আমাদের অনেকেরই রাতের অনেকটা সময় কেটে যায় আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ দেখে। চাঁদ নিয়ে আমাদের কত স্মৃতি! হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী বলেই। মাত্র ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে এটি। তবে ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, চাঁদ প্রায়ই রং বদলায়। রঙের ওপর নির্ভর করে আমরা চাঁদকে বিভিন্ন নামে ডাকি। যেমন হার্ভেস্ট মুন, ব্লাড মুন, ব্লু মুন ইত্যাদি।
তবে চাঁদের এই রং পরিবর্তন কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য নয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও আলোর প্রতিফলনের কারণে এমনটা ঘটে। চাঁদ নিজে কোনো আলো উৎপন্ন করে না, এটি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে। তবে সূর্যের আলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে পৌঁছায় এবং তা আমাদের চোখে এসে লাগে, তখন আলো নানাভাবে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনই চাঁদের রঙের ভিন্নতার মূল কারণ।
চাঁদ সাধারণত ধূসর বা সাদা দেখায়। তবে মাঝে মাঝে এর হলুদ, কমলা, লাল, নীল, এমনকি সবুজ রঙের রূপও দেখা যায়। চাঁদের রং মূলত নির্ভর করে চাঁদ কোথায় রয়েছে এবং আমরা এটি কোন কোণ থেকে দেখছি, তার ওপর। যেমন চাঁদ দিগন্তের কাছে থাকলে কমলা বা লাল রঙের দেখায়। কারণ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঘন স্তর অতিক্রম করে আমাদের চোখে এসে পড়লে নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি ছড়িয়ে পড়ে। একই কারণে লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছড়ায় কম। এই প্রক্রিয়ার নাম র্যালে বিক্ষেপণ।
র্যালে বিক্ষেপণ শুধু চাঁদের রঙের ক্ষেত্রে নয়, সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের সময় আকাশের রং পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও কার্যকর। চাঁদ যখন দিগন্ত থেকে অনেক ওপরে থাকে, তখন এটি তুলনামূলকভাবে সাদা বা ধূসর রঙের দেখায়। কারণ, তখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে আলো কম অতিক্রম করে। ফলে আলো তেমন পরিবর্তিত হয় না।
বলে রাখা ভালো, র্যালের বিক্ষেপণ একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। যেখানে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বায়ুমণ্ডলের কণাগুলোর চেয়ে অনেক বড় হলে সেই আলো বিভিন্ন রঙে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সূর্যের আলো, বায়ুমণ্ডলের অণু এবং কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া ঘটে। আকাশের নীল রং ও সূর্যাস্তের সময় লাল রং দেখা যায় এ কারণেই। সূর্যের আলো সাদা, মানে দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সব কটি আলোর মিশ্রণ। যখন এই আলো বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের মতো ছোট অণুগুলো ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (নীল ও বেগুনি) বেশি ছড়ায়। তবে লাল ও কমলা রঙের মতো তুলনামূলক দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো কম ছড়ায়।
এই প্রক্রিয়ার কারণেই দিনের বেলা আকাশ নীল দেখায়। নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হওয়ায় এটি বায়ুমণ্ডলের কণাগুলোর মাধ্যমে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আমরা আকাশ দেখি নীল। তবে সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের আলোকে বায়ুমণ্ডলের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার সময় ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল ও বেগুনি আলো সম্পূর্ণ ছড়িয়ে যায়। আর আমাদের চোখে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল ও কমলা আলো এসে পৌঁছায়। তাই সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময় আকাশ ও সূর্যের রং লাল বা কমলা দেখায়।
চাঁদ যখন দিগন্তের কাছাকাছি থাকে, তখন সূর্যের আলো পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়। এ সময়েও নীল আলো বেশি ছড়িয়ে যায় এবং দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল ও কমলা আলো বেশি দৃশ্যমান হয়। ফলে চাঁদ দিগন্তের কাছে লাল বা কমলা রঙের দেখায়।
এই প্রক্রিয়াটি আমাদের চারপাশের প্রকৃতিকে নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে। এটি শুধু আকাশ বা সূর্যের রং নয়, বরং চাঁদের রং পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। র্যালে বিক্ষেপণ প্রকৃতির একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা সৌন্দর্য এবং বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটায়।
তবে চাঁদের বিশেষ রঙিন চেহারা সবচেয়ে ভালো দেখা যায় পূর্ণিমার সময়। পূর্ণিমার চাঁদ যখন দিগন্তের কাছাকাছি থাকে, তখন এটি কমলা বা লাল রং ধারণ করে। আবার বিশেষ পরিস্থিতিতে চাঁদ নীল বা সবুজ রঙেরও দেখাতে পারে। বায়ুমণ্ডলে প্রচুর ধূলিকণা বা ধোঁয়া থাকলে এমন পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা বড় কোনো দাবানলের সময় বায়ুমণ্ডলে ধোঁয়া বেড়ে যায়। এই ধূলিকণা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে ভিন্নভাবে প্রতিফলিত করে এবং চাঁদকে রাঙিয়ে দেয় অস্বাভাবিক রঙে। ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পর প্রায় দুই বছর সেই অঞ্চলে চাঁদ সবুজাভ নীল রঙের দেখা গিয়েছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে নীল চাঁদ অত্যন্ত বিরল।
চাঁদ আবার মাঝেমধ্যে গোলাপি বা লাল রঙের দেখায়। একে বলে ‘ব্লাড মুন’। সাধারণত পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের এমন রং দেখা যায়। পৃথিবী যদি সূর্য ও চাঁদের মাঝে অবস্থান করে এবং সূর্যের আলো চাঁদে পৌঁছাতে বাধা দেয়, তাহলে চন্দ্রগ্রহণ হয়। এই সময় সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে চাঁদে পৌঁছায় এবং ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (নীল ও বেগুনি) বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল আলো চাঁদে প্রতিফলিত হয়।
বায়ুমণ্ডলের অবস্থান, চাঁদের উচ্চতা, পরিবেশগত অবস্থা, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীর দৃষ্টিশক্তির ওপর ভিত্তি করে চাঁদের রং ভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে।
‘হারভেস্ট মুন’ সাধারণত হলুদ বা কমলা রঙের দেখায়। চাঁদ দিগন্তের কাছাকাছি থাকলে চাঁদের আলোকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। তখন কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, আর দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হলুদ বা কমলা আলো আমাদের চোখে ধরা দেয়।
এ ছাড়া, চাঁদের রং নিয়ে মানুষের ব্যাখ্যা বা অনুভূতিতেও থাকে ভিন্নতা। বায়ুমণ্ডলের অবস্থান, চাঁদের উচ্চতা, পরিবেশগত অবস্থা, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীর দৃষ্টিশক্তির ওপর ভিত্তি করে চাঁদের রং ভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। চাঁদের রঙের বৈচিত্র্য চাঁদকে আরও বেশি অনন্য করে তুলেছে আমাদের কাছে।