অনেক অনেক আগের কথা। এক দেশে ছিল ছোট্ট একটি মেয়ে। নাম তার ছিল গোল্ডিলকস।
একদিন সকালবেলা বনের পথে হাঁটতে গেল ছোট্ট মেয়েটি। কিছুদূর হাঁটার পর বনের ভেতর একটি কুঁড়েঘর দেখতে পেল গোল্ডিলকস। কুঁড়েঘরের দরজায় ঠক ঠক করল সে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও কেউ দরজা খুলল না। অগত্যা দরজাটি একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল সেটি। কুঁড়েঘরে পা রাখল ছোট্ট গোল্ডিলকস।
ঘরে ঢুকতেই খাবারের সুগন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারল গোল্ডিলকসের। রান্নাঘরে একটি টেবিল দেখা গেল। তার ওপর তিন বাটি পরিজ রাখা। একটি বড় বাটি, একটি মাঝারি আর একটি ছোট। বাটিগুলোর পাশে আবার বড়, মাঝারি আর ছোট আকৃতির তিনটি চামচ রাখা।
বনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল গোল্ডিলকসের। চোখের সামনে সুস্বাদু পরিজ দেখে জিবে পানি এসে গেল তার। বড় চামচটি দিয়ে প্রথম বাটি থেকে কিছুটা পরিজ মুখে দিল সে। কিন্তু সেটি ছিল খুবই গরম। মুখ পুড়ে গেল তার।
তাই মাঝারি চামচটি দিয়ে মাঝারি সাইজের দ্বিতীয় বাটি থেকে পরিজ তুলে মুখে দিল সে। ‘দূরছাই, একেবারে ঠান্ডা!’ বলে সেগুলো রেখে দিল গোল্ডিলকস।
এবার তৃতীয় বাটি থেকে পরিজ মুখে তুলল সে। ‘ওয়াও! পরিজটা একেবারে মনের মতো। বেশি গরমও নয়, ঠান্ডাও নয়।’ খুশি মনে সবটুকু চেটেপুটে খেল ছোট্ট মেয়েটি।
পেট পুরে খেয়ে একটু ক্লান্ত লাগছিল গোল্ডিলকসের। একটু জিরিয়ে নেওয়ার কথা ভেবে বসার ঘরের দিকে এগোল। সেখানে তিনটি চেয়ার দেখতে পেল মেয়েটি। একটি বড়, একটি মাঝারি আর আরেকটি ছোট। প্রথম চেয়ারটিতে বিশ্রাম নিতে বসল সে। কিন্তু চেয়ারটি ছিল তার তুলনায় খুবই বড়। তাই দ্বিতীয় চেয়ারের দিকে এগোল গোল্ডিলকস। এই চেয়ার আগেরটির চেয়ে ছোট হলেও গোল্ডিলকসের জন্য সেটিও বেশ বড় আকৃতির। তাই সে এগোল তৃতীয় চেয়ারটির দিকে। এটি একেবারে ঠিকঠাক। বড় নয়, ছোটও নয়। তার বসার জন্যই যেন বানানো হয়েছে চেয়ারটি। কিন্তু একটু আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসতে গিয়ে চেয়ারটি ঠাস করে ভেঙে গেল।
গোল্ডিলকসের আসলেই খুব ক্লান্ত লাগছিল। তাই সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় গেল সে। সেখানে তিনটি বিছানা দেখা গেল। প্রথমটি বড়, দ্বিতীয়টি মাঝারি আর তৃতীয়টি একেবারে ছোট। প্রথম বিছানায় গা এলিয়ে দিল গোল্ডিলকস। কিন্তু সেটি খুবই শক্ত মনে হলো তার কাছে। তাই সেখান থেকে উঠে দ্বিতীয় বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। কিন্তু এটি আবার বেশি নরম বলে মনে হলো। তাই তৃতীয় বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সে। সেটি গোল্ডিলকসের মনের মতো। ছোট নয়, বড়ও নয়। একেবারে তার মাপে যেন বানানো। সেখানে শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল গোল্ডিলকস।
কুঁড়েঘরটি ছিল আসলে তিন ভালুকের। বাবা ভালুক, মা ভালুক আর ছানা ভালুক। বাবা ভালুক বেশ বড়, মা ভালুকটি মাঝারি আর ছানা ভালুকটি একেবারেই ছোট, ঠিক গোল্ডিলকসের মতো। ওই সকালে নাশতা করার আগে তারাও বনের ভেতর হাঁটতে বেরিয়েছিল। কিছুক্ষণ হেঁটে বাড়ি ফিরে এল তারা। ঘরে পা দিয়েই তিন ভালুক টের পেল কেউ একজন তাদের কুঁড়েঘরে ঢুকেছে। রাগে গজরাতে গজরাতে বাবা ভালুক বলল, ‘দেখো, দেখো, কে যেন আমার পরিজ খেয়েছে।’
‘আমারটাও তো কিছুটা খেয়েছে,’ মা ভালুক বলল।
‘আমারও তো সব পরিজ খেয়ে ফেলেছে,’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ছানা ভালুক।
রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে আসতেই ভাঙা চেয়ারটি চোখে পড়ল তাদের। তারা আগন্তুককে খুঁজতে লাগল আঁতিপাঁতি করে। দোতলায় শোবার ঘরে আসতেই দেখল, তাদের বিছানাগুলো এলোমেলো। আর ছানা ভালুকের বিছানায় শুয়ে আছে ছোট্ট একটি মেয়ে।
ঠিক তখন ঘুম ভেঙে গেল গোল্ডিলকসের। চোখ খুলতেই তিন ভালুককে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। আতঙ্কে জমে গেল মেয়েটি। কেউ কিছু বোঝার আগেই একলাফে সে বিছানা থেকে নেমে ঝেড়ে দৌড় দিয়ে নিচে নেমে এল। তারপর কোনোমতে দরজাটি খুলে বনের ভেতর দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেল। এরপর আর কখনো বনের ভেতর ভালুকের কুঁড়েঘরে যায়নি গোল্ডিলকস।
২.
এতক্ষণ যাঁরা ভ্রু কুঁচকে এটুকু পড়ে ভাবছেন, বিজ্ঞান ম্যাগাজিনে রূপকথা কেন, তাঁদের জন্য বলি, এটি রূপকথা হলেও আধুনিক বিজ্ঞানে এর প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। উনিশ শতকে ব্রিটেনে ছোট্ট মেয়ে গোল্ডিলকসকে নিয়ে এ রূপকথার জন্ম। পরবর্তী সময়ে একই গল্পের তিনটি সংস্করণের সন্ধান পাওয়া যায়। গল্পটি একসময় এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তা নিয়ে অপেরা, নাটক, সিনেমাও তৈরি হয়েছে অসংখ্য। তারই ধারাবাহিকতায় একসময় বিজ্ঞানে বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্জীববিজ্ঞান, এমনকি সাইকোলজি, জীববিজ্ঞান, অর্থনীতি ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও জায়গা করে নেয় ছোট্ট মেয়েটি। বর্তমানে সৌরজগতে তথা মহাবিশ্বের পৃথিবীর সুষম অবস্থান বোঝাতে কিংবা বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহে প্রাণের সন্ধানে ‘গোল্ডিলকস জোন’ বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। সাধারণত কোনো নক্ষত্রের চারপাশে জীবন ধারণের উপযোগী বা বসবাসের উপযোগী এলাকা বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের পৃথিবী হলো গোল্ডিলকস জোনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আসলে সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান থেকে শুরু করে গ্রহটির সবকিছুই যেন বাড়াবাড়ি রকমের সুষম, যথাযথ। গোল্ডিলকসের চেখে দেখা পরিজের মতোই বেশি গরমও নয়, কনকনে ঠান্ডাও নয়, একবারে আরামদায়ক তাপমাত্রা। চেয়ার বা বিছানার মতো পৃথিবীর আকৃতি বেশি বড় নয়, ছোটও নয়, একেবারে যথাযথ আকৃতির।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য থেকে পৃথিবীর অবস্থান গোল্ডিলকস জোনে। তরল পানিকে বলা হয় সর্বজনীন দ্রাবক। পানি ছাড়া আমাদের এক মুহূর্ত চলে না। তাই পানি ছাড়া পৃথিবীতে জীবনধারণও অসম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে জীবনের রসায়ন তৈরির জন্য গ্রহটি সূর্য থেকে একদম যথাযথ দূরত্বে অবস্থিত, বেশি নয়, কমও নয়। কথাটির সত্যতা বোঝা যাবে এই দূরত্বের সামান্যতম হেরফের হলে। সূর্য থেকে পৃথিবী যদি কিছুটা দূরে থাকত, তাহলে সব পানি জমাট বেঁধে পরিণত হতো মঙ্গল গ্রহের মতো বিশাল এক মরুভূমিতে। সূর্য থেকে বেশ দূরে থাকার কারণে মঙ্গলের তাপমাত্রা বেশ কম। নিম্ন তাপমাত্রার কারণে মঙ্গলের রুক্ষ, অনুর্বর ভূমিতে পানি, এমনকি কার্বন ডাই–অক্সাইডও প্রায় জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে গেছে। আবার মঙ্গল গ্রহের ওপরে শুধু নয়, মাটির নিচেও খুঁজে পাওয়া গেছে জমাটবাঁধা পানির স্থায়ী স্তর। সেটির পেছনেও কারণ হলো মাতৃনক্ষত্র বা সূর্য থেকে ওই দূরত্ব। আবার পৃথিবী যদি সূর্যের খুব কাছে হতো, তাহলে সেটা হয়তো অনেকটাই শুক্র গ্রহের মতো হয়ে যেত। আকৃতির দিক থেকে শুক্র গ্রহ প্রায় পৃথিবীর মতো হলেও তা গ্রিনহাউস প্ল্যানেট নামে পরিচিত। শুক্র গ্রহ সূর্যের অনেক কাছে থাকায় এবং এর বায়ুমণ্ডলের বেশির ভাগে কার্বন ডাই–অক্সাইড থাকায় গ্রহটি সূর্য থেকে পাওয়া শক্তি ধরে রাখে। ঠিক গ্রিনহাউসের মতো। তাতে এর তাপমাত্রা ৪৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। এ কারণে সৌরজগতের সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহের তকমা জুটেছে শুক্রের কপালে। সেখানে কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি হয়; পানির নয়, তরল সালফিউরিক অ্যাসিডের। বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর তুলনায় শতগুণ বেশি শুক্রে। আবার প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে সৌরজগতের সম্ভবত সবচেয়ে নরকতুল্য গ্রহ এটি। এর প্রধানতম কারণ, গ্রহটি সূর্যের অনেক কাছে অবস্থিত। কাজেই এ রকম কোনো গ্রহে আমাদের চোখে পরিচিত প্রাণের কোনো অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকার জন্য গোল্ডিলকস জোনের বেশ বড় ভূমিকা আছে। যেসব কাকতালীয় ঘটনা এখানে প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব করে তুলেছে, সেগুলোও একাধিক। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সৌরজগতের একটি গোল্ডিলকস জোনে থাকার পাশাপাশি আরও কিছু গোল্ডিলকস জোনে রয়েছে পৃথিবী। যেমন পৃথিবীর কক্ষপথকে স্থিতিশীল রাখার জন্য আমাদের একমাত্র চাঁদের আকার একেবারে যথার্থ। মানে বেশি বড় নয়, বেশি ছোটও নয়। চাঁদ বড় হলে কবিদের জন্য কাব্যিকতা আরও বাড়ত কি না জানি না, কিন্তু পৃথিবীতে যে কোনো কবি থাকতেন না, সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। কম্পিউটার প্রোগ্রামে দেখা গেছে, বড় আকারের একটি চাঁদ বা পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ আকৃতির কোনো চাঁদের কারণে পৃথিবীর অক্ষরেখা হয়তো কয়েক মিলিয়ন বছরে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত সরে যেতে পারত। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, ডিএনএর সৃষ্টির জন্য কয়েক শ মিলিয়ন বছর জলবায়ুর স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। তাই পৃথিবীর অক্ষরেখা পর্যায়ক্রমে যদি সরে যেত, তাহলে তার আবহাওয়ায় বিপর্যয় নেমে আসত। তাতে জীবনের নীলনকশা ডিএনএর গঠন সম্ভব হতো না। আবার চাঁদ যদি এখনকার তুলনায় বেশ খানিকটা ছোট হতো, তাহলে কয়েক মিলিয়ন বছরে পৃথিবীর ঘূর্ণনে সামান্য অস্থিরতা ধীরে ধীরে জমে উঠত। তা জমতে জমতে একসময় তা বড় আকার ধারণ করত। ফলে পৃথিবী ভয়ানকভাবে টলমলে হয়ে যেত। তাতে তার জলবায়ুর পরিবর্তন হতো মারাত্মক। স্বাভাবিকভাবে এখানে জীবনধারণও হয়ে উঠত অসম্ভব। সৌভাগ্যক্রমে পৃথিবীর কক্ষপথকে স্থিতিশীল করার জন্য আমাদের চাঁদের আকৃতি একদম যথাযথ বলা চলে। ছোট নয়, বড়ও নয়। তাই এই বিপর্যয় এখনো ঘটেনি। যেমন মঙ্গল গ্রহের চাঁদগুলোর আকৃতি তার ঘূর্ণন স্থিতিশীল করার পক্ষে যথেষ্ট বড় নয়। ফলে মঙ্গল গ্রহ ধীরে ধীরে অস্থিতিশীলতার পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। অতীতে মঙ্গল গ্রহ সম্ভবত তার অক্ষরেখার প্রায় ৪৫ ডিগ্রিতে ঘুরত বলে বিশ্বাস করেন জ্যোতির্বিদেরা।
আবার সামান্য জোয়ার বলের কারণে চাঁদ প্রতিবছর পৃথিবী থেকে প্রায় ৪ সেন্টিমিটার হারে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রায় ২ বিলিয়ন বছরে এটি এতই দূরে চলে যাবে যে তা আর পৃথিবীর ঘূর্ণনকে স্থিতিশীল রাখতে পারবে না। এ ঘটনা পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর রাতের আকাশ শুধু চাঁদহীনই হবে না, সেই সঙ্গে আমরা হয়তো পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের নক্ষত্রমণ্ডল দেখব। কারণ, পৃথিবীর কক্ষপথ গোলমেলে হয়ে যাবে। পৃথিবীর আবহাওয়াও হয়ে যাবে অচেনা, যা জীবনধারণের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক পিটার ওয়ার্ড এবং জ্যোতির্বিদ ডোনাল্ড ব্রাউনলি লিখেছেন, চাঁদ ছাড়া জ্যোৎস্না থাকবে না, কোনো চান্দ্রমাস, চাঁদ নিয়ে কবিত্ব, কোনো অ্যাপোলো অভিযান থাকবে না, কবিতাও কম লেখা হবে। কারণ, তখন পৃথিবীর প্রতিটি রাতই হবে ঘনঘোর অন্ধকারে ভরা।
পৃথিবীর গোল্ডিলকস জোনে অবস্থানের আরেকটি কারণ গ্রহরাজ বৃহস্পতি। নানা কারণে গ্রহটির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এক কম্পিউটার মডেলে দেখা গেছে, সৌরজগতে বৃহস্পতি গ্রহের উপস্থিতি পৃথিবীতে জীবনের টিকে থাকার জন্য একটি আশীর্বাদ। কারণ, এ গ্রহের শক্তিশালী মহাকর্ষ গ্রহাণুগুলোকে বাইরের মহাকাশে ছুড়ে মারতে সহায়তা করে। আমাদের সৌরজগতের গঠনের পর গ্রহাণু ও ধূমকেতুর ধ্বংসাবশেষগুলো সাফ করতে বৃহস্পতির প্রায় ১ বিলিয়ন বছর লেগেছিল। এটি ঘটেছিল ৩.৫ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। বৃহস্পতি গ্রহ যদি অনেক ছোট হতো আর তার মহাকর্ষ যদি বেশ দুর্বল হতো, তাহলে আমাদের সৌরজগৎ এখনো গ্রহাণুতে ভরে থাকত। স্বাভাবিকভাবেই তাতে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব অসম্ভব হয়ে উঠত। কারণ, গ্রহাণুর প্রাণ ধ্বংস করে দিত। ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পেছনে এমনই এক গ্রহাণুকে দায়ী করেন বিজ্ঞানীরা। কাজেই সৌরজগতে পৃথিবীর একজন বড় ভাই হিসেবে বৃহস্পতি গ্রহের আকারও যথার্থ।
আবার গ্রহের ভর বা আকৃতির দিক দিয়েও আরেকটা গোল্ডিলকস জোনে বাস করি আমরা। বেশি নয়, কমও নয়, একদম যেটুকু হওয়ার দরকার, সেটুকুই আছে। পৃথিবী যদি আরেকটু ছোট হতো, তাহলে এর মহাকর্ষ বেশ দুর্বল হতো। অনেকে হয়তো ভাববেন, তখন একলাফে এখনকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ওপরে উঠতে পারতাম। সে কথা সত্যি। কিন্তু মাটিতে লাফালাফি বা দাপাদাপি করার জন্য কেবল আমরাই এখানে থাকতাম না। কারণ, দুর্বল মহাকর্ষের জন্য পৃথিবী অক্সিজেন আটকে রাখতে পারত না। আবার পৃথিবী আরেকটু বড় হলেও ঝামেলার অন্ত ছিল না। তখন হয়তো জমি দখলবাজদের জন্য বেশ সুবিধা হতো। কিন্তু এর চেয়ে বেশি বড় পৃথিবীতে অনেক আদিম, বিষাক্ত গ্যাস আটকে থাকত। তাতেও জীবনের উদ্ভব হতো অসম্ভব। তাই জমি দখল করার জন্য কেউ টিকে থাকত না। আমাদের চলাফেরাতেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারত এই অতিরিক্ত মহাকর্ষ। কাজেই প্রাণধারণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল গড়ে তুলতে পৃথিবীর ওজন একেবারে যথার্থ।
আবার আমরা সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য গ্রহের কক্ষপথের এক গোল্ডিলকস জোনেও বাস করি। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, প্লুটো বাদে অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথ প্রায় বৃত্তাকার। এর মানে হলো সৌরজগতে গ্রহসংক্রান্ত প্রভাব খুবই বিরল ঘটনা। অর্থাৎ পৃথিবী এমন কোনো গ্যাসীয় দানব গ্রহের কাছে যায় না, যার মহাকর্ষ খুব সহজে পৃথিবীর কক্ষপথে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। বলা বাহুল্য, এটা প্রাণের টিকে থাকার জন্য বেশ ভালো। এর জন্য আসলে কয়েক শ মিলিয়ন বছরের স্থিতিশীলতার প্রয়োজন।
একইভাবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের একেবারে গোল্ডিলকস জোনের মধ্যে অবস্থান পৃথিবীর। এ ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দূরে রয়েছে পৃথিবী। আমাদের গ্যালাকটিক কেন্দ্রে একটি কৃষ্ণগহ্বর ওত পেতে রয়েছে। তার বিকিরণক্ষেত্র খুবই তীব্র। তাই আমাদের সৌরজগৎ যদি গ্যালাকটিক কেন্দ্রের খুব কাছে হতো, তাহলে ওই তীব্র বিকিরণক্ষেত্রের প্রভাবে পৃথিবী হয়ে উঠত প্রাণধারণের পক্ষে অসম্ভব একটি গ্রহ। আবার সৌরজগৎ যদি ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে থাকত, তাহলেও ঝামেলা ছিল। তখন সেখানে উচ্চ শ্রেণির মৌল পর্যাপ্ত পাওয়া যেত না। অথচ এগুলো প্রাণ সৃষ্টির জন্য বেশ দরকারি মৌল।
বিজ্ঞানীদের ঝুলিতে এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তাতে দেখা যায়, পৃথিবী এ রকম অগণিত গোল্ডিলকস জোনের ভেতরে রয়েছে। জ্যোতির্বিদ ওয়ার্ড ও ব্রাউনলি যুক্তি দিয়েছেন, আমরা এত বেশি গোল্ডিলকস জোনের ভেতর বাস করি যে এই ছায়াপথের জন্য, এমনকি হয়তো গোটা মহাবিশ্বের জন্যও বুদ্ধিমান জীব অনন্য কোনো ঘটনা। ওপরের তালিকার বাইরে তারা আরও কিছু গোল্ডিলকস জোনের তালিকা দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: পৃথিবীর মহাসাগরের পরিমাণ একেবারে যথার্থ, প্লেট টেকটোনিকস, অক্সিজেনের পরিমাণ, অক্ষরেখার কোণসহ অনেক কিছু। তাঁদের যুক্তিতে এ রকম আরও অনেক কিছুই আমাদের মতো বুদ্ধিমান জীব সৃষ্টির জন্য যথার্থ ও দরকারি। পৃথিবী যদি এসব ছোট্ট গোল্ডিলকস পরিসরের কোনোটির বাইরে থাকত, তাহলে এখানে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব স্রেফ রূপকথা হয়ে যেত। কিংবা তখন এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা বা আলোচনার জন্যও কেউ থাকত না। বিজ্ঞানচিন্তা নামে কোনো ম্যাগাজিনও থাকত না। কখনো লেখা হতো না এই লেখা। আর এ লেখার পাঠক তো আরও অনেক দূরের ব্যাপার।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: প্যারালাল ওয়ার্ল্ড/মিচিও কাকু, নাসা ডটকম, উইকিপিডিয়া