কীভাবে শুরু হকিংয়ের পথচলা?

স্টিফেন হকিং নিয়ে কোনো রকম অনুসন্ধিত্সা ছিল না, এ রকম বিজ্ঞানপ্রেমী ব্যক্তি খুঁজে বের করা বেশ কষ্টকর। কিন্তু তিনি আদতে কী করেছিলেন, এটা জিজ্ঞেস করলে অনেকেই মাথা চুলকাতে শুরু করবেন। হকিংয়ের মৃত্যুর পরপরই আমাদের গণমাধ্যমে যে দোলা লেগেছিল, তার ফলে আমাকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেশ কয়েকবার টিভি ক্যামেরার সামনে হাজিরা দিতে হয়েছিল। এ রকমই একটা অনুষ্ঠানে স্টিফেন হকিংকে বিগ ব্যাং তত্ত্বের জনক হিসেবে উপস্থাপন করে সঞ্চালক আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। এর উত্তরে কী বলেছিলাম, তা এ মুহূর্তে মনে নেই। কিন্তু এ রকম অজ্ঞতায় যে হালকা বিরক্ত হয়েছিলাম, তা চাপা রাখতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। আসল কথা হলো, আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক না করেই আলোচনা করতে বসে যাই।

তখনই আমার উপলব্ধি হলো, পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের অবদানটা কোথায়, সেটা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা প্রয়োজন। তবে এখানে একটা কথা প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমার বিশ্লেষণের সঙ্গে অন্য কোনো বিজ্ঞানকর্মীর বিশ্লেষণ না-ও মিলতে পারে। কারণ, আমি বরাবরই মনে করি, বিজ্ঞান কখনোই শুধু এক ব্যক্তির একাকী সাধনার ফসল নয়; বরং এটা সামষ্টিক কর্মকাণ্ড। কারণ, শুধু তত্ত্ব দিয়েই বিজ্ঞানীরা ক্ষান্ত হন না, প্রকৃতি সেই তত্ত্ব মেনে না চললে, সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষণীয় তত্ত্বকেও ফুটবল খেলার মাঠে গোল করার হারানো সুযোগ বলেই পরিগণিত হতে হবে। আর রেকর্ডের পাতায় এ রকম হারানো সুযোগগুলোর কোনো পরিসংখ্যান কেউ টুকে রাখে না। সে জন্য তত্ত্বকে যাচাই করার জন্য লাগে পরীক্ষণ, আর এ জন্য প্রয়োজন পরীক্ষণবিদদের, যাঁদের অবদান তাত্ত্বিকদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

হকিং যে জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করেছেন, তিনি কিন্তু সেসব তত্ত্বের আদি জনক নন। তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতাও প্রণয়ন করেননি, কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের জনকও নন। এমনকি নতুন কোনো ধরনের কৃষ্ণগহ্বরও (Black hole) তিনি আবিষ্কার করেননি। তারপরও তিনি সাধারণ মানুষের কাছে একটি অত্যন্ত সুপরিচিত নাম, হয়তোবা তাঁর হুইলচেয়ারে বসে থাকা, তাঁর চাহনিই তাঁকে মানুষের কাছে আরও কৌতূহোলদ্দীপক করেছে। যা-ই হোক, হকিংয়ের এই শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে চিন্তার বাইরে রেখেই তাঁর কাজগুলোর ওপর দৃষ্টিপাত করব। হকিংয়ের কাজগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখব, তিনি কখনো তাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে একটা বাক্সের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেননি। অর্থাত্, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক ধারণাকে তিনি আলিঙ্গন করে নিয়েছেন। এটা অনেক বিজ্ঞানীই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে আর পারেন না। হকিংয়ের কাজগুলোকে যদি আমরা একটা উপন্যাসের মতো সাজাই, তাহলে সেটাকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারব।  

সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য

রজার পেনরোজের প্রণয়ন করা গাণিতিক কৌশল ব্যবহার করে হকিং দেখান যে চিরায়ত আপেক্ষিক তত্ত্বের কাঠামো দিয়ে মহাবিশ্বের শুরু বর্ণনা করা হলে সেখানে অবশ্যই আদিতে একটা পরম (Singularity) বিন্দু থাকতে হবে। এই ফলাফল কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা পরবর্তী সময়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করব। 

  কৃষ্ণগহ্বরের বলবিদ্যা

১৯৬৫ সালে রয় কার আইনস্টাইনের সমীকরণের ঘূর্ণমান কৃষ্ণগহ্বর সমাধান বের করলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কৃষ্ণগহ্বরের সাধারণ ধর্ম কী, এ নিয়ে অনুসন্ধিত্সা জন্ম নেয়। হকিংও এই স্রোতের বাইরে থাকেননি। সাধারণভাবে আমরা বলি, কৃষ্ণগহ্বরের একটি দিগন্ত (Horizon) থাকে। সেটা পেরিয়ে গেলে কেউ আর ফেরত আসে না। আপেক্ষিকতার বিশেষজ্ঞদের কাছে এটা একটা শিশুতোষ সংজ্ঞা। কিন্তু অন্যদিকে অন্য কোনো টেকনিক্যাল সংজ্ঞা বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল না। হকিং ও তাঁর সহযোগীরা এই দিগন্তের একটা যুত্সই সংজ্ঞা দাঁড় করালেন। তাঁদের কাজের ফলে আমরা আজ পরিচিত হয়েছি (K) আপাত দিগন্ত (Apparent horizon), (L) ঘটনা দিগন্ত (event horizon) আর (M) কণা দিগন্ত (Particle horizon) ইত্যাদির সঙ্গে। এদের মধ্যে যদিও ঘটনা দিগন্তের নাম আমরা প্রায়ই হলিউডি চলচ্চিত্রে দেখতে পাই। কিন্তু একটা পাথরের অবস্থানের মতো এই দিগন্তের অবস্থান আমরা আঙুল দেখিয়ে বলতে পারব না। কারণ, এটা একটা চতুর্মাত্রিক ধারণা, আর এ জন্য এটাকে শনাক্ত করতে হলে আমাদের অসীম সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে আপাত দিগন্ত নিয়ে কাজ করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। লাইগোতে (LIGO) যে ধরনের মহাকর্ষ তরঙ্গ আমরা শনাক্ত করতে চেয়েছিলাম, তার নকশা জানার জন্য আমাদের প্রথমে কম্পিউটারে একটা গাণিতিক মডেল সমাধান করতে হয়েছিল। সেই মডেলে উত্স কোন সীমানার মধ্যে আছে, তা বের করার জন্য এই আপাত দিগন্তের ধারণাই ব্যবহূত হয়েছিল। এই দিগন্তের ধারণা ব্যবহার করে ১৯৭৩ সালে স্টিফেন হকিং, ব্র্যান্ডন কার্টার এবং জেমস বারডিন একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী আর্টিকেল লিখলেন। সেটার নাম হলো The Four Laws of Black-Hole Mechanics। যদিও এই আর্টিকেলের বেশ কিছু ফলাফল তাঁদেরই লেখা। আগের কাজগুলোর মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো আকারে দেওয়া আছে-সব কটিকে একসঙ্গে করে তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলোর অনুকরণে সাজানো হয়েছিল। তাঁরা দেখালেন, তাপগতিবিদ্যার যে চারটি সূত্র আছে, সাধারণ কৃষ্ণগহ্বরের জন্য ঠিক এ রকম চারটি সূত্র লেখা যায়,  যদি আমরা তাপগতিবিদ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রের সমন্বিত রূপের সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের সূত্র তুলনা করি। তাপগতিবিদ্যা অনুযায়ী

ΔU = T (ΔS)...........................(1)

যেখানে ΔU হচ্ছে সিস্টেমের মোট শক্তির পরিবর্তন, T তার তাপমাত্রা এবং ΔS সিস্টেমের এনট্রপির পরিবর্তন। হকিং, কার্টার ও বারডিন দেখালেন, কৃষ্ণগহ্বরের ভরের পরিবর্তন ΔM হলে

ΔM = Δ (ΔA)/8π....................(2)

এখানে ΔA হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরের দিগন্তক্ষেত্রের (Horizon area) পরিবর্তন আর k  হলো পৃষ্ঠ মহাকর্ষ (Surface gravity)। অন্যদিকে, ভর ও শক্তির সমতুল্যতার কারণে ( এবং c=1 একক ব্যবহার করলে) (২) নম্বর সমীকরণকে আমরা লিখতে পারি

ΔU = k (ΔA) / 8π...................... (2)

আমরা (১) ও (২’) সমীকরণের সাদৃশ্যটি খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি। আর আগেই হকিং এবং কার্টার আলাদাভাবে প্রমাণ করেছিলেন, কৃষ্ণগহ্বরের পৃষ্ঠ মাধ্যাকর্ষণের মান তার দিগন্তের ওপর পরিবর্তন হয় না। এটা থেকে প্রতীয়মান হলো, তাপগতিবিদ্যাতে তাপমাত্রা T যে ভূমিকা পালন করে, কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে k-এর ভূমিকা ঠিক তেমনই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণগহ্বরের দিগন্তক্ষেত্রের মান তার জন্য এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলামাত্রার পরিমাপক হতে পারে।

১৯৭২ সালেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হুইলারের ছাত্র জ্যাকব বেকেনস্টাইন এই শেষ ধারণাটি দিয়েছিলেন। বেকেনস্টাইন এটার পেছনে অবশ্য অন্য যুক্তি দিয়েছিলেন। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে সাম্যবস্থায় কোনো সিস্টেমের এনট্রপি কমতে পারে না, অর্থাত্ (ΔS) > 0।

বেকেনস্টাইনের ভাষ্যমতে, তাহলে কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে এই নীতির লঙ্ঘন ঘটাবে। কারণ, বাইরে থেকে এনট্রপিধারী সিস্টেমকে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ফেলে দিলে বাহিরের এনট্রপির মান কমবে। কারণ, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কী আছে, তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। বেকেনস্টাইন যুক্তি দিলেন, বাইরের বস্তুকে গ্রহণ করলে কৃষ্ণগহ্বরের ভর বাড়বে এবং এর ফলে তার দিগন্তক্ষেত্রের মান বাড়বে। যদি আমরা মেনে নিই, কৃষ্ণগহ্বরেরও এনট্রপি আছে এবং এর মান তার দিগন্তক্ষেত্রের সমানুপাতিক, SBH = αA; তাহলে মোট এনট্রপির পরিবর্তন, যা দুটি এনট্রপির পরিবর্তনের (কৃষ্ণগহ্বরের + বাইরের) মানের যোগফললের মান ঋণাত্মক হবে না। অর্থাত্ (ΔS + ΔSBH ) > 0। কিন্তু এখানে যে যোগসূত্রটি নিখোঁজ ছিল তা হলো বেকেনস্টাইনের প্রস্তাবিত সমানুপাতের ধ্রুবক α-এর মান বের করা। এর জন্য আমাদের হকিংয়ের গবেষণার পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ

হকিংয়ের এই কাজের জন্যই আমরা তাঁর নাম বারংবার উচ্চারণ করি। এই কাজের আগে যা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন, তা মূলত চিরায়ত সাধারণ আপেক্ষিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেটা আমরা ওপরেই বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই অজানা ধ্রুবক α-এর মান কত, তা বের করার জন্য কৃষ্ণগহ্বরবিশিষ্ট স্থান-কালে ভরবিহীন কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের ধর্ম কী? এই প্রশ্নের উত্তর হকিং খুঁজতে লাগলেন। সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বে কোয়ান্টাম ক্ষেত্র কেমন আচরণ করে, তা ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে লিওনার্ড পার্কার গবেষণা করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, এই রকম স্থান-কালের মধ্যে কণা তৈরি হয়ে বিকিরিত হয়। এটা নিয়ে রুশবিজ্ঞানী আন্দ্রেই সাখারভেরও মৌলিক কাজ আছে। হকিং তাঁদের তৈরি কাঠামোটিকেই কৃষ্ণগহ্বরের জন্য প্রয়োগ করলেন। যদিও পার্কারের গবেষণায় স্থান-কালকে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং এ জন্য কণা কেন তৈরি হবে, তারও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়-এটা হকিংয়ের স্থান-কালের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। কারণ, এই শোয়ার্জশিল্ডের কৃষ্ণগহ্বরকে আমরা সময়ের সঙ্গে অপরিবর্তনশীল হিসেবেই মনে করি। কিন্তু হকিংয়ের হিসাবের ফলাফল প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলে। কারণ হিসেবে শেষে দেখা গেল, এখানেই কণার সৃষ্টি আর বিকিরণ ঘটে। কিন্তু যেটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল তা হলো, এই বিকিরণ একদম তাপগতিবিদ্যায় কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের মতো এবং তা প্ল্যাঙ্কের সূত্র মেনে চলে। অর্থাত্, এর আগে যে তাপগতিবিদ্যার যে অনুরূপ সূত্র হকিং ও তাঁর সহকর্মীরা দিয়েছিলেন, তা একটা শক্তভিত্তি পেল। শুধু তা-ই নয়, হকিংয়ের হিসাবে দেখা গেল, কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ তাপমাত্রার মান হবে

T =  k/2π..................................(3)

তাহলে (১) আর (২) সমীকরণের যোগসূত্রে যেটা পাওয়া যায়, তা হলো

S = A/4 .................................. (4)

এই আবিষ্কার হকিংয়ের পুরোপুরি নিজস্ব, এখানে তাঁর কৃতিত্বের কোনো ভাগীদার নেই। হকিংয়ের সমাধিপ্রস্তরে এই সমীকরণই খোদিত হয়েছে; যেমনটা বোলজম্যানের সমাধিতে তাঁর সমীকরণ S = klogW লেখা আছে। এই শেষ সমীকরণটি পদার্থবিজ্ঞানে আরও নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

সৃষ্টিতত্ত্ব

হকিংয়ের গবেষণার পরবর্তী অধ্যায়টি বুঝতে হলে আমাদের পেছনে ফিরতে হবে। এ জন্য এখন আমার দেওয়া পূর্বের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, হকিংয়ের প্রথম কাজের বর্ণনায় ফিরে আসতে হবে। যদিও আজকাল আমরা হকিংয়ের নাম কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে উচ্চারণ করি। হকিংয়ের পরিচিতি শুরু হয় তাঁর পিএইচডির কাজের মাধ্যমে এবং এই শুরুটা সরাসরি কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। তাঁর সেই কাজের গুরুত্ব বুঝতে গেলে আমাদের একটু অতীত ঘাঁটতে হবে। ১৯২০-এর দশকের শেষভাগে এসে এডউইন হাবল মহাবিশ্বের প্রসারণ আবিষ্কার করার পর আইনস্টাইন তাঁর স্থিতিশীল ধারণাকে পরিত্যাগ করেন এবং এরই সঙ্গে তিনি তাঁর প্রস্তাবিত কসমোলজিক্যাল ধ্রুবককেও নির্বাসন দেন। এখন অবশ্য আমরা জানি, আইনস্টাইনের এই দ্বিতীয় পদক্ষেপটি আসলে ঠিক ছিল না। কিন্তু এর জন্য আইনস্টাইনকে দোষও দেওয়া ঠিক না। কারণ, ১৯৯০-এর দশকের আগের পাওয়া পরীক্ষণলব্ধ ফলাফল দেখে এটা বোঝারও কোনো উপায় ছিল না। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে উপস্থাপন করার জন্য যে মডেলটি ব্যবহার করা হচ্ছিল, তার জনক ছিলেন রুশ গণিতবিদ আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান। তার মডেলে মহাবিশ্বের শুরু একটি বিন্দু থেকে এবং লেমিত্রির প্রস্তাব অনুযায়ী ধরে নেওয়া হয়েছিল, সে সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি ছিল। কিন্তু কত বেশি, তার হিসাব ফ্রিডম্যান বা লেমিত্রি কেউ দেননি। কারণ, ঠিক সে সময়ে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান অতটা অগ্রগতি লাভ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো এবং তাঁর সহকর্মীরা এই মডেলটিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মহাবিশ্বে হালকা নিউক্লিয়াস যেমন হাইড্রেজেন, হিলিয়াম ইত্যাদির অনুপাত বের করতে লাগলেন। যুক্তরাজ্যে ১৯৬০-এর দশকে সাধারণ আপেক্ষিকতার চর্চা চলছিল হারম্যান বন্ডি আর ফ্রেড হয়েলরের নেতৃত্বে। কিন্তু তাঁরা ভাবতেন, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সব জায়গায় ঘটছে না; বরং গড়পড়তায় মহাবিশ্বের কোনো পরিবর্তন নেই। তাঁদের বিপরীতে ছিলেন হকিংয়ের পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক ডেনিস সিয়ামা, তিনি এবং তাঁর ছাত্ররা ফ্রিডম্যানীয় মডেলেই আস্থা রেখেছিলেন। এই মডেলটিকে ব্যঙ্গ করার জন্যই ফ্রেড হয়েল ‘বিগ ব্যাং’ নামটি চালু করেন। এখনো এই নামেই সবাই এই মডেলটিকে অভিহিত করে থাকেন। এই মডেলের একটি আপাত ত্রুটি ছিল-এর শুরু স্থান-কালের একটি বিন্দু থেকে। অনেকে এটাকে স্থানের মধ্যে একটি বিন্দু বলে গুলিয়ে ফেলেন, সেটা ঠিক নয়। ওই সময় একটি সোভিয়েত স্কুলের ধারণা ছিল যে এই শুরু একটি বিন্দু থেকে নয়, হয়তোবা কোনো সংকোচনশীল মহাবিশ্ব, যা একটি বিন্দুতে সংকুচিত হতে না পেরে বরং প্রসারিত হচ্ছে, অনেকটা বুলেটের লক্ষ্য মিস করার মতো। হকিং রজার পেনরোজের প্রণীত কৌশল ব্যবহার করে দেখালেন যে মহাবৈশ্বিক বুলেটটির লক্ষ্য মিস করার কোনো সুযোগই নেই, ফলে যাঁরা সম্প্রসারণের অন্যান্য মডেল ব্যবহার করার চিন্তা করছিলেন, তাঁদের বাড়া ভাতে হকিংয়ের এই কাজ পানি ঢেলে দিল-মহাবিশ্বের শুরু ওই একটা স্থান-কাল বিন্দু থেকেই।

কিন্তু এ রকম এক বিন্দুকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা পদার্থবিজ্ঞানী পছন্দ করেন না এবং বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সুষ্ঠু প্রয়োগ এই সমস্যার সমাধান আগেও দিয়েছে। যেমন হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে। কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগের পরে হকিং সৃষ্টিতত্ত্বে সেটার প্রয়োগে মনোনিবেশ করেন। এটা আগেও জন হুইলার ও তাঁর ছাত্ররা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো রকম সাফল্যে আসতে পারেননি। হকিং এর জন্য হুইলারের ছাত্র ফাইনম্যানেরই প্রস্তাবিত পথ ইন্ট্রেগলার কাঠামো ব্যবহার করা শুরু করলেন। হিসাব করা তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছ হলেও এই কাঠামোতে ব্যাখ্যা দেওয়া বেশি পরিষ্কার। কোয়ান্টাম জগতে নিউটনীয় সমীকরণ ব্যবহূত না হওয়ার কারণে সব সম্ভাবনাকেই স্থান দেওয়া যায়। হকিং ও তাঁর সহযোগী জেমস হার্টল ১৯৮৩ সালে এই কোয়ান্টাম সুযোগকে ব্যবহার করে আদি স্থান-কাল বিন্দুসম শুরুকে একটি ত্রিমাত্রীয়

গোলক দিয়ে প্রতিস্থাপন করেন। এটা ওই সময়ে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং কোয়ান্টাম সৃষ্টিতত্ত্বকে একটি নতুন মাত্রা এনে দেন। তবে এটা এবং এর পরবর্তী সময়ের কাজ হকিংয়ের ১৯৭৫ সালের এবং এর আগের পর্যায়ের কাজের সমতুল্য নয়।

আমরা তাহলে দেখতে পাচ্ছি যে হকিং সময়ের সঙ্গে শারীরিকভাবে যতই অক্ষম হয়েছেন, তাঁর গবেষণার ধারা তেমনি আরও নতুন মাত্রা পেয়েছে। আমরা যাঁরা শারীরিকভাবে সক্ষম, তাঁদের জন্য হকিং একই সঙ্গে এক রহস্য আর শিক্ষণীয় উদাহরণ রইবেন। যদি আমরা তাঁর জীবন থেকে দুর্বোধ্য বিজ্ঞানের বিষয় বাদ দিয়েও শুধু তাঁর একাগ্রতা ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তবে ভারসাম্যময় মানুষ হিসেবে আমরা যে ওপরে আসীন হব, সে ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই।

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত