার অগ্রগতি নিয়ে আসছে, এমন এক বিশাল দলের ছোট্ট একটি অংশ আপনি। একজন সাবেক স্কুলশিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ করেছি আমি। তাই মহাকাশে অবস্থান করা ও সেখানে যা হচ্ছে, তার অংশীদার হওয়াটা আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের। আমরা জানি যে মহাকাশে যা শিখছি, তা পৃথিবীর প্রত্যেকের উপকার করতে যাচ্ছে। এ ভাবনাটিই আমাদের আরও অনুসন্ধানের অনুপ্রেরণা দেয়।

বিজ্ঞানচিন্তা:

প্রথমবার ওজনহীনতা অনুভব করার অনুভূতি কেমন ছিল? আর মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে জীবনযাপন ও কাজ করার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অনুভূতিই-বা কেমন?

জোসেফ এম আকাবা: মহাকাশে যাওয়ার সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিষয়গুলোর একটি এটি। আপনি পৃথিবী থেকে যাত্রা করলেন, রকেটের মাধ্যমে পৃথিবী পেরিয়ে গেলেন। সে জন্য মাত্র ৮ দশমিক ৫ মিনিট সময় লেগেছিল আমাদের। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের অধীনতা ছাড়িয়ে আপনি এখন মহাকাশে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছেন। ওজনহীনতা অনুভব করছেন। এটাকে আমরা মহাকাশ শাটলে ‘মাইক্রোগ্র্যাভিটি পরিবেশ’ বলি।

স্পেস শাটলটি বেশ ছোট। তাই সেখানে থাকা কালে আপনার সিটবেল্ট বাঁধা। প্রথমবার যখন সিটবেল্ট খুলবেন, ভাসতে শুরু করবেন। দুর্দান্ত একটি বিষয়। তারপর মহাকাশ স্টেশনে প্রবেশের পর দেখবেন, এটা এক বিশাল গবেষণাগার। তখন আপনি স্টেশনের মডিউলজুড়ে ভাসতে পারবেন।

নিজেকে সুপারহিরো মনে হবে আপনার। কারণ, তখন আপনি উড়তে পারছেন। একবার আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, স্পাইডারম্যান পছন্দ করেন কি না। তাঁরা সবাই বললেন, হ্যাঁ, আমরা স্পাইডারম্যান পছন্দ করি। মহাকাশে গিয়ে আপনি মেঝে থেকে লাফ দিতে পারবেন। দেয়ালে ঝুলতে পারবেন। ছাদের দিকে লাফ দিতে পারবেন। আপনি নিজেই যেন সেখানে স্পাইডারম্যান!

এ সবই অবশ্য সেখানে খুব স্বাভাবিক মনে হয়। মানিয়ে নিতে শরীর প্রায় এক দিন সময় নেবে। এটাই পৃথিবীতে থাকার সঙ্গে এখানে (মহাকাশ স্টেশন) থাকার পার্থক্য। দু–এক দিনের মধ্যে মনে হবে, আমরা মহাকাশে থাকার জন্যই জন্মেছি। আপনি শিখে যাবেন, কীভাবে শরীর নড়াচড়া করতে হয়, কীভাবে ভেসে বেড়াতে হয়। সেখানে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করাটা চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়টি খুব দ্রুত করতে হয়। শরীরকে মানিয়ে নিতে হয়। আমরা মানুষেরা মহাকাশে বসবাস করা ও সেখানকার কাজগুলো সত্যিই ভালোভাবে করতে পারি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

নাসা ও অন্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো মঙ্গল গ্রহ অনুসন্ধানের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। আমরা দীর্ঘ দূরত্বের মহাকাশ ভ্রমণের চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে জয় করব বলে আপনি মনে করেন?

জোসেফ এম আকাবা: হ্যাঁ, দীর্ঘস্থায়ী মহাকাশ ভ্রমণ করতে গেলে আমরা অবশ্যই কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ব। আর্টেমিস প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আমরা চাঁদে ফিরে যাওয়ার জন্য কাজ করছি, যাতে একপর্যায়ে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছাতে পারি।

মঙ্গল গ্রহে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যাঁরা সেখানে কাজ করতে যাবেন, তাঁদের জীবন বাঁচানোর উপায়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। মঙ্গল গ্রহের যাত্রা প্রায় ছয় মাসের হতে যাচ্ছে। যেমনটা বলেছিলাম, যখন আমরা মহাকাশ স্টেশনে যাই, আট মিনিটে মহাকাশে পৌঁছে যাই। আর এক দিনের মধ্যে মহাকাশ স্টেশনে থাকি।

চাঁদে যেতে চাইলে তিন দিন সময় লাগে। কিন্তু মঙ্গলে যখন যাবেন, সেটা অনেক দূরে। বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হবে বিকিরণ, আর কীভাবে আমরা শরীরকে রক্ষা করতে পারি, সেটা। আমার মতে, এখানে আমাদের আরও কিছু কাজ বাকি আছে। আর এসব কাজ বেশ কঠিন।

কিন্তু আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন ধারণা এক করছি। আমি মনে করি, মানবজাতি হিসেবে চ্যালেঞ্জগুলো আমরা একসঙ্গে অতিক্রম করতে পারব। কাজটা খুব কঠিন হবে। কিন্তু আমি জানি, আমরা সেখানে পৌঁছাব।

বিজ্ঞানচিন্তা:

মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফেরার পর আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?

জোসেফ এম আকাবা: হ্যাঁ, পৃথিবীতে ফেরাটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। মহাকাশে থাকার সময় প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যায়াম করি আমরা। সেখানে এমন একটা ব্যায়ামের যন্ত্র রয়েছে, যা ওজন তোলার মতো অনুভূতি দেয়। প্রতিদিন ঘণ্টাখানেক এটা অনুশীলন করতাম। এটা মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় আমাদের পেশিগুলো শক্তিশালী রাখতে সহায়তা করে।

আমাদের একটি ট্রেডমিলও রয়েছে, মহাকাশে (মহাকাশ স্টেশন) দৌড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে বাঞ্জি কর্ড রয়েছে, যা আমাদের ট্রেডমিলের সঙ্গে ধরে রাখে, যাতে আমরা দৌড়াতে পারি। এ ছাড়া আমাদের একটি স্টেশনারি সাইকেল রয়েছে, যা হৃৎপিণ্ড ও রক্তসঞ্চালন ব্যবস্থার জন্য উপকারী এবং হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করে। মহাকাশ থেকে ফিরে যদি ব্যায়াম না করেন, তা আপনার পেশিশক্তি ও হাড়ের ঘনত্বের ওপর প্রভাব ফেলবে।

আপনি যখন পৃথিবীতে ফিরলেন, তখন ছয় মাস পর প্রথমবারের মতো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করবেন। মাথাটা খুব ভারী মনে হবে। হাত তোলা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আপনার মনে হবে, মানুষ পৃথিবীতে কীভাবে বাস করে? কাজেই একটি অভিযোজনকাল (মানিয়ে নেওয়ার সময়কাল) থাকে। তাই প্রথম কয়েকটা দিন কিছুটা কঠিন।

আমরা পৃথিবীতে ফিরে প্রথম ৪৫ দিন ব্যায়াম ও মানিয়ে নেওয়ার কাজ করি। এটা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

ক্যারিয়ারের পেছনে ফিরে যাঁরা মহাকাশচারী হতে বা মহাকাশ অনুসন্ধানে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাঁদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

জোসেফ এম আকাবা: আমার সবচেয়ে বড় পরামর্শ হলো, এমন পেশা খুঁজে বের করুন, যা আপনি সত্যিই ভালোবাসেন, যার প্রতি আপনার গভীর আগ্রহ রয়েছে। এরপর কঠোর পরিশ্রম করুন।

আপনি আপনার পেশাকে ভালোবাসেন, গভীর উত্সাহী হোন। এটা তখন আর কাজের মতো মনে হবে না। মনে হবে, আপনার যা ভালো লাগে, সেটাই করছেন। এমন লোকদের আমি বলব, নভোচারীর পেশা বেছে নিন। আমার পড়াশোনা ভূতত্ত্ব নিয়ে। আমাদের মধ্যে রয়েছেন ভূতত্ত্ববিদ, চিকিৎসক, পদার্থবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, পাইলটসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।

মহাকাশ অনুসন্ধানে আমাদের একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দল প্রয়োজন। তাই কোনো পেশাই অন্যটির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি যা করতে পছন্দ করেন, সেটাই মন দিয়ে করুন। কঠোর পরিশ্রম করুন। আর এ যাত্রাপথটা উপভোগ করুন, মজা করুন। প্রচুর সুযোগ রয়েছে। যদি সেটা জানেন, আপনিও মহাকাশে যেতে পারবেন।

আমরা সবাই প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী—আমরা সবাই একসঙ্গে অনুসন্ধানে নামি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বাইরে কি কারও নভোচারী হওয়ার সুযোগ আছে? থাকলে কোনো বাংলাদেশির ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটা কী?

জোসেফ এম আকাবা: অন্য দেশের নাগরিকদের নাসায় কাজ করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তবে নাসার মহাকাশচারী হতে আপনাকে অবশ্যই মার্কিন নাগরিক হতে হবে। কিন্তু নাসায় আরও অনেক চাকরি আছে, যেখানে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের নাগরিকদের নিয়োগ দিই। তাই কাজের অনেক সুযোগ আছে। তবে বেসরকারি মহাকাশচারীদের জন্য আরও বেশি সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অন্যান্য দেশও তাদের নাগরিকদের মহাকাশে পাঠানোর জন্য কাজ করছে।

আমি বিশ্বাস করি, আরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি কোনো শিক্ষার্থী নভোচারী হতে আগ্রহী হন, তাঁদের জন্য এটা একটা রোমাঞ্চকর সময়। আবারও বলছি, এমন কিছু করুন, যেটা আপনি ভালোবাসেন। আপনি হয়তো জানেন না, কখন সে সুযোগ তৈরি হয়ে যাবে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

তাহলে বাংলাদেশিদের জন্য নাসায় নভোচারী হওয়া বাদে আর কী সুযোগ রয়েছে, যদি ব্যাখ্যা করে বলতেন।

জোসেফ এম আকাবা: আমি কিছু সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করেছি, যাঁরা নাসা চ্যালেঞ্জেস প্রোগ্রামের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁরা সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। খুব ভালো করছেন। পুরস্কার জিতে নিয়েছেন, নিচ্ছেন। কিন্তু যখন আপনি নাসার সব কাজ দেখবেন, সেখানে অনেক সুযোগ রয়েছে।

আশা করি, নাসা ও অন্যদের সঙ্গে একটি অংশীদার হতে পারে আপনার দেশ। সামগ্রিকভাবে আর্টেমিস প্রোগ্রামের অংশ হতে পারে। সবার সঙ্গে আমি আশা করছি, আপনার দেশের শিক্ষার্থীদের আরও সুযোগ তৈরি হবে।

*সাক্ষাৎকারটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত