পৃথিবী থেকে মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্ত সুদীর্ঘ টাওয়ার। কিংবা বলতে পারেন, স্পেস এলিভেটর। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বা চাঁদের কক্ষপথে ভবিষ্যতে নির্মিত কোনো গবেষণাকেন্দ্রে কিছু পাঠাতে চাইলে এই এলিভেটরের সাহায্য চট করে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। এরকম স্পেস এলিভেটর মানুষের কল্পনায় ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। দেখা গেছে বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন, অর্থাৎ কল্পবিজ্ঞানের মুভি বা গল্পে। কিন্তু আজও এরকম কোনো টাওয়ার বানাতে পারেনি মানুষ, বানাতে পারেনি কোনো স্পেস এলিভেটর বা লিফট। কেন?
সে কথা বলার আগে একটা গল্প বলা যাক। প্রাচীন ব্যবিলনের সেই টাওয়ারের গল্পটা জানেন? এ গল্প মতে, প্রাচীন ব্যবিলনের মানুষ ভেবেছিল একটা টাওয়ার বানাবে। সেই টাওয়ার দিয়ে ছুঁয়ে ফেলবে আকাশ। মানুষ ভাবত, নীল আকাশের ওপারেই স্বর্গ। তাই টাওয়ার বানালে সেখানে পৌঁছাতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
একদিন লোকজন ইট-পাথর আনতে গিয়েছিল। টাওয়ারের কাছে এসে ওরা টের পেল, কেউ আর কারো কথা বুঝতে পারছে না। সর্বশক্তিমান একেকজনকে একেক ভাষা শিখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেউ কথা না বুঝলে টাওয়ারের কাজ কীভাবে এগোবে! ভেস্তে গেল টাওয়ার বানানো। স্বর্গ আকাশের ওপারে অধরাই রয়ে গেল। আর এদিকে, মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল নানা ধরনের ভাষা।
স্পেস এলিভেটর মানুষের কল্পনায় ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। দেখা গেছে বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন, অর্থাৎ কল্পবিজ্ঞানের মুভি বা গল্পে। কিন্তু আজও এরকম কোনো টাওয়ার বানাতে পারেনি মানুষ, বানাতে পারেনি কোনো স্পেস এলিভেটর বা লিফট। কেন?
গল্পটা বাংলা ব্যাকরণ বইতে ছিল, ভাষার উৎপত্তি নিয়ে। এই গল্পের অনেক ফাঁক-ফোঁকর আছে। চাইলেই গল্পটা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু সেসব প্রশ্ন তোলা বা গল্পের সত্যতা নির্ণয় এখানে উদ্দেশ্য নয়। বরং এ গল্প শুনে বোঝা যায়, এরকম স্পেস এলিভেটর বা টাওয়ার বানানোর কল্পনা ইদানীংকার নয়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই।
শুধু কল্পগল্পেই নয়, বাস্তবেও মানুষ এরকম চেষ্টা করেছে। রকেট বিজ্ঞানের রুশ জনক কনস্ট্যান্টিন জাল্কোভস্কির ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত নিবন্ধ সংকলন ড্রিমস অব আর্থ অ্যান্ড স্কাইতে দেখা যায়, তিনি একটি বিশাল আকাশ-সিঁড়ির কথা ভেবেছেন মহাকর্ষের বাধা পেরিয়ে নক্ষত্র বা মহাকাশে পৌঁছানোর জন্য।
১৯৬০ সালে রুশ প্রকৌশলী ইয়ুরি আর্টসুটানভ একইরকম একটি ধারণা দিয়েছেন। এটাকে তিনি বলেছেন ‘কসমিক রেলওয়ে’ বা মহাজাগতিক রেল-যোগাযোগব্যবস্থা। তাঁর হিসেবে, পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণমান একটি কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে দড়ির মতো কিছুর একপ্রান্ত যুক্ত থাকবে, যেটার অন্য প্রান্তটি যুক্ত থাকবে বিষুবরেখার এখানে কোথাও। এই দড়ি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস পাঠানো যাবে মহাকাশে।
এই ধারণা নিয়ে আরও কাজ হয়েছে। বিখ্যাত মার্কিন কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক এ নিয়ে কংগ্রেসের সামনে বক্তব্য রেখেছেন। নাসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্স রিসার্চ ল্যাবরেটরির কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এর ধারণাগত নকশা তৈরি করেছেন প্রকৌশলী জেরোম পিয়ারসন, ১৯৭৫ সালে। তিনি অবশ্য একে বলেছেন ‘অরবিটাল টাওয়ার’। এ জন্য তিনি চাঁদের মহাকর্ষ, বায়ু, গতিশীল ‘পেলোড’ বা ভারসহ আরও নানা বিষয় মাথায় রেখেছেন। তবে বহু গবেষণা, পরিকল্পনা শেষে আজও স্পেস এলিভেটর কল্পবিজ্ঞানের বিষয় হয়েই রয়েছে, বাস্তব হয়নি। শুরুর সেই প্রশ্নটায় আবার ফিরে এলাম আমরা—কেন?
আসলে, অত বড় বা লম্বা কিছু নির্মাণের সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো পৃথিবীর মহাকর্ষ। আজ পর্যন্ত এমন কোনো পদার্থের খোঁজ পাওয়া যায়নি, যেটা দিয়ে এত লম্বা কিছু বানালে তা নিজের ভারে মুখ থুবড়ে বা ভেঙে পড়বে না। এই মহাকর্ষের কারণেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ২৯ হাজার ৩৫ ফিট। এর চেয়ে বড় হলে নিজের ভারেই সেটা ভেঙে পড়ে। সে সমস্যা এড়াতে দড়ির মতো কিছুর কথা ভাবা, যে কথা আগেই বলেছি।
ভাবনাটা এখন পর্যন্ত ওরকমই—পৃথিবীর কক্ষপথে একটা কৃত্রিম উপগ্রহ ঘূর্ণমান থাকবে। এই উপগ্রহে যুক্ত থাকবে দড়ির একটা মাথা। অন্য মাথাটা যুক্ত থাকবে পৃথিবীর বিষুব অঞ্চলে।
উপগ্রহটা থাকতে হবে ভূস্থির কক্ষপথ থেকে অনেকটা ওপরে। ফলে দড়িটার ভরকেন্দ্র থাকবে ভূস্থির কক্ষপথের ওপরে। ভূস্থির কক্ষপথ মানে, পৃথিবীর নিজ কক্ষপথে ঘোরার হার আর এ কক্ষপথে ঘূর্ণমান উপগ্রহের বেগ একসমান হয়। ফলে পৃথিবীর সাপেক্ষে ওই কক্ষপথের উপগ্রহটা একই জায়গায় থাকে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার ওপরে রয়েছে এই ভূস্থির কক্ষপথ। এ কক্ষপথে বর্তমানে অনেক স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ঘুরছে—এর কোনোটা জিপিএস স্যাটেলাইট, কোনোটা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখছে ইত্যাদি। যাহোক, দড়ির ভরকেন্দ্র এই কক্ষপথের ওপরে থাকলে যথেষ্ট পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্রবিমুখী বল তৈরি হবে, যা নিম্নমুখী পৃথিবীর মহাকর্ষের সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করবে। ফলে দড়িটা টানটান থাকবে।
এই দড়ি—ইংরেজিতে যাকে বলে কেবল বা টেদার—হতে হবে অত্যন্ত চিকন, কিন্তু প্রচণ্ড শক্ত। ভারী কোনো ভার যেন এতে করে ওঠানো যায় যান্ত্রিকভাবে। পাশাপাশি, এটা যেন ছিঁড়ে না যায়। বর্তমানে, গ্রাফিন ও কার্বন ন্যানোটিউব দিয়ে এ ধরনের দড়ি বানানো যাবে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাত্ত্বিকভাবে সেটা সম্ভব হতে পারে, তবে সে জন্য এত বেশি কার্বন দরকার যে সেটা হয়ে উঠবে পরবর্তী বড় সমস্যা।
স্পেস এলিভেটরকে সম্ভব করে তোলার জন্য বহু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়েছে। সম্প্রতি এরকম এক প্রতিযোগিতায় প্যারিসের জ্যাকোয়া রোগারি ফাউন্ডেশন ব্রিটিশ স্থপতি জর্ডান উইলিয়াম হিউকে ১১ হাজার ডলারের পুরস্কার দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে বিবিসির এক রিপোর্টে। কিন্তু সেই রিপোর্টেই জানা যাচ্ছে, তাঁর এটাও কেবলই ধারণাগত নকশা। অতি সম্প্রতি স্পেস এলিভেটর সংশ্লিষ্ট সব সমস্যা কাটিয়ে উঠে আদৌ অমন কিছু নির্মাণ করা সম্ভব বলে ভাবছে না কেউই।
সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, বিবিসি, উইকিপিডিয়া