চাঁদে অভিযান

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রাখেন মার্কিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং। দ্বিতীয় নভোচারী হিসেবে চাঁদে নামেন বাজ অলড্রিন। অ্যাপোলো ১১ মিশনের তিন দুঃসাহসী নভোচারীর তৃতীয়জন মাইকেল কলিন্স চাঁদে নামেননি। তিনি অ্যাপোলো ১১ নভোযান নিয়ে রয়ে যান চাঁদের কক্ষপথে। বাকি দুজন ল্যান্ডার ‘ইগল’-এ চড়ে চাঁদে নামেন। তাঁর ছোট্ট এ পদক্ষেপ মানবজাতির জন্য ছিল বিশাল এক অর্জন। আজ চন্দ্রজয়ের ৫৪ বছর পূর্তি।

মানুষের প্রথম চাঁদে নামার রোমাঞ্চকর অভিযান নিয়ে লিখেছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার। চলুন, আজকের এই দিনে আবারও ফিরে তাকানো যাক সেই অভিযানের দিকে।

১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাইয়ের সকাল। যুক্তরাষ্ট্রের কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারের আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা লোকে লোকারণ্য। গত রাত থেকেই কার, জিপ, বাস, নৌকা এমনকি ছোট ছোট বিমানও গাদাগাদি অবস্থা গোটা এলাকায়। অনেকেই ছোট ছোট তাঁবু বা ক্যাম্প খাটিয়ে অস্থায়ী আবাস বানিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচেও আছে বহাল তবিয়তে। হাতে ক্যামেরা, দুরবিন, রেডিও নিয়ে কৌতূহলে অধীর অপেক্ষা আর উত্তেজনার প্রহর গুনছে তারা।

এদের বেশির ভাগই এসেছে আনন্দ-উল্লাস করতে। কেউ কেউ হাতে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে এসেছে মহাকাশ খাতে মার্কিন সরকারের বিপুল অর্থ অপচয়ের বিক্ষোভ-প্রতিবাদ জানাতে। কিন্তু পক্ষ হোক আর বিপক্ষ হোক, সেদিন সেখানে উপস্থিত সবাই জানত, তারা আজ মানবজাতির অনেক বড় এক ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে। এ এমন এক ইতিহাস, যা যুগ যুগ ধরে বলে গেলেও পুরোনো হবে না।

কিছুক্ষণ পরেই দুঃসাহসী তিন নভোচারীকে নিয়ে প্রায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরের চাঁদের পানে ছুটে যাবে অ্যাপোলো-১১ নামের নভোযান। শুধু তা-ই নয়, মানব ইতিহাসে এবারই প্রথম পৃথিবীর বাইরে পা রাখবে মানুষ, চরকা কাটা চাঁদের বুড়ির দেশে পা রাখবে। হ্যাঁ, যন্ত্র নয়, আস্ত জলজ্যান্ত মানুষ। এর মাধ্যমেই সেদিন মহাকাশ প্রতিযোগিতায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে দাঁতভাঙা জবাব দেবে যুক্তরাষ্ট্র। তাই গোটা মার্কিন জাতি (নাকি মানবজাতি) যেন কল্পনার ডানায় সেদিন তিন নভোচারী—নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সের সঙ্গে চাঁদের পথে রওনা হয়েছিল।

স্থানীয় ঘড়িতে সকাল ৯টা বেজে ৩২ মিনিট। কেপ কেনেডির দিগন্তরেখায় আকাশমুখী করে রাখা রকেটের তলদেশে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতে শুরু করল। তীব্র আগুনের হলকার সঙ্গে সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল চারদিক। ধূমকেতুর মতো লেজে আগুনে পুচ্ছ রেখে ধীরে ধীরে আকাশের দিকে ছুটতে শুরু করল স্যাটার্ন ফাইভ রকেট। ক্রমেই বাড়তে লাগল তার বেগ। রকেটটির ওপরের দিকে বিশেষ কায়দায় বসানো হয়েছে কমান্ড মডিউল ও লুনার মডিউল। তার মধ্যেই তখন বসে দাঁতে দাঁত চেপে মহাকর্ষের শক্ত বাঁধন ছিন্ন করছেন তিন নভোচারী।

পৃথিবীর মহাকর্ষের মায়া কাটিয়ে মহাশূন্যে অ্যাপোলো-১১-কে ওঠার দৃশ্য দেখে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ল। কেউ কেউ অবশ্য আবেগের ভার সইতে না পেরে কেঁদে ফেলতেও দ্বিধা করল না। ঠিক তখন রকেটের মাথায় সুরক্ষিত নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে থাকা তিন নভোচারীর উত্তেজনা এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে। কারণ কয়েক বছর ধরে তাঁরা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আসছিলেন। সে জন্য অনেক কঠিন সব প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে কৃত্রিম পরিবেশে। বাস্তবের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণটাই কঠিন ছিল। তাই ভবিতব্য ঘটনাগুলো তাঁদের কাছে মুখস্থই ছিল।

লঞ্চের আগে অ্যাপোলো ১১-কে বহনকারী স্যাটার্ন ফাইভ রকেট

স্যাটার্ন ফাইভ রকেট উৎক্ষেপণের তিন ঘণ্টা পর পৃথিবীর কক্ষপথে এসে রকেট থেকে কলাম্বিয়া ও ইগল আলাদা হয়ে গেল। তারপর দুই নভোযান একত্রে পৃথিবীর কক্ষপথে ছেড়ে চাঁদের পথে তিন দিনের যাত্রা শুরু করল। এই দীর্ঘ যাত্রার শুরুতেই অভিযাত্রীরা কলাম্বিয়ার পেছন থেকে লুনার মডিউল ইগলকে বের করে এনে কলাম্বিয়ার সঙ্গে জুড়ে দিলেন। এরপর দুই মডিউলের মধ্যে তাঁরা প্রয়োজনমতো যাতায়াত করতে লাগলেন। এই দুটো যানের নাম দেওয়া হয়েছে মার্কিন দুই জাতীয় প্রতীকের ওপর ভিত্তি করে। প্রথমটি আমেরিকার নারীরূপ কলাম্বিয়া আর দ্বিতীয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পাখি ইগল।

আগের অ্যাপোলো মিশনগুলো ছিল আসলে এই চূড়ান্ত অ্যাপোলো-১১ মিশনের জন্য স্রেফ প্রস্তুতি এবং মহড়া। তাই এই পথে কীভাবে যেতে হবে, তা অ্যাপোলোর তিন অভিযাত্রী, তথা নাসার জানাই ছিল। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত তাঁরা দুটো মডিউলের নানা যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কি না। শুধু খাওয়া, ঘুম আর পৃথিবীবাসীর সঙ্গে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের সময়টুকু বাদে একটু বিশ্রাম নিতে পারলেন তিন নভোচারী—কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স, লুনার মডিউল পাইলট বাজ অলড্রিন এবং কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং।

মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই দ্য ক্ল্যাশ সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার। সে বইতে তিনি বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষ বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, সব সময়ই আমরা ও তারা, আমাদের ও তাদের দল, আমাদের সভ্যতা ও তাদের বর্বরতা—এ রকম বিভক্ত হতে পছন্দ করে।’ এ রকমই এক বিভক্তি এবং তা থেকে জন্ম নেওয়া চরম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের চাঁদে অভিযানের এই পরিকল্পনা। এটা যতটা না বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে, তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি ছিল রাজনৈতিক। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা—নাসার অ্যাপোলো অভিযান শুরু হয়েছিল আসলে রাশিয়ার (তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের কারণে।

মহাকাশ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রকে একের পর এক হারিয়ে দিচ্ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়ন। মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ পাঠিয়েছিল রাশিয়া (তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)। সেই স্যাটেলাইট যখন পৃথিবীর কক্ষপথে বসে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উড়ে আলোকসংকেত দিচ্ছিল, তখন গোটা মার্কিনবাসীর মুখে মাছি ঢোকার মতো হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। মহাকাশে প্রথম প্রাণী, লাইকা নামের এক কুকুর। সে-ও সোভিয়েত কৃতিত্ব। ১৯৬১ সালে মহাকাশে প্রথম মানুষ, ইউরি গ্যাগারিন। সারা বিশ্বে আবারও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, সেই সঙ্গে সমাজতন্ত্রের। ১৯৬৩-এর ১৬ জুন ভস্তক-৬ নভোযানে চড়ে মহাকাশে যান প্রথম নারী এবং বেসামরিক নাগরিক ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। সে অর্জনও সোভিয়েতের। চাঁদের মাটিতে নামা প্রথম নভোযান লুনা-২। সে কৃতিত্বটাও সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে। পুঁজিবাদী পরাশক্তির নাকের ডগা দিয়ে একের পর এক সমাজতন্ত্রী স্পর্ধা আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়। সেই তুলনায় মার্কিন অর্জন বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই। তারাও মহাকাশে একে একে সবই করেছে। কিন্তু গোটা বিশ্ববাসীর কাছে সেগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পদাঙ্ক অনুসরণ ছাড়া আর কিছু নয়। তাই মহাকাশে পাঠানো প্রথম মার্কিন প্রাণী, প্রথম মার্কিন মানুষ, প্রথম মার্কিন নারীর খোঁজ কিংবা মনে রাখেনি বিশ্ব। মার্কিন প্রশাসন অনেক চেষ্টা করেও মহাকাশে কোনো ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। তবে কি পুঁজিবাদী মার্কিনরা সমাজতন্ত্রের কাছে পদানত? বিশ্ব যে আজ দিকে দিকে সমাজতন্ত্রের জয়গান করছে?

এভাবে মার্কিন জনগণের মনে জমতে লাগল ক্ষোভ আর অপমানের পাহাড়। সেই ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে বেরিয়ে এল ১৯৬০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। মহাকাশ গবেষণায় আরও জোর দেওয়ার কথা বলে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে হটিয়ে নির্বিঘ্নে ক্ষমতার মসনদে বসলেন জন এফ কেনেডি। আসলে মার্কিন জনগণের মনের কথাটা ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন কেনেডি। বুঝতে পেরেছিলেন, মহাকাশ গবেষণায় (বলা ভালো, প্রতিযোগিতায়) সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিতেই হবে যেকোনো মূল্যে। কিন্তু সেটি কীভাবে করা সম্ভব? কারণ, মহাকাশের সবগুলো ক্ষেত্রেই তো এরই মধ্যে প্রথম হয়ে বসে আছে তারা। অনেক আলোচনা আর বাগিবতণ্ডার পর কেনেডি প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিল, একমাত্র চাঁদে মানুষ পাঠিয়েই সোভিয়েত বেয়াড়াপনার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া সম্ভব। তাই ১৯৬১ সালের ২৫ মে কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, এই দশক শেষ হওয়ার আগেই চাঁদের মাটিতে মানুষ পাঠিয়ে তাকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে এই জাতির প্রতিজ্ঞা করা উচিত।’

কেনেডির এই ঘোষণার পরপরই সত্যিকার অর্থে মহাকাশ প্রতিযোগিতার যুগ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকের আপত্তির মুখেও এবার মহাকাশ গবেষণা খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট দেওয়া হয় ১৯৬০ সালে, যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ২৫ শতাংশ। আর এই বাজেট দেওয়া হয় টানা ১০ বছর। অবশ্য একশ্রেণির মার্কিন তাতেও ক্ষোভে ফেটে পড়ল। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন কিছু বিজ্ঞানী ও গবেষক। তাঁদের দাবি, স্রেফ প্রতিযোগিতার নামে অত অর্থ অপচয়ের কোনো মানে হয় না। তার বদলে ক্যানসারসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক গবেষণায় টাকা ঢালা দরকার।

সমালোচনা জমে উঠতেই কেনেডি জবাব দিতে বাধ্য হলেন। জবাবটা দিলেন ১৯৬২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে নাসার মানুষবাহী স্পেসফ্লাইট সেন্টারের উদ্বোধন করতে গিয়ে। তার জবাবে পবর্তারোহী জর্জ ম্যালোরির কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল। ১৯২৪ সালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি মাউন্ট এভারেস্ট উঠছেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, কারণ ওটা যে ওখানেই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল স্টেডিয়ামে সেদিন উপস্থিত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। জনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেনেডি দৃপ্তকণ্ঠে বললেন, ‘অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা চাঁদে কেন যেতে চাই? আমরা কেন এ রকম লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি? তারা হয়তো এটাও জিজ্ঞেস করে বসতে পারে, আমরা সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়ায় কেন উঠি? কেন ৩৫ বছর আগে আটলান্টিক প্লেনে পাড়ি দিয়েছি? এ দশকে আমরা চাঁদে যেতে চেয়েছি, চাঁদে যেতে চেয়েছি, চাঁদে যেতে চেয়েছি।’

ব্যস! কেনেডি কথা শেষ করার আগেই ৪০ হাজার মানুষের তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল গোটা এলাকা। সেই গর্জনে এক তুড়িতেই যেন খড়কুটোর মতো উড়ে গেল চন্দ্র অভিযানের বিপক্ষবাদীরা। সমালোচকদের তখন আর থোড়াই কেয়ার করে কেনেডি প্রশাসন। সাজ সাজ রব পড়ে গেল পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। চাঁদে মানুষ পাঠাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে নাসা। এর সঙ্গে যুক্ত হলো কয়েক লাখ মানুষ। আইজেনহাওয়ারের মেয়াদের শেষ দিকে শুরু হয়েছিল জেমিনি প্রজেক্ট। এমনকি অ্যাপোলো প্রজেক্টের কথাও তখন ভাবা হয়েছিল। তার পালেও এবার তীব্র হাওয়া লাগে। শুরু হয় অ্যাপোলো নামের নতুন প্রজেক্ট। গ্রিকদের আলো, সংগীত ও সূর্যের দেবতার নামেই এমন নাম। নামকরণ করেছিলেন নাসার ম্যানেজার অ্যাবে সিলভারস্টাইন। ১৯৬০ সালের শুরুর দিকে নিজের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় হঠাত্ নামটি দেওয়ার কথা মনে হয় তাঁর। অ্যাবের মনে হয়েছিল, অ্যাপোলো তার রথে চেপে যেভাবে যাতায়াত করে, নাসার প্রস্তাবিত এই বড় ধরনের কর্মসূচির জন্য এর চেয়ে জুতসই নাম আর কিছুই হতে পারে না।

কিন্তু কেনেডি তো ঘোষণা দিয়েই খালাস। যুক্তরাষ্ট্র যখন চাঁদে মানুষ পাঠানোর কথা ভাবছে, তখন তাদের সত্যিকার অর্থেই সে ক্ষমতা ছিল না। আজকের মতো উন্নত কম্পিউটার, রকেট, স্পেসস্যুট, নভোচারীদের খাবার কিংবা অন্যান্য প্রযুক্তির কিছুই ছিল না তাদের। আবার যাত্রাপথে কী কী বাধা মোকাবিলা করতে হবে, কোন পথে, কীভাবে যেতে হবে তারও কোনো হদিস জানা ছিল না মার্কিন বিজ্ঞানীদের। এ রকম আরও অনেক অভাব আর অজানা সত্ত্বেও শুধু প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে মাত্র ৮ বছরের মাথায় যে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা যায়, সেটা মানব ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেটি চাক্ষুষ করে যেতে পারলেন না কেনেডি। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি।

২৭ জানুয়ারি, ১৯৬৭ সাল। তত দিনে আততায়ীর হাতে নিহত ৩৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি। তাঁর স্মরণে ১৯৬৩ সালে ফ্লোরিডায় নাসার রকেট উেক্ষপণ কেন্দ্রের নাম রাখা হলো কেপ কেনেডি। এখান থেকেই অ্যাপোলো প্রজেক্টের প্রথম মানুষবাহী কর্মসূচি শুরু হবে। কিছুদিন পর অ্যাপোলো-১-এ চড়ে পৃথিবীর নিম্নকক্ষপথ পরীক্ষা করে দেখা হবে। আজ দেওয়া হবে তারই মহড়া। এর আগের জেমেনি মিশনগুলোতে সাধারণত এক বা দুজন নভোচারীকে নিয়ে মহাশূন্যে যেত রকেটগুলো। কিন্তু এবার মহাকাশে যাবেন তিন নভোচারী। তাঁরা হলেন ভার্জিল গ্রিসম, এডওয়ার্ড হোয়াইট আর রজার শ্যাফি। রকেটের মাথায় বসানো কমান্ড মডিউলে অভিযানের চূড়ান্ত মহড়া চলছিল। কাজের শুরুতেই হঠাত্ বিদ্যুতের তার থেকে স্ফুলিঙ্গ দেখা দিল। নিয়ন্ত্রণকক্ষে বিশুদ্ধ অক্সিজেন থাকায় মুহূর্তেই দাউ দাউ আগুন ছড়িয়ে পড়ল নিয়ন্ত্রণকক্ষের দাহ্য পদার্থ দিয়ে বানানো বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে। তিন নভোচারী চোখের পলকে পুড়ে স্রেফ কয়লা হয়ে গেলেন।

শুরুতেই এহেন দুর্ঘটনাটা ছিল অ্যাপোলো মিশনের জন্য বড় এক ধাক্কা। অনেকেই আশঙ্কা করেছিল, অ্যাপোলো মিশন বুঝি শুরুতেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তা না হয়ে নাসা আরও দৃঢ় হলো তাদের কাজে। বিজ্ঞানীরা নভোচারীদের নিরাপত্তাব্যবস্থায় আরও কড়াকড়ি করলেন। তারপর থেকে অ্যাপোলো-৬ পর্যন্ত তাঁরা ক্রুবিহীন মিশন পরিচালনা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে নাসা সেফটিসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সে জন্যই অ্যাপোলো-১-এর পরে এই মিশনে আর তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

পৃথিবীর কক্ষপথে অ্যাপোলো-৭ পাঠানো হয় ১১ অক্টোবর, ১৯৬৮ সালে। এক সপ্তাহের বেশি সময় কক্ষপথে থেকে অ্যাপোলো-৭ ফিরে আসে ২২ অক্টোবরে। এ মিশনও ছিল নাসার জন্য এক মাইলফলক। ক্রু মেম্বাররা এতে করে রকেটের সার্ভিস ও কমান্ড মডিউলের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মহাকাশে মেশিনের সঙ্গে মানুষের একসঙ্গে মিলে কাজ করার অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছিল।

অ্যাপোলো-৭-এর সফলতার পর চালানো হয় প্রথম চন্দ্রাভিযান অ্যাপোলো-৮। এটি ছিল অ্যাপোলো প্রজেক্টের দ্বিতীয় মানুষবাহী অভিযান। এই মিশনের সফলতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছিল। এই অভিযানেই প্রথমবারের মতো মানুষ পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে চাঁদের কক্ষপথে যেতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর বাইরে এটাই ছিল সবচেয়ে দূরের কোনো জায়গায় মানুষের যাত্রা। তিন নভোচারী জেমস লোভেল, উইলিয়াম অ্যান্ডার্স এবং কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যানকে নিয়ে ১৯৬৮ সালের ২১ ডিসেম্বরে যাত্রা করে অ্যাপোলো-৮। চাঁদের চারপাশে ১০ বার চক্কর খায় নভোযানটি। তার ৬ দিন পর ২৭ ডিসেম্বর তা পৃথিবীতে ফিরে আসে। এ মিশনটিই পরবর্তী চন্দ্র অভিযানগুলোকে পথ দেখিয়েছিল। অ্যাপোলোর ভবিষ্যত্ কর্মসূচির জন্য চাঁদে অবতরণের সুবিধাজনক জায়গারও খোঁজ চালানো হয় এ অভিযানে। এর মাধ্যমেই নাসা মূলত নেভিগেশন সিস্টেমে অনেক উন্নত করে এবং আরও নতুন কিছু কৌশল রপ্ত করে। তা ছাড়া চাঁদের পৃষ্ঠে পৃথিবীর উদয়ের ছবিও সেবারই প্রথম তোলেন নভোচারীরা।

চন্দ্র অভিযান নিয়ে নাসার ওই তোড়জোড়ের মধ্যে এক বিবৃতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জানায়, চাঁদে অভিযান প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক পাওয়ার চেয়ে তারা সৌরজগতের অন্যান্য জায়গায় যন্ত্রচালিত অভিযান চালাতে চায়। সে উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি ভেনেরা-৬ নামের এক অনুসন্ধানী যান শুক্র গ্রহে পাঠায় তারা। শুক্রের আবহমণ্ডলে প্যারাস্যুটে ভেসে নামতে নামতে রুশ যানটি ৫১ মিনিট ধরে বিভিন্ন তথ্য পাঠাতে থাকে। আসলে রুশ পরিকল্পনা ছিল বিশ্ববাসীকে দেখানো, যুক্তরাষ্ট্র যেটা মানুষ পাঠিয়ে করে, সেটা তারা যন্ত্র পাঠিয়েই কম খরচে সেরে ফেলতে পারে। কিন্তু সেটিই তাদের জন্য শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

১৯৬৯ সালের ৩ মার্চে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে চাঁদে অ্যাপোলো-৯ অভিযান চালায় নাসা। এবারের অভিযাত্রী ছিলেন নভোচারী জেমস ম্যাকদিভিট, ডেভিড স্কট ও রাস্টি শওয়েকার্ট। ১০ দিনের এ অভিযান চালানো হয় পৃথিবীর কক্ষপথে। এতে ভবিষ্যতে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করার জন্য প্রথম মানুষবাহী লুনার এক্সকারসন মডিউল (এলইএম) বা চন্দ্রভেলার পরীক্ষা চালানো হয় মহাকাশে। লুনার মডিউল ও কমান্ড মডিউলের মধ্যে মহাশূন্যে সংযোগ স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া এই মিশনেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন স্পেসস্যুটের পরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১৩ মার্চ পৃথিবীতে ফিরে আসে অ্যাপোলো-৯।

ওই বছরের ১৮ মে চাঁদের কক্ষপথে পাঠানো হয় অ্যাপোলো-১০। এই অভিযানকে বলা যেতে পারে অ্যাপোলো-১১-এর কপি। অ্যাপোলো-১১ মিশনের মাত্র দুই মাস আগের সব ফাংশনালিটি শেষবারের মতো চেক করে নিতে একে পাঠানো হয়। এতে ছিল সার্ভিস ও কমান্ড মডিউল; যার নাম ছিল ‘চার্লি ব্রাউন’। স্নুপি নামে একটা লুনার মডিউলও ছিল এতে। অ্যাপোলো-১০ চাইলে চাঁদে নামতে পারত। কিন্তু তাদের আগে থেকেই কড়াভাবে নিষেধ করা হয়েছিল। তাই কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউল বিচ্ছিন্ন হয়েও চাঁদে নামতে পারেনি। বরং মানবেতিহাসে প্রথমবার চাঁদের সবচেয়ে কাছ থেকে ঘুরে আসেন তিন নভোচারী জন ইয়াং, থমাস স্ট্যাফোর্ড ও জিন কারনান। আসলে এই অভিযানে কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং তারপর আবারও তাদের সংযুক্ত করে পরীক্ষা করে দেখা হয়। ইয়াং কমান্ড মডিউলের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন, তখন ভবিষ্যতে অ্যাপোলো-১১-এর প্রস্তাবিত অবতরণ অঞ্চল দেখে আসেন থমাস এবং জিন। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে তখন তাঁদের দূরত্ব ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৫০০ মিটার।

এভাবেই কেনেডির ঐতিহাসিক ঘোষণার পর দীর্ঘ আট বছরে শেষ হলো চাঁদের অবতরণের সব প্রস্তুতি। এবার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই। মানুষের ইতিহাসে দুঃসাহসিক অভিযানে যাত্রা শুরু করে অ্যাপোলো-১১। রকেটের মাথায় চড়েন তিন নভোচারী—কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স, লুনার মডিউল পাইলট বাজ অলড্রিন এবং কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং।

স্টিফেন কোনিভ আর্মস্ট্রং আর ভায়োলা লুইজ এনজেলের বিয়ে হয় ১৯২৯ সালের ৮ অক্টোবর। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরের বছর ৫ আগস্ট ওহিওর ছোট্ট শহর ওয়াপাকোনেটা থেকে ৬ মাইল দূরের এক খামারবাড়িতে জন্ম নেয় নীল আলডেন আর্মস্ট্রং। বাবা স্টিফেন স্কটল্যান্ডের সীমান্ত এলাকা থেকে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যদিকে তাঁর মায়ের পরিবার এসেছিল জার্মানি থেকে। পেশা অডিটর হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে হরদম ছুটে বেড়াতে হতো বাবা স্টিফেনকে। নীলের ১৪ বছর পার হতে না হতেই মোট ১৬টি শহরে বসবাস করতে হয়েছে পুরো পরিবারকে। তবে নীলের বয়স যখন ১৪, তখন পাকাপাকিভাবে ওয়াপাকোনেটা শহরেই থিতু হয় পরিবারটি।

মাত্র দুই বছর বয়সে নীলকে একবার ক্লিভল্যান্ড এয়ার রেস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা স্টিফেন। তখন থেকেই আকাশে ওড়ার ঝোঁক চাপে নীলের। ছয় বছর বয়সে প্রথম বিমানে চড়ার পর সেই ঝোঁক পরিণত হয় স্বপ্নে। তাই অনেক চেষ্টাচরিত্র করে একসময় স্টুডেন্ট পাইলট লাইসেন্স জোগাড় করে ফেলেন তিনি। সেদিন ছিল তাঁর ১৬তম জন্মদিন। মজার ব্যাপার হলো, তখনো তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়নি। অবশ্য সেটি নেওয়ার তেমন প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। এরপর স্বপ্ন দেখতে থাকেন পেশাদার পাইলট হওয়ার। কিন্তু বাদ সাধে পরিবারের আর্থিক সমস্যা। পেশাদার পাইলট হওয়ার স্বপ্নপূরণের জন্য দরকার ছিল টেকনিক্যাল এডুকেশন। কিন্তু নীলকে কলেজে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। নীল যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন ১৯৪৭ সালে এক সুযোগ এল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য এক স্কলারশিপের ঘোষণা দিল মার্কিন নৌবাহিনী। তবে বিনিময়ে পড়ালেখা শেষে নৌবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সামরিক ক্ষেত্রে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না নীলের। কিন্তু একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাতে আবেদন করেন তিনি। কোনো বাধা ছাড়াই তা অনুমোদনও হলো। তাঁর হাইস্কুলের এক শিক্ষকের পরামর্শে সে সময়ের নামকরা অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল হিসেবে খ্যাত ইন্ডিয়ানা রাজ্যের প্রার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেন নীল। কিন্তু পড়ালেখার মাত্র ১৮ মাসের মাথায় তাঁর পড়ালেখার পাট চুকিয়ে তাঁকে ফ্লোরিডায় ফ্লাইট ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে দিল মার্কিন নৌবাহিনী।

কিছুদিন পরেই শুরু হয় কোরিয়া যুদ্ধ। সে যুদ্ধে নীলের ডাক পড়ল কদিন পরেই। তাই ১৯৫১ সালের ২৮ জুন কোরিয়ার পথে পাড়ি জমালেন তিনি। কোরিয়া যুদ্ধে মোট ৭৮টি যুদ্ধ অভিযান চালাতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৫২ সালের শুরুর দিকে অবশেষে দেশে ফিরতে পারেন তিনি। দেশে ফিরেই নৌবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন নীল। এরপর প্রার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন আবারও। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় জ্যানেট এলিজাবেথ শ্যারোনের সঙ্গে। নীলের বয়স তখন ২২। আর শ্যারোনের ১৮। তাই দুজনের দেহ-মনে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে সময় লাগেনি। তবে মুখচোরা নীল মনের কথাটা সময়মতো জানাতে পারেননি শ্যারোনকে।

১৯৫৫ সালে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েট হন নীল। দ্রুতই ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অ্যারোনটিকসে রিসার্চ পাইলট হিসেবে চাকরিও পাকা হয়ে যায়। এবারের কর্মস্থল ক্যালিফোর্নিয়ার ধু ধু মরুভূমির মধ্যে সান গ্যাব্রিয়েল পাহাড়ের মধ্যে এডওয়ার্ড এয়ার ফোর্সের ঘাঁটিতে।

চাকরি পাওয়ার কদিন পর খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে ইনিয়ে-বিনিয়ে একদিন শ্যারোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন নীল। শুরুতে দোনোমনা থাকলেও কিছুদিন পর রাজি হন শ্যারোন। পরের বছর ২৮ জানুয়ারি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন দুজন। মরুভূমিতে ছোট্ট এক কেবিনে সংসার শুরু হয় নীল আর শ্যারোনের। জুনিপার হিলের সেই কেবিনে না ছিল বিদ্যুত্, না ছিল পানির সরবরাহ। থাকার মধ্যে ছিল যত্রতত্র রুক্ষ জোশুয়া বৃক্ষ আর বিষধর র্যাটল স্নেক। অবশ্য কষ্টকর এই সময়টাকেই জীবনের সবচেয়ে দারুণ সময় বলে পরে উল্লেখ করেছেন নীল। এই দম্পতির ঘরে পরে তিন সন্তান জন্মে। তাঁদের একটি মেয়ে এবং দুই ছেলে রিক ও মার্ক। অ্যাপোলো-১১ মিশনের বেশ আগেই তাঁর মেয়েটি মারা যায়। তবে ছেলে দুটির বয়স তখন যথাক্রমে ১২ ও ৬।

১৯৫৮ সালে প্রথম মানুষবাহী স্পেসফ্লাইট প্রজেক্ট মার্কারি চালু করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬০ সালের দিকে এই প্রজেক্টের জন্য নভোচারী নিয়োগ দিতে এডওয়ার্ড এয়ারফোর্স বেসে লোক পাঠায় নাসা। তবে তাতে নভোচারী হওয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না নীলের। ১৯৬২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ওই প্রজেক্টের নভোচারী জন গ্লেন পাঁচ ঘণ্টার কম সময়ে পৃথিবীকে তিনবার চক্কর খান। এ ঘটনায় একটু নড়েচড়ে বসেন আজন্ম দুঃসাহসী পাইলট নীল। ওই বছরের এপ্রিলের দিকে দ্বিতীয়বারের মতো নভোচারী আহ্বান করা হয়। প্রথম দফায় নভোচারী নেওয়া হয়েছিল সামরিক বাহিনী থেকে। তবে এবার বেসামরিক লোকদেরও সুযোগ দেওয়া হয়। বিমান চালনায় অনেক ভালো অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা থাকলেও আবেদনে নাসা আদৌ সাড়া দেবে কি না, তা নিয়ে একটু দ্বিধাতেই ছিলেন নীল। আবেদনকারীর যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছিল নাসা। আবেদনকারীর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অবশ্যই কলেজ ডিগ্রি থাকতে হবে, ৬ ফুটের বেশি লম্বা হওয়া যাবে না, বয়স ৩৫-এর বেশি হওয়া যাবে না। নীল চোখের ১৬৫ পাউন্ড ওজনের নীল আর্মস্ট্রংয়ের উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। আবার যেকোনো বেসামরিক নাগরিকের চেয়ে বিমান চালনায় তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। তাই তড়িঘড়ি করে আবেদন করে ফেলেন তিনি। সেবার ৯ জন বেসামরিক নাগরিক বাছাই করে নাসা। তাঁদেরই একজন ছিলেন নীল।

ওই বছরের শেষ দিকে হিউস্টনের ৩০ মাইল দূরের গ্যালভেস্টন বে-তে ক্লিয়ার লেকের ম্যানড স্পেসক্র্যাফট সেন্টারের পার্শ্ববর্তী এল লাগোতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৫-তে জেমিনি ৫-এর ব্যাকআপ ক্রু হিসেবে নির্বাচিত হন নীল। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের হিউস্টনে দূরে দাঁড়িয়ে জেমিনি-৫-এর উেক্ষপণ দেখতে হয়েছিল। এরপর জেমিনি-৮-এর ক্রু হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। মহাকাশে প্রথম মার্কিন বেসামরিক নাগরিক হিসেবে কমান্ড পাইলট হিসেবে ১৯৬৬ সালের ১৬ মার্চ মহাকাশে যান নীল। দুটি নভোযানের মধ্যে প্রথমবারের মতো সফলভাবে ডকিং করে দেখা হয় এই মিশনে। সাড়ে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অভিযান শেষ করে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন তিনি।

এরপর তিনি জেমিনি-১১ এবং অ্যাপোলো ৮-এর ব্যাকআপ ক্রু হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে তাঁর জন্য ইতিহাস সৃষ্টি করার চূড়ান্ত সুযোগটি আসে ১৯৬৯ সালের ৯ জানুয়ারি। সেদিন সরকারিভাবে অ্যাপোলো-১১-এর ক্রু হিসেবে নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স এবং বাজ অলড্রিনের নাম ঘোষণা করা হয়। অবশ্য এই মিশনে তিন সদস্যের মধ্যে বাজ অলড্রিন চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয় নাসা। তবে মার্চে এসে হঠাত্ করেই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে নাসা। বাজের বদলে ঐতিহাসিক পদক্ষেপটির জন্য নির্বাচিত হন নীল। এ কারণে নীল আর বাজের মধ্যে ছোটখাটো মন-কষাকষি হয়েছিল বলে শোনা যায়। সেই চিরায়ত বেসামরিক আর সামরিক দ্বন্দ্ব। কারণ, বাজ অলড্রিন উঠে এসেছিলেন সামরিক বাহিনী থেকে।

চাঁদের মাটিতে বাজ অলড্রিন ও নীল আর্মস্ট্রং

নীল আর্মস্ট্রংয়ের চেয়ে মাত্র কয়েক মাস আগে জন্মেছিলেন এডুইন বাজ অলড্রিন—১৯৩০ সালের ২০ জানুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির গ্লেন রিজের মাউন্টেনসাইড হাসপাতালে জন্ম নেন তিনি। তাঁর বাবা এডুইন ইউজিন অলড্রিন সিনিয়র ও মা ম্যারিয়ন অলড্রিন। বাবা ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্মি এভিয়েটর। পরবর্তী সময়ে ওহিওর ম্যাককুক ফিল্ডে আর্মি টেস্ট পাইলট স্কুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাজের মায়ের জন্মও এক সামরিক পরিবারে। তিন ভাইবোনের মধ্যে অলড্রিন সবার ছোট। ছোট বোন ফে অ্যানের বয়স তখন দুই বছর। ছোট ভাইকে ‘ব্রাদার’ বলতে গিয়ে ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পেরে আধো আধো বোলে বলেছিলেন ‘বাজার’। সেই থেকে অলড্রিনের ডাকনাম হয়ে যায় বাজ।

দুই বছর বয়সে বাবার সঙ্গে প্রথম বিমানে চড়েছিলেন চাঁদের মাটিতে পা রাখা দ্বিতীয় মানুষ বাজ। তবে সে যাত্রা খুব একটা সুখকর ছিল না। ১৯৪৭ সালে হাইস্কুল শেষ করে বাবার ইচ্ছায় মিলিটারি স্কুলে যেতে রাজি হন তিনি। বাবার ইচ্ছা ছিল মেরিল্যান্ডের আনাপোলিসের নেভাল একাডেমিতে ভর্তি হোক তাঁর ছেলে। কিন্তু তা না করে নিউইয়র্কের ওয়েস্ট পয়েন্টে মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন তিনি। এখানে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন বাজ। ফাইটার পাইলট হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। নেভাদায় বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ শেষে এফ-৮৬ ফাইটার ইন্টারসেপ্টার চালানো শেখেন তিনি। এরপর ১৯৫১ সালে কোরিয়া যুদ্ধে তাঁকে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে পাঠানো হয়।

১৯৫২ সালের ১ জুলাই যুদ্ধবিরতির পর দেশে ফেরেন বাজ। কোরিয়া যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাঁর বাবার পরিচিত এক মহিলার মেয়ে জোয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। সেবার একটু মন দেওয়া-নেওয়াও হয়েছিল। দেশে ফিরে শুভলগ্ন দেখে জোয়ানকে বিয়ের প্রস্তাব দেন বাজ। কনেও তাতে সাড়া দিতে দেরি করেননি। ১৯৫৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিয়ে করেন দুজন। বিয়ের দুদিন পরই আলাবামার ম্যাক্সওয়েল ফিল্ডে স্কোয়াড্রন অফিসার স্কুলে কাটাতে হয় বাজকে। এরপর তাঁকে কলোরাডোর এয়ারফোর্স একাডেমিতে ডিন হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছয় মাস পর তিনি ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টরের দায়িত্ব পান।

১৯৫৬ সালে জোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিম জার্মানির বিটবার্গে উড়ে যান তিনি। সেখানে এফ-১০০ যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৫৯ সালে আবারও দেশে ফেরেন। এবার সরাসরি যোগ দেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। সেনাবাহিনীতে ক্যারিয়ারের উন্নয়নের জন্য অ্যাস্ট্রোনটিকসে ডক্টরেট করার সিদ্ধান্ত নিলেন বাজ।

চাঁদে অভিযান শুরু করতে ১৯৬১ সালে কেনেডি যখন তাঁর সেই বিখ্যাত ভাষণ দেন, তখন বাজের বয়স ৩০ বছর। তাঁর গবেষণাও বেশ সফলতার সঙ্গে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। পরের বছর ডিসেম্বরে তিনি লাইন অব সাইট গাইডেন্স টেকনিক ফর ম্যানড অরবিটাল রেনডেভি শিরোনামের থিসিস লিখে ফেলেন। সেটি লস অ্যাঞ্জেলেসের এয়ারফোর্সের স্পেস সিস্টেম ডিভিশনে পাঠিয়ে দেন। এই থিসিসের কারণেই তাঁর নাম হয়ে যায় ড. রেনডেভি।

মানুষবাহী চন্দ্র অভিযানের জন্য ক্রুর খোঁজে ১৯৬৩ সালে তৃতীয়বারের মতো বিজ্ঞপ্তি দেয় নাসা। আবেদনপত্র জমা দেন বাজ অলড্রিন। সেবার ১৪ জন নতুন সম্ভাব্য নভোচারী বাছাই করেছিল নাসা। তাঁদের একজন ছিলেন বাজ। এসব নভোচারীর জন্য ম্যানড স্পেসক্র্যাফট সেন্টারের পাশে নাসাও বেতে নতুন বসতি স্থাপন করেছিল নাসা। দুই ছেলে মাইকেল ও অ্যান্ড্রি আর এক মেয়ে জ্যানিসকে নিয়ে সেখানেই জায়গা পায় বাজ পরিবার।

বাজের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে তাকে মিশন প্ল্যানিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে নভোচারী হিসেবে বাছাই করা হলেও অনেক দিন তাঁকে কোনো মিশনে না পাঠানোতে একসময় বিরক্ত হয়ে ওঠেন বাজ। অবশেষে ১৯৬৬ সালে তিনি জেমিনি-১২ মিশনে মহাকাশে যান। সেখানে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিভিন্ন যান্ত্রিক পরীক্ষা চালান তিনি। আর সবুরে মেওয়া ফলার মতো করে ১৯৬৯ সালে যাওয়ার সুযোগ পান অ্যাপোলো-১১ মিশনে।

অ্যাপোলো-১১ চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে যুক্তরাষ্ট্রের সময়সূচি অনুযায়ী, ১৯ জুলাই। পরদিন ২০ জুলাই, অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে যাওয়ার ১০০ ঘণ্টা ১২ মিনিট পরে কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং এবং লুনার মডিউল পাইলট বাজ অলড্রিন কলাম্বিয়া থেকে ইগলে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পরই কলাম্বিয়া থেকে আনডকিং করে ইগল। এবার তাঁদের গন্তব্য চাঁদের পৃষ্ঠ।

এক হিসেবে ইগল ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ এক নভোযান। এটি ছিল ৬৯ মিটার উঁচু আর ব্যাস ছিল ৬৩ মিটার। প্রায় ১ হাজার ৬০০ কেজি ওজনের এই নভোযানের ওপরতলায় দুই অভিযাত্রীর থাকার জায়গা। নভোযানটি এমনভাবে বানানো হয়েছিল, যাতে মহাকাশের তাপমাত্রার চরম তারতম্যেও এর মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে এবং ছোটখাটো দুর্ঘটনাতেও যাতে অকেজো হয়ে না পড়ে।

চাঁদের কক্ষপথ থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে বেশ মসৃণ গতিতে তাঁরা চাঁদের মাটির দিকে নামতে থাকেন। আগের অভিযানে অবতরণস্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল সি অব ট্রাঙ্কুইলিটি। সহজ বাংলায় প্রশান্তি সাগর। ইগলের নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন অলড্রিন। অন্যদিকে নীলের নজর তখন চন্দ্রপৃষ্ঠের দিকে, সুবিধাজনক অবতরণস্থানের খোঁজ করছেন তিনি। চাঁদের অভিকর্ষের টানে ক্রমেই নিচে নামছে ইগল। চন্দ্রপৃষ্ঠে নামতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। এমন সময় একটা বিপদসংকেত বেজে উঠল চন্দ্রভেলায়। নভোযানের কম্পিউটারে এরর দেখাল, যার কোড ১২০২। চাঁদের মাটি থেকে ইগলের দূরত্ব তখন মাত্র ৯ হাজার মিটার। কিন্তু নীল আর্মস্ট্রং কিংবা বাজ অলড্রিনও বুঝতে পারলেন না সেটা কিসের সংকেত। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের গ্রাউন্ড কন্ট্রোলও বুঝতে পারল না সেটি। শেষ পর্যন্ত চাঁদের এত কাছে এসে কি তাঁদের ফিরে যেতে হবে নাকি? একদম শেষ সময়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা আরেক বিপদ ডেকে আনতে পারে। ঠিক সে সময় মিশন কন্ট্রোল তাদের ম্যানুয়ালে আঁতিপাঁতি করে ১২০২ এরর কোডের মানে খুঁজে চলেছে। এর মধ্যেই দ্বিতীয় আরেকটি বিপদসংকেত বেজে উঠল ইগলে। মিশন কন্ট্রোলের তখন তীব্র উত্তেজনায় মাথার চুল ছেঁড়ার জোগাড়। কিন্তু কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।

ইগলের দুই অভিযাত্রীর মাথায় তখন অন্য চিন্তা। গোটা পৃথিবী এখন তাঁদের দিকেই চেয়ে আছে। তাঁরা যেন নীরবে বলে যাচ্ছেন, যেকোনো মূল্যেই হোক চাঁদের মাটিতে নেমে মিশন শেষ করতে হবে। মিশন কন্ট্রোল থেকেও এ সময় আগের প্ল্যানমতো অভিযান শেষ করার নির্দেশ এল।

ইগলের সারি সারি কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে অলড্রিন যখন বোঝার চেষ্টা করছেন, বিপদসংকেতটা কম্পিউটার সফটওয়্যারের কোনো ত্রুটি কি না, তখন নীল আর্মস্ট্রং পড়েছেন আরেক বিপদে। বিপদসংকেত নিয়ে দুজনের উত্কণ্ঠা আর ব্যস্ততার মধ্যেই তাঁদের আগে থেকে নির্ধারিত অবতরণস্থান থেকে বেশ কিছুটা পেরিয়ে গেছেন তাঁরা। নিচে এখন যে জায়গা দেখা যাচ্ছে, সেখানে নামলে চাঁদের মাটিতে ইগল আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হবে। তাতে চাঁদের বুকে স্রেফ ছাতু হয়ে যাবেন তাঁরা দুজন।

ওদিকে ফুয়েল ইন্ডিকেটরে দেখা যাচ্ছে, চাঁদের মাটিতে নামার জন্য ইগলের জ্বালানি ট্যাংকে আর মাত্র এক মিনিটের জ্বালানি রয়েছে। এর মধ্যেই তাঁদের সেখানে নামতে হবে, নয়তো ফিরে যেতে হবে। অবশ্য চাঁদের এত কাছে এসে ফিরে যাওয়াটাও চাট্টিখানি কথা নয়। সেখানেও বিপদ ঘটতে পারে। চন্দ্রপৃষ্ঠ আর ইগলের মাঝখানের দূরত্ব তখন মাত্র ১০০ মিটার বাকি। ঠিক এ সময় নীল আর্মস্ট্রং ইগলের জানালা দিয়ে অবতরণের জন্য একটি জায়গা তড়িঘড়ি করে ঠিক করে ফেললেন। নামার জন্য আর মাত্র ৩০ সেকেন্ডের জ্বালানি বাকি থাকতেই বাজ অলড্রিন চাঁদের ধূসর বুকে মোটামুটি মসৃণ এক জায়গায় অবতরণ করতে শুরু করলেন। মাটির কাছে যেতে না যেতেই ইগলের ইঞ্জিন থেকে তীব্র বেগে বেরিয়ে আসা গ্যাসের ধাক্কায় চারদিকে চাঁদের ধুলো ধূসরিত হয়ে উঠল।

শেষ কয়েক মিটার অবতরণে ইগলের ভাগ্যে কী ঘটল, সে বিষয়ে পুরোটাই অন্ধকারে রইলেন নীল আর বাজ। তাঁরা কি আদৌ চাঁদের মাটিতে নামতে পেরেছেন? চাঁদের মাটিতে ইগলের পা যদি নিরাপদে অবতরণ করে, তাহলে কন্ট্রোল প্যানেলে নীলরঙা কন্টাক্ট লাইট জ্বলার কথা। সেই আলো জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় রইলেন দুই অভিযাত্রী। কয়েক সেকেন্ড সময়কেও তাঁদের কাছে অনন্তকাল বলে মনে হলো। অবশেষে নীলরঙা আলো জ্বলে উঠল। মানে তিনপেয়ে ইগল শেষ পর্যন্ত চাঁদের মাটিতে নামতে পেরেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন দুই অভিযাত্রী। শ্বাস নিতে পারলেন হিউস্টনের কন্ট্রোল সেন্টারের কর্মীরাও। বাংলাদেশ সময় তখন ২১ জুলাই, ১৯৬৯; রাত সোয়া দুইটা। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সময় তখনো ২০ জুলাই।

কিন্তু এখানেই পিছু ছাড়ল না বিপত্তি। তৃতীয়বার বিপদ দেখা দিল, যখন অবতরণের পর জ্বালানি লাইনে বরফ জমাট বেঁধে বন্ধ হয়ে গেল। সমস্যা হলো, এতে জ্বালানি লাইনে চাপ বাড়তে বাড়তে একসময় তা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর সত্যি সত্যিই যদি তাই ঘটে তাহলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হয়তো নীল আর বাজকে বাকি জীবন চাঁদের মাটিতেই কাটাতে হবে। কারণ, তখন চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ইগল আর উেক্ষপণ করতে পারবে না। তবে অভিযাত্রীদের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। লাইনটা ফেটে বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই তাঁরা সেটা পরিষ্কার করে ফেলতে পারলেন। এভাবে পরপর তিনবার বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন নীল আর বাজ।

আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, চাঁদে অবতরণের পর নীল আর বাজ কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেবেন। তারপর নামবেন চাঁদের নির্জন সাদাকালো ভূমিতে। কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টির এত কাছে এসে চোখে কি আর ঘুম আসে? দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না দুই অভিযাত্রী। তবে আধো ঘুম, আধো জাগরণে তাঁরা ইগলের দোতলায় বিশ্রাম নিলেন ঘণ্টা চারেক। অতঃপর ঘনিয়ে এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

আজকের দিনের সঙ্গে তুলনা করলে ১৯৬৯ সালের যোগাযোগের প্রযুক্তি ছিল অনেক অনেক গুণ পিছিয়ে। ফেসবুক, ইউটিউবে লাইভ দেখা কিংবা ঘরে ঘরে টিভি সেটও ছিল না। একমাত্র সম্বল ছিল রেডিও। আর গুটিকয়েক মানুষের হাতে সেদিন ছিল টেলিভিশন। তাই অনেকেই সেদিন বসে ছিলেন রেডিওর সামনে। ধারা বিবরণী শুনছিলেন। কেউ কেউ দুরবিন তাক করে চাঁদের পৃষ্ঠে নভোচারীদের দেখার কসরত করছিলেন। কিন্তু এত দূর থেকে তা তো সম্ভব নয়। পৃথিবীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ তখন হাঁ করে টিভি সেটের সামনে বসে আছে। এই দলে ঢাকার কিছু মানুষও ছিল। ঢাকায় তখন সাদাকালো টেলিভিশন এসেছে। প্রতিবেশী ভারতের দিল্লিতে এলেও কলকাতায় তখন কোনো টিভি ছিল না।

যাহোক, টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারে ইগলের নিচের দিকে সেট করা একটি ক্যামেরা থেকে পাঠানো ছবিতে ইগল থেকে বেরিয়ে আসার মই দেখা গেল। একটু পরেই দৃশ্যপটে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল নভোচারীর সাদা পোশাক পরিহিত আর্মস্ট্রংকে। সেই সঙ্গে বহু পথ পেরিয়ে আসছে তাঁর যান্ত্রিক কণ্ঠ। মই থেকে নামার প্রথম ধাপে পা রাখলেন নীল আর্মস্ট্রং। গোটা বিশ্ববাসী যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেল। একটি একটি করে ধাপ বেয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসতে লাগলেন নীল। নয়টি ধাপের মইয়ের শেষটিতে এসে কী ভেবে একটু থামলেন তিনি। একটু কি ভয় পেলেন? হাজার হোক পৃথিবীর বাইরের অচেনা-অজানা জায়গা বলে কথা। অজানা এক ভয় পাচ্ছিলেন সেদিন টিভি সেটের সামনে বসে থাকা দর্শকেরাও।

নিজের বাড়িতে বসে সে সময় অন্যদের সঙ্গে গভীর আগ্রহ নিয়ে টিভির সামনে বসে ছেলের দুঃসাহসী চন্দ্রজয়ের দৃশ্য দেখছিলেন মা ভায়োলা আর্মস্ট্রং। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওর ওয়াপাকোনেটায় এই বাড়িতেই শৈশব কেটেছিল নীল আর্মস্ট্রংয়ের। এই বাড়ি থেকেই রাতের আকাশে তাকিয়ে একসময় আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। ভায়োলা আর্মস্ট্রংয়ের একবার ভয় হলো, চাঁদের মাটি হয়তো খুবই নরম। ঠিক পনিরের মতো। নীল ওখানে পা রাখতেই হয়তো চোখের পলকে চাঁদের গভীরে তলিয়ে যাবে। কিন্তু চাঁদের অভিকর্ষ বলের তারতম্যের কারণে নীলের ওজন তখন পৃথিবীর ওজনের (১৬৫ পাউন্ড) তুলনায় কমে গেছে ছয় ভাগ।

অবশ্য চাঁদের মাটিতে নেমে যদি সত্যিই কোনো ভয়ংকর বিপদ ঘটে, তাহলে কী হবে? যদি আর্মস্ট্রংদের নভোযান পুরোপুরি বিকল হয়ে যায়? যদি তাঁরা আর কোনো দিন পৃথিবীতে ফিরে আসতে না পারেন? প্রবাদ আছে, ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই নাকি বুদ্ধিমানের কাজ। নাসাও এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল। এমন বিপদ যে ঘটতে পারে, তা অভিযানের অনেক আগেই ভেবে রেখেছিল নাসা এবং মার্কিন প্রশাসন। সম্ভাব্য সে বিপদের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল তারা। কোনো কারণে যদি ইগল বিকল হয়ে যেত, তাহলে নীল আর বাজ তাঁদের পিঠের অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করে সর্বোচ্চ কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারতেন। তারপরই ঘটত অসহায়ের মতো ধুঁকে ধুঁকে ঐতিহাসিক মৃত্যু। কারণ, তাঁদের উদ্ধারেরও কোনো আশা ছিল না। সে জন্য পৃথিবী থেকে খ্রিষ্টধর্মমতে নীল আর বাজের মহাকাশীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একজন পাদরিকে ঠিক করে রাখা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন টেলিভিশনে তাত্ক্ষণিক জাতির উদ্দেশে প্রচারের জন্য এক টিভি ভাষণ রেকর্ড করে রেখেছিলেন। সম্প্রতি জানা গেছে ওই ভাষণে নিক্সন বলেছিলেন:

‘শুভ সন্ধ্যা, আমার সাথি আমেরিকাবাসী। আজ রাতে সব আমেরিকানের জন্য এবং সারা বিশ্বের সব মানুষের জন্য গভীর এক উদ্বেগের কথা বলতে চাই আমি। চাঁদে শান্তিপূর্ণ অনুসন্ধানে যাওয়া মানুষের ওপর দুর্ভাগ্য হস্তক্ষেপ করেছে। তাঁরা এখন চাঁদে মাটিতে শান্তিতে বিশ্রাম নেবেন। নীল আর্মস্ট্রং এবং এডওয়ার্ড অলড্রিন নামের এই দুই সাহসী পুরুষ জানেন, তাঁদের উদ্ধারের আর কোনো আশা নেই। কিন্তু তাঁরা এটাও জানেন, তাঁদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য এখনো আশা আছে।’

সৌভাগ্যই বলতে হবে, ভিডিওটি শেষ পর্যন্ত টিভিতে সম্প্রচারের প্রয়োজন পড়েনি। ইগলের মই বেয়ে চাঁদের মাটিতে বেশ নিরাপদেই নামতে পারেন নীল। চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রেখে তিনি স্মরণীয় সেই উক্তিটি করলেন, ‘দ্যাটস ওয়ান স্মল স্টেপ ফর (আ) ম্যান, ওয়ান জায়ান্ট লিপ ফর ম্যানকাইন্ড।’ ব্যস, চাঁদের মিহি ধুলোয় নিজের পায়ের ছাপ এঁকে দিলেন নীল। এর মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন চাঁদের মাটিতে পা রাখা প্রথম মানুষ।

অবশ্য চাঁদে নেমে আর্মস্ট্রং যে হঠাত্ করে উক্তিটি করেছেন, ঘটনা কিন্তু তা নয়। আসলে এ সময় আর্মস্ট্রং কী বলবেন, কী করবেন তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল নাসা। আবার তাঁর বলা ওই উক্তি নিয়ে সে সময় কিছু বিতর্কেরও জন্ম হয়েছিল। এক দল দাবি করেন, আর্মস্ট্রং ‘আ’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তাতে উক্তিটির অর্থ পাল্টে যায়। অন্য দল বলেন, তিনি ঠিকই ‘আ’ উচ্চারণ করেছিলেন, কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে তা শোনা যায়নি।

যাহোক, নীল যখন চাঁদের বুকে নেমেছেন, তখন চাঁদের আকাশে সূর্য নিচের দিকে ঢলে পড়েছে। সেই রোদে ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি নীলের ছায়ার দৈর্ঘ্য দীর্ঘায়িত দেখা গেল চাঁদের ধূসর মাটিতে। নিজের পাক্কা ৩৫ ফুট লম্বা ছায়া দেখে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় ২০ মিনিট পর নীল আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে চন্দ্রপৃষ্ঠে যোগ দেন বাজ অলড্রিন। সেখানে নেমে চোখের সামনে মরুভূমির মতো নির্জন, উষর চন্দ্রপৃষ্ঠ দেখে তিনি বলে ওঠেন, ‘চমত্কার দৃশ্য। অসাধারণ নির্জনতা।’

এ কথাটাও আগে থেকেই শেখানো-পড়ানো কি না কে জানে। তবে চাঁদে নেমে কী করতে হবে, তা আগেই নির্ধারিত ছিল। তাই এক মুহূর্ত দেরি না করে কাজে নেমে পড়লেন নীল আর বাজ। প্রথমেই এদিক-ওদিক ঘুরে দেখেন তাঁরা। কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি বসান চাঁদের মাটিতে। এর কারণে পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যবর্তী দূরত্ব সেন্টিমিটার পরিসরে নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা গিয়েছিল। চাঁদে মানুষের প্রথম পা রাখার ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি ধাতব ফলকও স্থাপন করেন নীল আর বাজ। ফলকটিতে খোদাই করে লেখা ছিল, ‘জুলাই, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে, এখানে পৃথিবী থেকে মানুষ এসে প্রথম চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন। সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলাম আমরা।’

এসব ছাড়াও চন্দ্র অভিযানে নিহত হতভাগ্য অভিযাত্রীদের স্মরণে চাঁদের মাটিতে রাখা হয় গ্রিসম, হোয়াইট, শ্যাফির ব্যবহূত পোশাকের অংশ। আর ছিল দুটি মেডেল। মেডেল দুটি ছিল রুশ নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন ও ভ্লাদিমির কোমারভের। এ ছাড়া রাখা হয় একটা সিলিকন ডিস্ক ও জলপাইগাছের ডাল। সিলিকন ডিস্কে খোদাই করে রাখা হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার, কেনেডি, জনসন এবং নিক্সনসহ বিশ্বের ৭৩টি দেশের রাষ্ট্রনেতার শুভেচ্ছাবার্তা। আর শান্তির প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছিল জলপাইয়ের ডাল। চাঁদকে এত কিছু দেওয়ার পর আসে সেখান থেকে কিছু নেওয়ার পালা। হাতে তখন সময়ও বেশ কম। ক্রমেই ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছে। তাই এবার চাঁদ থেকে স্মারক হিসেবে তড়িঘড়ি করে নীল বা বাজ তুলে নেন প্রায় ২২ কিলোগ্রাম ওজনের চাঁদের পাথর ও মাটি। সেগুলো ঠিকমতো তালিকা করার সময় পাননি তাঁরা। খরচের হিসাব করলে, প্রতি গ্রাম চাঁদের মাটি ও পাথর সংগ্রহ করতে লেগেছিল মাত্র এক লাখ ডলার।

এর আগে ১৯৫৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চাঁদে লুনা-২ নামের নভোযান পাঠিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেটিই ছিল মানুষের তৈরি চাঁদে পাঠানো প্রথম কোনো বস্তু। দুদিন পর সেকেন্ডে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার বেগে তা আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল চাঁদের পাথুরে মাটিতে। তবে সেবার কাজের কাজ যেটি হয়েছিল তা সোভিয়েতবাসীর জন্য বেশ গর্বেরই বটে। লুনা-২-এর গায়ে আঁকা সোভিয়েত প্রতীক হাতুড়ি-কাস্তে আর সিসিসিপি লেখাটা দিব্যি টিকে ছিল চাঁদের বুকে। আরও পরে ১৯৬৬ সালে চাঁদের বুকে নিয়ন্ত্রিতভাবে লুনা-৯ নামিয়েছিল রুশরা। বলা বাহুল্য, তাতেও সমাজতন্ত্রী মার্কা প্রতীক আঁকা ছিল। কাজেই চাঁদের বুকে মার্কিনদের এমন কোনো প্রতীক চাই। সে কারণে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোঁতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মার্কিন নিক্সন প্রশাসন। তাই এবার চাঁদের মাটিতে মার্কিন পতাকা স্থাপন করার পালা। অ্যাপোলো-১১ অভিযানের আগে এই পতাকা পোঁতা নিয়েও ছিল অনেক তর্কবির্তক। চাঁদে বাতাস নেই। কাজেই সেখানে পতপত করে পতাকা উড়বে না। সে কারণে আগে থেকেই পতাকায় কড়া মাড় দিয়ে কড়কড়ে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। আবার পর্দার মতো টানটান করে রাখার জন্য দুদিকে দুটো রডও গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এত কাণ্ডের পরও শেষ পর্যন্ত সেই পতাকাকে চাঁদের মাটিতে অনড় রাখা যায়নি। চাঁদের পৃষ্ঠ খুবই শক্ত ছিল। তাই অনেক চেষ্টা করে পতাকার দণ্ডটি মাত্র কয়েক ইঞ্চি পুঁততে পেরেছিলেন নীল। সে কারণে ইগল চাঁদের মাটি ছেড়ে যাওয়ার সময় ইঞ্জিন থেকে প্রবল বেগে বেরিয়ে আসা গ্যাসের ধাক্কায় সে পতাকা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

চাঁদের মাটিতে প্রায় দুই ঘণ্টা কাটানোর পর নির্ধারিত সময়ে ইগলে চড়ে বসেন নীল আর বাজ। এবার তাঁদের গন্তব্য চাঁদের কক্ষপথে ঘূর্ণমান কমান্ড মডিউল। সেখানেই তাঁদের জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছেন কমান্ডার মাইকেল কলিন্স।

তখন কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স কলাম্বিয়াকে চাঁদের কক্ষপথে চালিয়ে যাচ্ছেন। নিঃসঙ্গ, একা। এরই মধ্যে চাঁদের চারপাশে ১২ বার পাক খেয়েছেন তিনি। মৃদু একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দ ছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। সেই সময়ের অনুভূতি কলিন্স বর্ণনা করেছেন তাঁর ক্যারিয়িং দ্য ফায়ার নামের আত্মজীবনীতে। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছেন, প্রতিবার তিনি যখন চাঁদের উল্টো পিঠে যাচ্ছিলেন, তখন পৃথিবীর সঙ্গে সব যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ‘আমি তখন সত্যিকার অর্থেই একা। সত্যিকারের কোনো জীবন্ত সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন।’

চাঁদের এই ঐতিহাসিক অভিযানে যে তাঁকে এভাবে নিঃসঙ্গই থাকতে হবে, তা তো আগে থেকেই জানতেন তিনি। অ্যাপোলো-১১-এর অভিযাত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কলিন্সকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর দুই সঙ্গী যখন চাঁদের মাটিতে ঘুরে বেড়াবে, তখন তাঁকে নিঃসঙ্গ ঘুরতে হবে চাঁদের কক্ষপথে। সে কারণে তিনি হতাশ কি না। কলিন্স জবাবে সোজাসাপ্টা বলেছিলেন, ‘আমি যদি বলি যে তিনটি সিটের মধ্যে আমার সিটটাই সবচেয়ে ভালো, তাহলে সেটা মিথ্যা বলা হবে, নয়তো বোকার মতো কথা হবে। কিন্তু এই অভিযানে তিনটি সিটই গুরুত্বপূর্ণ। আমিও চাঁদের মাটিতে নামতে চাই, কে না চায়? কিন্তু এই সমন্বিত অভিযানের একটা অংশ আমি। সবকিছু সত্ত্বেও এ অভিযানে যেতে পেরে আমি খুশি। অভিযানের ৯৯.৯ শতাংশ পথ আমি যাব, কিন্তু তাতে আমি মোটেও হতাশ নই।’ এই হলেন অ্যাপোলো-১১-এর আত্মত্যাগী অভিযাত্রী মাইকেল কলিন্স।

কলিন্সের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে নয়, ইতালির রোমে—১৯৩০ সালের ৩১ অক্টোবর। মার্কিন সেনা কর্মকর্তা জেমস লটন কলিন্সের চার সন্তানের মধ্যে মাইকেল কলিন্স ছিলেন দ্বিতীয়। মা ভার্জিনিয়া স্টুয়ার্টের পরিবার আয়ারল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসতি গড়েছিলেন। জন্মের পর প্রথম ১৭ বছর বাবার চাকরির কারণে বিভিন্ন দেশে ঘুরতে হয়েছিল কলিন্সকে। তাঁর জন্মের সময় রোমে দায়িত্ব পালন করছিলেন জেমস লটন কলিন্স।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁরা রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে যান। সেখানে ১৯৪৮ সালে স্কুল শেষ করেন কলিন্স। ১৯৫২ সালে মিলিটারি সায়েন্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। উন্নত ফাইটার বিমান চালানোর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে নেভাদা এয়ারফোর্স ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া পারমাণবিক বোমা হামলা চালানোরও প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ফ্রান্সে ন্যাটো ঘাঁটিতে এফ-৮৬ ফাইটার স্কোয়াড্রনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় তাঁকে। এর দুই বছর পর সেখানে প্যাট্রিসিয়া ফিননেগান নামের এক বেসামরিক কর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। তার কিছুদিন পরেই দুজনের বাগ্দান অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৭ সালের ২৮ এপ্রিল দুজন বিয়ে করেন। এর কয়েক মাস পর তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। তাঁকে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬০ সালে এডওয়ার্ড এয়ারফোর্স বেসে এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট পাইলট স্কুলে যোগ দেন তিনি।

সম্ভাব্য নভোচারীর খোঁজে ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় দফায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নাসা। সেবার আবেদন করেন কলিন্স। তবে তাঁর আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালে নাসার তৃতীয় দফায় বিজ্ঞপ্তিতেও আবেদন করেন তিনি। ১৪ জনকে বাছাই করে নাসা, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কলিন্স। এরপর বাজ অলড্রিনের মতো কলিন্সের পরিবার ছেলে মাইকেল এবং ক্যাথলিন ও অ্যান নামের দুই মেয়েকে নিয়ে নাসাও বেতে চলে যায়।

তাঁর বাড়িটা ছিল অলড্রিনের বাড়ির কাছেই। স্বভাবতই বাজের সঙ্গে তাঁর সখ্যও ছিল একটু বেশি। তাই চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে ফিরে ইগল আর কলাম্বিয়ার সফল ডকিং শেষে বাজের সঙ্গে যখন কলিন্সের দেখা হলো, তখন ভীষণ আবেগে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। একটু হলেই বাজের কপালে চুমুই দিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর আর্মস্ট্রংকেও জড়িয়ে ধরেন কলিন্স।

কোনো দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াই অ্যাপোলো-১১-এর অভিযান ১০০ ভাগ সফল হলো। এবার ঘরে ফেরার পালা। বিজয়ীর বেশে পৃথিবীর পথে ফিরতে শুরু করেন তিন অভিযাত্রী। তিন দিন পর, ২৪ জুলাই তাঁদের যান পৃথিবীর কক্ষপথে ফিরে আসে। তার কিছু পরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে নেমে আসে তিনটি প্যারাস্যুটে ভর করে। পৃথিবী থেকে রওনা দেওয়ার প্রায় ১৯৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট পর ফিরে আসেন তাঁরা। মার্কিন নৌতরী ইউএসএস হর্নেট তাঁদের হাওয়াই উপকূল থেকে উদ্ধার করে আনে।

দেশে ফিরে বীরের সম্মান পেলেন তাঁরা। অবশ্য চাঁদের বুক থেকে কোনো অজানা জীবাণু তাঁদের সঙ্গে এসেছে কি না, তা পরীক্ষা করতে একটি বদ্ধ ঘরে তাঁদের তিন সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এরপর তাঁরা বিশ্বভ্রমণে বের হন। সেটা অবশ্য মার্কিন বিজয় ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিতেই আয়োজন করেছিল মার্কিন প্রশাসন। তাঁদের সেই ভ্রমণ তালিকায় ঢাকা শহরও ছিল। এভাবেই রুশ-মার্কিন ঠান্ডা লড়াইয়ে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সোভিয়েত ইউনিয়ন চাঁদে মানুষ পাঠাল না কেন। আসলে তত্কালীন রুশ প্রেসিডেন্ট বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে কাজ মানুষ পাঠিয়ে করে, সেই একই কাজ তারা যন্ত্র পাঠিয়েই সেরে ফেলতে পারে। অ্যাপোলো-১১ অভিযানের একই সময়েই চাঁদে লুনা-১৫ পাঠিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে সেটি সফলভাবে অবতরণ করতে পারেনি। যন্ত্র পাঠানোর আইডিয়াটা যে বেশ ভালো, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটি করতে গিয়েই বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিযোগিতায় স্রেফ গোহারা হেরে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। কারণ, হিমালয়চূড়ায় মানুষের পা ফেলা যে শিহরণ জাগায়, যে রোমহর্ষ রোমাঞ্চের জন্ম দেয়, দুঃসাহসী হওয়ার যে প্রেরণা জোগায়, যন্ত্র পাঠিয়ে তা পাওয়া সম্ভব নয়। চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রংয়ের পায়ের ছাপ আমাদের মনে সেই শিহরণ জাগায়।

এরপর আরও পাঁচবার চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে নাসা। এরপর আরও ১০ জন চাঁদের বুকে পা রেখেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ শুধু প্রথমকেই মনে রাখে। হিমালয়ের দুর্গম চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট কত মানুষ প্রতিদিন জয় করছে, সে খবরে মানুষের কিছু যায় আসে না। কিন্তু এভারেস্টে প্রথম পা রাখা এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের কথা আমাদের মনে গেঁথে আছে। সে কারণেই মার্কিন প্রথম নভোচারীকে বিশ্ববাসী মনে রাখেনি, মনে রেখেছে বিশ্বের প্রথম নভোচারী ইউরি গ্যাগারিনকে। সে একই কারণে নীল আর্মস্ট্রংয়ের কথা মানুষ ভুলবে না অনেক অনেক দিন। একই কারণে নাসার অন্যান্য চন্দ্র অভিযানের চেয়ে অ্যাপোলো-১১-এর অভিযান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জীবন বাজি রেখে নীল, বাজ আর কলিন্স ৫০ বছর আগে যে দুঃসাহসী অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, তা এখনো বিশ্ববাসীর কাছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই একুশ শতকে মঙ্গল অভিযানের দোরগোড়ায় এসেও তার গুরুত্ব ম্লান হয়নি এতটুকু। মঙ্গল গ্রহে পা দেওয়ার আগ পর্যন্ত তা-ই থাকবে, সে প্রত্যাশা বেশ জোরের সঙ্গেই করা যায়।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: অ্যাপোলো-১১, ডেভিড হোয়াইট হাউস, আইকন বুকস, যুক্তরাজ্য (২০১৯)

১৯৬৯: দ্য ইয়ার এভরিথিং চেঞ্জড, রব কির্কপ্যাট্রিক, স্কাইহর্স পাবলিশিং,

যুক্তরাষ্ট্র (২০০৯)

ক্যারিয়িং দ্য ফায়ার: অ্যান অ্যাস্ট্রোনাটস জার্নি, মাইকেল কলিন্স, এফএসজি, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯

মহাকাশে মানুষ, প্রদীপচন্দ্র বসু, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা (২০১৫)

বিবিসি স্কাই অ্যাট নাইট ম্যাগাজিন (আগস্ট ২০১৯)

লাইফ ম্যাগাজিন: মুন ল্যান্ডিং (২০১৯)

লাইফ ম্যাগাজিন: নীল আর্মস্ট্রং (২০১৯)

বিজ্ঞানচিন্তা (জুলাই ২০১৯)

দেশ পত্রিকা (১৭ জুলাই ২০১৯)

আনন্দমেলা (৫ জুলাই ২০১৯)

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত