গায়ের রঙে কী এসে যায়, ভেতরের রংটাই আসল। মানব সমাজে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ। বর্ণবাদপ্রথা যখন বিশ্বব্যাপী কুরে কুরে খাচ্ছিল মানব সভ্যতাকে, জাতপাতের চেয়েও যখন একটি বিবাহযোগ্যা মেয়ের গায়ের রং বড় হয়ে দাঁড়ায়, জাতিপ্রথার মতোই বর্ণপ্রথা তখন কাল হয়ে দাঁড়ায় সমাজের জন্য। সেই প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু মহান মানুষ ছিলেন বলেই বর্ণপ্রথার আগল ভেঙে অনেকটাই সুস্থ জীবনচর্চার দিকে এগিয়ে চলেছে সমাজ ও সভ্যতা। কিন্তু বর্ণপ্রথার বিষাক্ত ছোবল থেকে এখনো পুরোপুরি রেহাই মেলেনি। কিন্তু যখন আপনি অন্ধকার রাতে টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো দেখবেন, যখন জানতে চাইবেন গ্রহদের নাড়ি-নক্ষত্র, তখন আপনাকে বর্ণ মানতেই হবে। বর্ণবাদীদের মতো বর্ণ নয়, বরং গ্রহ-নক্ষত্রদের গায়ের রং দেখেই পাবেন চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের হদিস, জানবেন কী উপাদানে গড়া গ্রহ-নক্ষত্রদের শরীরের উপাদানগুলো। তখন আর বর্ণকে হেলাফেলা করলে চলবে না।
আটটি গ্রহ, প্লুটোর মতো বামনগ্রহ আর কোটি কোটি গ্রহাণু দিয়েই গঠিত আমাদের সৌরজগত। এত সবের গায়ের রং আলাদা করে চিনতে গেলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ শেষ হবে, তবু এদের বয়ান শেষে হবে না। তাই সূর্য আর আটটি গ্রহ এবং প্লুটোকে নিয়ে ‘প্রথমে দর্শনধারী, অতঃপর গুণবিচারী’ প্যাঁচাল শুনে আসা যেতে পারে।
পৃথিবী আমাদের মাতৃগ্রহ। তাই এর গায়ের রং সবচেয়ে বেশি আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু পৃথিবীর রং কেমন?
এটা আবার কোনো প্রশ্ন হলো?
আসলেই খেলো প্রশ্ন। যে কেউ চোখ বুজে বলে দিতে পারে, পৃথিবীর রং নীল।
নীল কেন? এ প্রশ্নও কিন্তু উঠবে তখন। উত্তর হলো, পৃথিবীর আকাশ নীল, তাই দূর মহাকাশ থেকে একে নীলই দেখাবে।
কথা সত্যি। কিন্তু আকাশ নীল কেন?
এটাই আসল প্রশ্ন।
এর মূল কারণ বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলে যেমন বাতাস আছে, তার সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য ধুলাবালু, কণার আকারে। এসব ধুলাবালুতে যখন সূর্যের সাদা আলো এসে পড়ে, তখন নীল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। এখানে বলে রাখা দরকার বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল—এই সাতটি রঙের মিশেলে সূর্যের সাদা আলো তৈরি হয়। কোনো কারণে সাদা আলো থেকে কোনো একটি রং যদি বিচ্ছুরিত হয়, তবে বিচ্ছুরণ এলাকায় সেই রং ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় সূর্যের সাদা আলো থেকে নীল রং বিচ্ছুরিত হয়, তাই বায়ুমণ্ডলের বিশেষ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বিচ্ছুরিত নীল রং। সুতরাং সেই অঞ্চলটাকে নীল দেখায়। তাই পৃথিবী থেকে আকাশের রং নীল মনে হয়। অন্যদিকে পৃথিবীর বাইরে থেকে গোটা পৃথিবীটাকে নীল দেখায় বায়ুমণ্ডলের নীল রঙের কারণে।
কথা হলো, নীল রংই কেন বিচ্ছুরিত হয়, অন্য কোনো রং কেন নয়?
নীল রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম, কম্পাঙ্ক বেশি। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আকার এমনই যে বায়ুমণ্ডলের ধুলাবালুতে বাধা পায়। ফলে দিক পরিবর্তন করে এই আলোকে পৃথিবীতে আসতে হয়। কিন্তু নীল ছাড়া অন্য রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এতটাই বড়, সেগুলোর কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না খুদে ধূলিকণা। অন্যদিকে বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরও ছোট। তাই সেগুলোর ওপরও কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না বাতাসের ধূলিকণাগুলো। এদের জন্য বেগুনি আলোই পারফেক্ট। এ কারণেই পৃথিবীর আকাশ নীল। নইলে স্থলভাগে গাছপালা বেশি, তাই সবুজ দেখাত স্থলভাগকে আর সমুদ্রের পানির জন্য জলভাগকে নীল দেখাত। অর্থাৎ পৃথিবীর রং হতো নীল-সবুজ।
কিন্তু যে গ্রহের বায়ুমণ্ডল নেই বা বায়ুমণ্ডল খুবই হালকা, তাদের ক্ষেত্রে কী হয়?
বেশি দূর না গিয়ে চাঁদের দিকেই আগে তাকাই। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই। তাই আকাশেরও রং নেই এখানে। অর্থাৎ চাঁদের মহাকাশের রং কালো। তাই বলে চাঁদকে তো আমরা কালো দেখি না। ভরা পূর্ণিমা চাঁদের রুপালি আগুনঝরা জোছনা জীবনানন্দ দাশকেও ব্যাকুল করেছিল। চাঁদের মাটিতে আছে ধূসর-রুপালি নুড়ি পাথর। তাই চাঁদের মাটি থেকে প্রতিফলিত হওয়া আলোকে আমরা এই রঙেই দেখি।
সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধের রং অনেকটা চাঁদের মতোই। কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে বুধ গ্রহের রং কেমন, তার স্পষ্ট প্রমাণ ছিল না। সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বলে এর স্পষ্ট ছবি তোলা প্রায় অসম্ভব ছিল পৃথিবী থেকে। ১৯৭৩ সালে নাসা মেরিনার ১০ এবং ২০০৪ সালে মেসেঞ্জার নামে দুটি মহাকাশযান পাঠায় বুধ গ্রহের উদ্দেশে। এই যান দুটিই বুধ গ্রহের স্পষ্ট ছবি তুলতে সক্ষম হয়। সেই ছবি দুটি থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বুধ গ্রহের রং কালচে ধূসর। বুধের হালকা বায়ুমণ্ডল আছে। সেই বায়ুমণ্ডল হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, হিলিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম দিয়ে তৈরি। কিন্তু বায়ুমণ্ডল এত পাতলা, সেখানে ধূলিকণা নেই বললেই চলে। তাই কোনো আলোর বিচ্ছুরণ সেখানে ঘটে না। তাই নুড়ি পাথর, সামান্য কিছু নিকেল আর সিলিকা পাথর দিয়ে তৈরি বুধ গ্রহের পৃষ্ঠতলের রংটাকেই আমরা এর আসল রং হিসেবে দেখি।
পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ শুক্রের বায়ুমণ্ডল কিন্তু অতটা পাতলা নয়। বরং কার্বন ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন ও সালফার ডাই–অক্সাইড দিয়ে তৈরি বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মিশে আছে সালফিউরিক অ্যাসিডের মেঘ। এতগুলো উপাদানের মিশ্রণ শুক্রের বায়ুমণ্ডলকে হলদেটে ধূসর করে তুলেছে। এটাই আমরা দূর থেকে দেখতে পাই, শুক্রের পৃষ্ঠতলের রংটাকে নয়। কিন্তু কোনো মহাকাশযানে চড়ে যদি শুক্রের কক্ষপথে ভ্রমণ করেন, তাহলে এর রং দেখবেন চাঁদ কিংবা বুধ গ্রহের মতো। কারণ এর পৃষ্ঠতলও চাঁদ ও বুধের মতো কালচে ধূসর পাথরে তৈরি।
লোহিত মানে লাল। আর লোহিত শব্দটা এসেছে লোহা থেকে। তার মানে যেখানেই লোহার উপস্থিতি, সেখানেই লালের আধিক্য। আমাদের প্রিয় গ্রহ মঙ্গলের রং লাল। কারণ এর মাটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন অক্সাইড। তা ছাড়া এর বায়ুমণ্ডলও খুব পাতলা। তাই সেখানে সূর্যের আলোর কোনো বিচ্ছুরণ হয় না। তাই মঙ্গলের পৃষ্ঠতলের রংটিকেই আমরা দূর থেকে দেখতে পাই। লাল বলা হলেও এর আসল রং লালচে বাদামি, পুরোপুরি লাল নয়।
সব কটি গ্রহেরই নির্দিষ্ট একটা রং আছে। কিন্তু গ্রহরাজ বৃহস্পতির ক্ষেত্রে সে কথা খাটে না। বৃহস্পতির রং অনেকগুলো—কমলা, বাদামি রঙের মাঝখানে সাদা রঙের ব্যান্ড। কোথাও কোথাও এই তিন রঙের বৃত্ত-উপবৃত্তের খেলা। বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডল আছে। কিন্তু এর নিরেট কোনো পৃষ্ঠতল নেই। তার মানে বৃহস্পতি পৃথিবী বা মঙ্গলের মতো পাথুরে গ্রহ নয়। এটা গ্যাসীয় দানব। আর এই গ্যাসপিণ্ডটি তৈরি হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও অন্যান্য গ্যাস দিয়ে। সে গ্যাসের মধ্যে চলছে অবিরাম ঘূর্ণিঝড়। সেখান থেকেই আসে সাদা রঙের জোগান। অন্যদিকে এর বায়ুমণ্ডলের ক্রোমোস্ফিয়ারে রয়েছে সালফার, ফসফরাস ও হিলিয়াম গ্যাসের মেঘ। সেখানে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে কমলা আর বাদামি রঙের ব্যান্ড তৈরি করে।
বৃহস্পতির মতো শনিও গ্যাস–দানব। এর পাথুরে কোরের চারপাশে ঘিরে আছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস। হাইড্রোজেনের উপস্থিতি একে গাঢ় লাল রং দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি অ্যামোনিয়া গ্যাসের জন্য। হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের ওপরের স্তরে রয়েছে অ্যামোনিয়া গ্যাসের মেঘ। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে শনির সবচেয়ে ওপরের স্তরের রং সাদা। সব মিলিয়ে লালও নয় সাদাও নয়, শনির গায়ের রং ফিকে সোনালি।
ইউরেনাস ঠিক পাথুরে গ্রহ নয়। আবার পুরোপুরি গ্যাসীয় গ্রহও নয়। এই গ্রহ তৈরি বড় বড় সব অণু দিয়ে। যেমন ইউরেনাসের দেহ গড়ে উঠেছে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, অ্যামোনিয়া, পানি ও সালফাইডের মিশেলে। সঙ্গে আছে কিছু হাইড্রোকার্বন। এর মধ্যে রয়েছে মিথেন। এই গ্যাসটিই ইউরোনাসের রঙের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে। তৈরি হয়েছে সবজেটে নীল অর্থাৎ সায়ান রঙের গ্রহ।
নেপচুনের চেহারাও অনেকটা ইউরেনাসের মতো। এই গ্যাসীয় গ্রহের বহিরাবরণ তৈরি হয়েছে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও পানি দিয়ে। সঙ্গে আছে মিথেন ও সামান্য পরিমাণে অ্যামোনিয়া। সব কটি মিলিয়ে নেপচুনের রং হওয়া উচিত ছিল উজ্জ্বল সবুজ। কিন্তু সূর্য থেকে অনেক দূরে। সূর্যের আলো সেখানে ঝাপসা। তাই নেপচুনের রং কালচে নীল।
কয়েক বছর আগে গ্রহের খেতাব হারিয়ে বামন গ্রহের তকমা পাওয়া প্লুটোকে মনে করা হতো কালচে বাদামি গ্রহ হিসেবে। কিন্তু নাসার মহাকাশযান নিউ হরাইজন প্লুটো অভিযানে গিয়ে এর স্পষ্ট ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে। সেই ছবিতে দেখা যায়, এর একক কোনো রং নেই। কোথাও খয়েরি, কোথাও সাদা আবার কোথাও কমলা রঙের আধিক্য। এই গ্রহ তৈরি হয়েছে পাথর ও নাইট্রোজেনের বরফ দিয়ে। এ ছাড়া মিথেন ও কার্বন মনো–অক্সাইডও আছে। উপাদানগুলোর আধিক্যের ভিত্তিতে একেক এলাকায় প্লুটোর রং একেক রকম।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: ইউনিভার্স টু ডে