গ্যাসদানবের ৪০ বছর পুরোনো মেরুজ্যোতির রহস্য উদঘাটন!

স্পেস ডট কম

ষাটের দশক। চারদিকে টানটান উত্তেজনা। গল্পের শুরুর নায়ক নাসা জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির (জেপিএল) অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার গ্যারি ফ্লান্দ্রোর। তিনি আবিষ্কার করেন, সত্তরের দশকের কোনো এক সময়ে সৌরজগতের গ্যাসদানব গ্রহগুলো এমন এক অবস্থানে আসবে, যার মহাকর্ষ শক্তি ব্যবহার করে মহাকাশের দূরবর্তী স্থানে স্লিংশটের (গ্রহ বা উপগ্রহের মহাকর্ষকে কাজে লাগিয়ে নভোযানের গতি বাড়ানো) মাধ্যমে খুব কম জ্বালানি খরচ করে মহাকাশযান পাঠানো সম্ভব হবে। পরবর্তিতে গ্রহগুলোর এমন অবস্থান পেতে গবেষকদের অপেক্ষা করতে হবে আরও ১৭৫ বছর!

এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি না হওয়ায় নাসার গবেষকরা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সৌরজগতের দূরবর্তী গ্রহগুলোকে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রথমবারের মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

কিছুদিনের মধ্যে ভয়েজার ১ পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের পথে যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃহস্পতি ও শনিকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা। ১৯৭৯ সালে পৃথিবী থেকে উড্ডয়নের দুই বছর পর বৃহস্পতির মাত্র কয়েক লাখ কি.মি. ওপর দিয়ে উড়ে যায় মহাকাশযানটি। কোনো মহাজাগতিক বস্তু, যেমন গ্রহ, উপগ্রহ বা বামন গ্রহ ইত্যাদির পাশ দিয়ে এভাবে মহাকাশযানের উড়ে যাওয়াকে বলে ফ্লাইবাই। এই ফ্লাইবাইয়ের সময় প্রথমবারে মতো সৌরজগতের দানব গ্রহটিকে এত কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায় মানব সম্প্রদায়। অনেক নতুন বিষয় আবিষ্কৃত হয়, সঙ্গে রেখে যায় বেশ কিছু রহস্য। ভয়েজারের ছবি থেকে জানা যায়, বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে বয়ে চলা বিশাল বিশাল ঝড়, কিংবা তাকে ঘীরে থাকা বলয়ের কথা! উপগ্রহ আইয়ো সম্পর্কে চমৎকার সব তথ্য মেলে। কিন্তু বৃহস্পতির রহস্য উন্মোচনে গবেষকরা সবচেয়ে বড় গোলকধাঁধায় পড়েন গ্রহটিকে ঘিরে থাকা মেরুজ্যোতি নিয়ে, ভয়েজারের চোখে যা ছিল সরু রিং আকৃতির আলো। এটা দেখতেও ঠিক পৃথিবীর মেরুজ্যোতির মতো। এরপর হাবল টেলিস্কোপ মানবচোখে অদৃশ্য উচ্চ শক্তির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ছবি তুলতে সক্ষম হয়, যা পৃথিবীর মেরুজ্যোতির চেয়ে হাজার গুণে বড় ও বিশাল ক্ষমতাসম্পন্ন! পরবর্তীতে এক্স-রে টেলিস্কোপ প্রমাণ করে পৃথিবীর মেরুজ্যোতির সঙ্গে এর অনেকটা মিলের কথা। কিন্তু এত বড় গ্রহে কীভাবে মেরুজ্যোতি তৈরী হওয়া সম্ভব, তা নিয়ে গত চার দশক ধরে গবেষকরা ধোঁয়াশায় রয়ে গেছেন। মূল গল্পে প্রবেশের আগে মেরুজ্যোতি কী, এ নিয়ে ছোট্ট করে জেনে নেওয়া যাক!

বায়ুমণ্ডলে আলোর রংবেরঙের আলোকচ্ছটার খেলা জ্বলজ্বল করে উড়ে বেড়ানোর চিত্র আমরা সবাই দেখেছি। এমন বর্ণময় মেরুজ্যোতির কারণ, সূর্য থেকে সংঘটিত সৌরঝড় বা সোলার ফ্লেয়ার।
হাবল টেলিস্কোপের সঙ্গে চন্দ্রা এক্স-রে টেলিস্কোপের অপটিক্যাল ছবি একত্র করে এক্স-রে অরোরার পর্যবেক্ষণ
নাসা/জেপিএল

মেরুজ্যোতি কী? পৃথিবীতে কীভাবে উৎপন্ন হয়?

ইংরেজিতে নর্দান লাইটস, পোলার লাইটস বা অরোরা ইত্যাদি বিভিন্ন শব্দকে আমরা বাংলায় বলি মেরুজ্যোতি বা উষাপ্রভা। বায়ুমণ্ডলে আলোর রংবেরঙের আলোকচ্ছটার খেলা জ্বলজ্বল করে উড়ে বেড়ানোর চিত্র আমরা সবাই দেখেছি। এমন বর্ণময় মেরুজ্যোতির কারণ, সূর্য থেকে সংঘটিত সৌরঝড় বা সোলার ফ্লেয়ার। এ সময় বিভিন্ন কণা নির্গমনের হার অনেক বেড়ে যায়। সূর্য থেকে নির্গত এই ঝড়ের প্রবাহে থাকে বিভিন্ন চার্জিত কণা, যেমন, ইলেকট্রন, প্রোটন কিংবা আলফা কণা। সৌরজগতের বুধ, শুক্রকে পাড়ি দিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছায় এই চার্জিত কণার স্রোত। কিন্তু পৃথিবীর বিশাল চৌম্বকক্ষেত্র ভূপৃষ্ঠে আঘাতের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সাথে সৌরঝড়ের সংঘর্ষ
এনিস্কুওলা ডট নেট

পৃথিবীতে উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত এই অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্র ক্ষতিকর সব কণা থেকে জীবজগতকে রক্ষা করে আসছে। নাহলে হয়তো এমন এক ঝড়ের ঝাপটাই পৃথিবীর সব প্রাণ ধ্বংস করে ফেলত মুহূর্তে।

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বেশ খানিকটা সরু ও অপেক্ষাকৃত দূর্বল। যার দরুণ সৌরঝড়ের চার্জিত কণাগুলো বায়ুমণ্ডলের ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের কাছাকাছি চলে আসে। তখন বায়ুমণ্ডলে থাকা নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের সঙ্গে আয়নিত কণার সংঘর্ষ হয়। এ সময় প্রচুর শক্তি বিকিরিত হয়, যা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে হতে পারে। আমরা দৃশ্যমান আলোর হিসেবে যেটুকু দেখতে পাই, তাও বিভিন্ন বর্ণের সংমিশ্রণ।

পৃথিবীর মতো সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহে মেরুজ্যোতির দেখা মেলে। গবেষকরা সৌরজগতের সাতটি গ্রহে মেরুজ্যোতির চিহ্ন পেয়েছেন, যার মাঝে কিছু কিছু মানব চোখেও দৃশ্যমান। বাকিগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য শক্তিশালি টেলিস্কোপের প্রয়োজন হয়। সৌরজগতের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী মেরুজ্যোতি রয়েছে বৃহস্পতিতে। আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ হিসেবে বিষয়টা অবশ্য অবাক করা কিছু নয়।

কিন্তু সৌরজগতের চার দানব গ্রহের মধ্যে শুধু বৃহস্পতিকে মেরুজ্যোতিতে এক্স-রে নির্গত করতে দেখা গিয়েছে! এছাড়া অতিবেগুনী মেরুজ্যোতিও নির্গত হয় গ্রহটি থেকে।

তাহলে বৃহস্পতির মেরুজ্যোতি রহস্যময় কেন?

বৃহস্পতির মেরুজ্যোতি পৃথিবীর মতো স্বাভাবিক নয়। ১৯৭৯ সালে ভয়েজার ১-এর এই অদ্ভুত মেরুজ্যোতির আবিষ্কারের পর থেকে গবেষকদের মাঝে সাড়া পড়ে গেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু গবেষকরা নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি কিছুদিন আগ পর্যন্তও।

নাসা বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করেছিল, "আমরা এখনও জানি না বৃহস্পতির এক্স-রে মেরুপ্রভা তৈরীতে কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন। শুধু এটা জানি, মেরুজ্যোতির আলো বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে চার্জিত কণার সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন হয়। কিন্তু গবেষকদের কোনো ধারণাই ছিল না, কীভাবে চার্জিত আয়ন ও বায়ুমণ্ডলের সংঘর্ষে এক্স-রে মেরুজ্যোতি তৈরী হতে পারে।

পৃথিবীতে মেরুজ্যোতি চৌম্বকক্ষেত্রের দুই দিক, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে দেখা যায়, ৬৫ এবং ৮০ ডিগ্রী অক্ষাংশের মধ্যে। ৮০ ডিগ্রি অক্ষাংশের বাইরে মেরুজ্যোতির আলোর খেলা হারিয়ে যায়, কারণ চৌম্বকক্ষেত্রের রেখাগুলো পৃথিবীর বাইরে চলে যায়, যেখানে সৌরঝড়ের সঙ্গে চৌম্বকক্ষেত্রের রেখার সংযোগ ঘটে। বৃহস্পতির মেরুজ্যোতি এক্ষেত্রে অনেক ভিন্ন। বৃহস্পতির মেরুজ্যোতি দুই মেরুর প্রধান মেরুরেখায় অবস্থিত, পৃথিবীর মতো নির্দিষ্ট অবস্থান মেনে চলে না, আবার দুই মেরুর মেরুজ্যোতির মধ্যে কোনো মিলও দেখা যায় না। সময় ভেদে দুই মেরুতে আলাদা আলাদা দৃশ্যের দেখা মেলে! যেমনটা পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায় না কখনো।

বিজ্ঞানীরা এ ঘটনাকে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে গবেষণা করছেন। তাঁরা দেখতে পান, এই স্পন্দিত এক্স-রে মেরুজ্যোতি বৃহস্পতির ভেতরে লুপ আকৃতির চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্র বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যা এর অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট বা গ্রহাণু বেষ্টনী এবং অন্যান্য গ্রহতেও প্রভাব ফেলে। তার ওপর, দুই মেরুর চৌম্বকক্ষেত্রের রেখাগুলো বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে মহাকাশে মিলিয়ন মাইল জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু কীভাবে প্রমাণ করা যায় মডেলটি আসলেই কার্যকর?"

৪০ বছর পর রহস্যের জট উন্মোচন

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ULC) ও চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের একদল গবেষক ভয়েজারের রেখে যাওয়া ৪০ বছর পুরোনো এই রহস্যের প্রকৃত কারণ উৎঘাটন করেন। গবেষকদের বিশাল সময়ের পরিশ্রম, পর্যবেক্ষণ ও ডেটা বিশ্লেষণের ফল এটা। সঙ্গে বৃহস্পতিতে কীভাবে প্রতি মিনিটে এক্স-রে বিস্ফোরণ হয়, তা দীর্ঘ গবেষণার পর সমাধান করতে সক্ষম হন তাঁরা।

বৃহস্পতির এক্স-রে মেরুজ্যোতি মূলত বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে বিভিন্ন চার্জিত কণার মিথস্ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয়। সূর্যের সৌরঝড় এখানে মূখ্য নয়। চার্জিত কণার সংঘর্ষের বিষয় পৃথিবীতেও ঘটে, সৌরঝড়ের সময় আমরা দুই মেরুতে নর্দান লাইট বা মেরুজ্যোতি দেখি। তবে বৃহস্পতির মেরুজ্যোতি পৃথিবী থেকে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। প্রতি মুহূর্তে শত গিগাওয়াট শক্তি বা বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, যা আমাদের মানব সভ্যতার সব কিছুকে চালানোর জন্য যথেষ্ট।

গবেষণায় বৃহস্পতি গ্রহটিকে ঘিরে প্রদক্ষিণরত নাসার স্যাটেলাইট 'জুনো' এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইসা) এক্সএমএম-নিউটন মানমন্দিরের টেলিস্কোপ দিয়ে নিয়মিতভাবে গ্রহটির এক্স-রে পরিমাপ করা হয়। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বৃহস্পতিকে ২৬ ঘন্টা ধরে গভীর পর্যবেক্ষণ করার পর বিশ্লেষণ করা হয় প্রাপ্ত ডেটা। যেখানে দেখা যায়, বৃহস্পতির এক্স-রে মেরুজ্যোতি প্রতি ২৭ মিনিট পরপর স্পন্দিত হয়। যা এই সিদ্ধান্তে নিয়ে আসে যে, চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তনের ফলে বৃহস্পতিতে মেরুজ্যোতি উৎপন্ন হয়।

বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্রের রেখার নিয়মিত স্পন্দনের ফলে এক্স-রে শিখা ট্রিগারড হচ্ছিল। এই স্পন্দনের ফলে তৈরী হয় প্লাজমার তরঙ্গ (আয়োনিত গ্যাস)। যেখান থেকে প্রেরণ করা ভারী আয়নিত কণা চৌম্বকক্ষেত্রের রেখা বরাবর ভেসে বেড়ায় যতক্ষণ না বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এই সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন শক্তি এক্স-রে আকারে নির্গত হয়।

গোলাপি দেখতে অংশটা বৃহস্পতির নর্দান লাইট বা মেরুজ্যোতি
নাসার চন্দ্র এক্স-রে মানমন্দির/জুনো ওক/ইউলিয়াম ডান

গবেষক ড. ইউলিয়াম ডান জানান,

"বৃহস্পতির এক্স-রে মেরুজ্যোতি উৎপন্ন হওয়ার চিত্র আমরা গত চার দশক ধরে দেখে আসছি। কিন্তু আমরা জানতাম না এটা কীভাবে সংঘটিত হতো। শুধু জানতাম, এই মেরুজ্যোতি গ্রহটিতে আয়নিত কণা ও বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে তৈরী হয়।

আমরা এখন জানি, এই আয়ন প্লাজমা তরঙ্গ দ্বারা পরিবাহিত হয়। এই ব্যাখ্যা এর আগে কখনও কেউ চিন্তাও করেননি। যদিও এর সঙ্গে পৃথিবীর মেরুজ্যোতির অনেক মিল রয়েছে। মেরুজ্যোতির এই ধরন হয়তো একটা সার্বজনীন ঘটনা৷ হতে পারে, এমনটা মহাবিশ্বের সকল জায়গায় উপস্থিত।"

চার্জিত কণার উৎপত্তি

বৃহস্পতির বায়ুমন্ডলের সঙ্গে যেসব আয়নিত চার্জিত কণার সংঘর্ষ হয়, তা গ্রহটির নিজস্ব কোনো অংশ না। বরং চার্জিত কণাসমূহ আসে বৃহস্পতির উপগ্রহ আইও-এর বিশাল আগ্নেয়গিরিতে উৎপন্ন গ্যাস (সালফার ও অক্সিজন) থেকে। যা উপগ্রহটি থেকে তীব্র বেগে নিয়মিতভাবে মহাকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এগুলো বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার পর এই গ্যাস আয়োনিত হয় (পরমাণু ইলেকট্রন মুক্ত হয়) এবং গ্রহটিকে ঘিরে ডোনাট আকৃতিতে প্লাজমা ঘুরতে থাকে।

প্রথমবারের মতো জোতির্বিদরা বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্র কীভাবে সংকুচিত হয়, তা দেখতে পান। পৃথিবীর মতো বৃহস্পতিও ঘোরে এবং চৌম্বকক্ষেত্রকে সঙ্গে নিয়ে যায়। সৌরআয়ন সরাসরি চৌম্বকক্ষেত্রে আঘাত করে। চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে আটকে থাকা উত্তপ্ত কণার সংকোচন ট্রিগার করে, যাকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক আয়ন সাইক্লোট্রন (ইএমআইসি) বলে। এটা কণাকে চৌম্বকক্ষেত্রের রেখা বরাবর পরিচালিত করে। ইএমআইসি রেখার মধ্য দিয়ে আয়ন এরপর বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং এক্স-রে মেরুজ্যোতির সৃষ্টি করে। মিলিয়ন মিলিয়ন কিলোমিটার জুড়ে বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্র বিস্তৃত থাকায় আয়নসমূহ পৌঁছাতে সময় নেয়। এজন্য বৃহস্পতিতে মেরুজ্যোতি দুই মেরুতে ভিন্ন সময়ে দেখা মেলে। এই বিষয়টা নাসার জুনো ও ইসার এক্স-রে স্যাটেলাইটের সম্মিলিত পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।

অন্যান্য স্থানে মেরুজ্যোতির ব্যাখ্যা

মেরুজ্যোতির এই মৌলিক প্রক্রিয়া আগামী গবেষণাগুলোতে বেশ কাজে দেবে। হয়তো একই দৃশ্য শনি (উপগ্রহ এনসেলাডাস থেকে উৎপন্ন মেরুজ্যোতি হতে পারে), ইউরেনাস, নেপচুন এবং এক্সোপ্ল্যানেট বা সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোতেও দেখা মিলতে পারে, যেখানে বিভিন্ন চার্জিত কণা তরঙ্গাকারে গ্রহকে ঘিরে ভেসে বেড়াচ্ছে।

তাছাড়া এক্স-রে মূলত উৎপন্ন হয় মহাবিশ্বের অত্যন্ত শক্তিশালী ও বিরূপ ঘটনা যেমন, ব্ল্যাকহোল বা নিউট্রন তারা থেকে। তাই গ্রহ থেকে উৎপন্ন হওয়াটা একটু আশ্চর্যজনক লাগতে পারে। আমরা কখনই হয়তো ব্ল্যাকহোলের ভেতরে যেতে পারব না। এটা সম্ভব না। কিন্তু বৃহস্পতি হতে পারে এই আশ্চর্যময় অবস্থা নিয়ে জানার জন্য আমাদের প্রথম ধাপ।

গবেষকরা এই গবেষণায় 'জুনো' স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্লাজমা তরঙ্গ শনাক্ত করেন। আর এক্সএমএম-নিউটন টেলিস্কোপ দিয়ে রেকর্ডকৃত বৃহস্পতির উত্তর মেরুতে এক্স-রে মেরুজ্যোতির শিখার মধ্যে তাঁরা একটা স্পষ্ট মিল খুঁজে পেয়েছেন। এরপর তারা কম্পিউটার মডেল তৈরি করে নিশ্চিত হন, তরঙ্গগুলো ভারী কণাসমূহকে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলের দিকে প্রবাহিত করে।

তবে চৌম্বকক্ষেত্রের রেখাগুলোর নিয়মিত কম্পনের কারণ এখনও অস্পষ্ট। হতে পারে এটা বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে সৌরঝড়ের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া কিংবা উচ্চ গতিতে প্লাজমা প্রবাহের ফল।

বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। পৃথিবীর চেয়ে এটি প্রায় ২০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। তাই এর চৌম্বকক্ষেত্র একটা বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃর্ণ। পৃথিবীতে যদি রাতের আকাশে এই মেরুজ্যোতি দৃশ্যমান হতো, তাহলে আমাদের চাঁদের আয়তনের কয়েকগুণ বড় এলাকা জুড়ে এক মনোরম দৃশ্যের দেখা মিলত।