পৃথিবী ও আকাশ
সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট গ্রহ বুধ
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর নানা রহস্যের সমাধান। পৃথিবী ও আকাশ নামে এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…
প্রাচীনকালে রোমানরা ভাবতেন, তাঁদের জীবন অনেক দেবতার হাতে। সব দেবতার পিতৃদেব হলেন জুপিটার, তাঁর স্ত্রীর নাম জুনো। সূর্যদেব তাদের সন্তান, তার নাম ফিবাস বা এ্যাপোলো। জুপিটার ও জুনোর কন্যা ভেনাস ছিলেন সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবতাদের দূত হলেন ক্ষিপ্রগতির মার্কারি (বুধ), রোমানদের বর্ণনায় মার্কারির গায়ে একজোড়া ডানা।
এসব দেবতার যুগ কেটে গেছে অনেকদিন, তবু ভারিক্কি বিষয়ে লেখা বইতে এদের নাম এখনও আছে। প্রবীণ প্রফেসররা তাদের নাম উচ্চারণ করেন অতি গম্ভীরভাবে।
কেন এমনটা? কারণ, পুরাকালের লোকেরা দেবতাদের নামে ডাকতেন গ্রহ নক্ষত্রগুলোকে। এখনো আকাশে জুপিটার (বৃহস্পতি), ভেনাস (শুক্র) এবং মার্কারি (বুধ) রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর সবচেয়ে বাউন্ডুলে দেবদেবীদেরও ভোলা হয়নি, তাদের নামে নতুন আবিষ্কৃত গ্রহ এবং গ্রহাণুর নামকরণ করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
আগেকার দিনে জ্যোতিষ্কদের অধ্যয়ন একটি মিথ্যা শাস্ত্র, জ্যোতিষের দোসর ছিল। জ্যোতিষীরা বলত ‘শিশুর জন্মমুহূর্তে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান লিখে রাখা দরকার—তাদের পারস্পরিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে মানুষের ভাগ্য।’ আর এ থেকে জ্যোতিষীরা নবজাতকের চরিত্র ও ভবিষ্যৎ বলে দিতেন।
যেমন, ‘মার্কারি রাশিতে’, অর্থাৎ আকাশে মার্কারির একটি বিশেষ স্থানে থাকার সময়ে পুত্র-সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে জ্যোতিষীরা বলতেন ছেলেটি সওদাগর হবে, কেননা মার্কারি হলেন বাণিজ্যদেবতা। ‘মার্স’ রাশিতে ভূমিষ্ঠ ছেলেরা নিষ্ঠুর হিংস্র যোদ্ধা। কারণ, মার্স ছিলেন রোমানদের যুদ্ধদেবতা।
দেবতাদের ক্ষিপ্রগতির দূতের সম্মান কেন দেওয়া হয় বুধকে? সূর্যের সবচেয়ে কাছের এই গ্রহটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে অতি দ্রুতবেগে, মাত্র ৮৮টি দিনে। পৃথিবীর চেয়ে অনেক সংক্ষিপ্ত মার্কারির কক্ষপথ, আর মার্কারি চলে অতি ক্ষিপ্রগতিতে। পৃথিবীর চারভাগের একভাগেরও কম তাই মার্কারি বছর। দ্রুতগতির জন্য রোমানরা একে বলত ‘মার্কারি’।
অতি ক্ষুদ্র গ্রহ বুধ, ব্যাস পাঁচ হাজার কিলোমিটার মাত্র। পৃথিবীর আয়তনের বিশ ভাগের একভাগ। তার মানে, পৃথিবী থেকে বিশটা বুধ গ্রহ তৈরি করা চলে। পৃথিবীর মহাকর্ষের চার ভাগের একভাগ মাত্র বুধের, অর্থাৎ ষাট কিলোগ্রাম মানুষের ওজন বুধে হবে মাত্র ১৫ কিলোগ্রাম।
পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেছে, চাঁদ যেমন শুধু একদিক পৃথিবীমুখী করে থাকে ঠিক তেমন বুধ শুধু সূর্যের এক দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। এ অবস্থায় থাকলে পৃথিবীর দশা কী হতো আমরা জানি। কিন্তু বুধের অবস্থা আরও অনেক খারাপ। সূর্যের আরও অনেক কাছে বলে পৃথিবীর চেয়ে সাতগুণ বেশী উত্তাপ পায় এর সূর্যের দিকটা।
এ দিকের তাপমাত্রা প্রায় ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ উত্তাপে টিন আর সিসা গলে যায়। বুধ গ্রহে টিন বা শিসার পাহাড় থাকলে গলন্ত ধাতুর সাগরে পরিণত হতো।
বুধের সূর্যাহত দিকে যা প্রচণ্ড গরম তার তুলনায় আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে গরম জায়গায় সবচেয়ে গরম দিনগুলোও অদ্ভুত ঠান্ডা।
বুধের যে দিকটা সূর্য কখনো দেখে না সেটা অসম্ভব ঠান্ডা। এর তাপমাত্রা প্রায় শূন্যের মতো। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, বুধের ঠান্ডা দিকটার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে প্রায় ২০০ ডিগ্রি। বুধ গ্রহে পানি থাকলে সূর্যাহত দিকটার তাপে বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসের প্রবল তাড়নায় যেত ঠাণ্ডা দিকটায়, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে বরফ বনে যেত। মনে হয়, বুধে কখনো পানি ছিল না, এত উচ্চ তাপে পানি সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়।
মনে হয় বুধের কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। এ অবস্থায় বুধগ্রহে প্রাণী থাকা সম্ভব নয়। বুধের কোনো উপগ্রহ নেই। আমাদের চাঁদের মতো বুধকলা আছে, কিন্তু সেগুলো চোখে পড়ে শুধু দূরবীক্ষণের সাহায্যে।
পৃথিবী ও বুধ যখন সূর্যের একই দিকে তখন বুধের ঠান্ডা অন্ধকার পিঠ আমাদের দিকে ফেরে, কিন্তু অগোচর থাকে।
পৃথিবী থেকে সূর্যের বিপরীত দিকে থাকলে বুধগ্রহকে পুরো দেখা যায়। তবে সে সময় আমাদের কাছ থেকে অতি দূরে। প্রথম বা শেষ পাদে, সূর্যের বাঁয়ে বা ডাইনে যখন বুধ, তখন সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা চলে তাকে। সাধারণত সূর্যের এত কাছে বলে বুধকে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন, সূর্যরশ্মিতে ঢাকা পড়ে।