মঙ্গলের টুকরো পৃথিবীতে এল কীভাবে?

খসে পড়ে তারা বা শুটিং স্টারআন্দ্রেজেয ওজকিকি, গেটি ইমেজ

পৃথিবীতে উল্কাপাত খুবই সাধারণ ঘটনা। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার উল্কাপাতের ঘটনা সম্পর্কে মানুষ জানতে পেরেছে। বিশাল সংখ্যক এই উল্কাপিণ্ডের কিছু এসেছে মঙ্গল গ্রহ থেকে, এমনটাই মনে করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু মঙ্গলের টুকরোগুলো পৃথিবীতে এল কীভাবে? তারচেয়েও বড় কথা, বিজ্ঞানীরা কীভাবে বুঝলেন উল্কাপিণ্ডগুলো মঙ্গলেরই অংশ?

এই প্রশ্নের উত্তর জানব। তবে তার আগে উল্কা জিনিসটা কী, তা জেনে নেওয়া যাক।

মহাকাশে যেমন গ্রহ-নক্ষত্রের মতো বিশাল আকারের ও স্থির কক্ষপথের বস্তু আছে, তেমনি আছে অসংখ্য গ্রহাণু—ছোট-বড় পাথরের টুকরো। এসব পাথরের টুকরো অনেক ছোটও হতে পারে। এদের কোনো নির্দিষ্ট কক্ষপথ নেই। হঠাৎ কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতুর ধাক্কা খেয়ে এসব পাথরের টুকরো ছুট দেয় ধাক্কার দিক বরাবর। পৃথিবীর দিকে যেসব পাথর ছুটে আসে, সেগুলো একটা সময় এসে ঢুকে পড়ে পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মাঝে। এরপর পৃথিবীর মহাকর্ষের টানে পাথর টুকরোর গতি বাড়তে থাকে। উচ্চ গতির কারণে বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এলে মহাজাগতিক পাথর টুকরোটি জ্বলে ওঠে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, আকাশ থেকে বুঝি জ্বলজ্বলে কোনো তারা খসে পড়ছে! হ্যাঁ, আমরা যে খসে পড়ে তারা বা শুটিং স্টার দেখি, সেগুলো আসলে একেকটি উল্কাপিণ্ড। অর্থাৎ মহাজাগতিক পাথরের টুকরো। ভূপৃষ্ঠে বা সমুদ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ার মাধ্যমে শেষ হয় এদের যাত্রা। মোট কথা, মহাকাশ থেকে আসা যেকোনো পাথরের টুকরোকে বলা হয় উল্কা। ইংরেজিতে মিটিওর (Meteor)।

মহাকাশে এসব পাথরের টুকরো নানাভাবে তৈরি হতে পারে। একটি পদ্ধতি হলো, একাধিক পাথুরে গ্রহ বা উপগ্রহের মধ্যকার সংঘর্ষ। কোনো কারণে এরকম ঘটনা ঘটলে চারপাশে ছড়িয়ে যায় অনেক ছোট ছোট পাথরখণ্ড। এরাই ভেসে বেড়ায় মহাশূন্যে।

পৃথিবীতে পাওয়া উল্কাপিণ্ডগুলোর বয়স কত, তা বের করতে বিজ্ঞানীরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তাকে বলা হয় ‘রেডিওমেট্রিক ডেটিং’। জৈব পদার্থের বয়স বের করার জন্য রেডিওকার্বন ডেটিং করা হয়, তা হয়তো অনেকেই জানেন। আসলে, কার্বন ডেটিং রেডিওমেট্রিক ডেটিংয়ের-ই একটি ধরন। এ পদ্ধতিতে তেজস্ক্রিয় কার্বন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বস্তুটির বয়স নির্ণয় করেন। তবে মহাকাশ থেকে আসা এসব উল্কায় এরকম কার্বন থাকে না। থাকে অক্সিজেন, নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য পদার্থ। এসব পদার্থের আইসোটোপ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট হারে ক্ষয় হয়। রেডিওমেট্রিক ডেটিং পদ্ধতিতে এই ক্ষয়ের হার বের করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন পাথরটি কত পুরোনো। বিষয়টি আরও ব্যাপক, তবে আপাতত এটুকু বুঝলেই চলবে।

পৃথিবীতে পাওয়া বেশিরভাগ উল্কাপিণ্ডই প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি বছর পুরোনো। কারণ, এসব উল্কাপিণ্ড আসলে গ্রহাণুর টুকরো।
মঙ্গলীয় উল্কা; ২১ অক্টোবর ১৯৯৬; স্থান: নিউইয়র্ক
গেটি ইমেজ

যাহোক, পৃথিবীতে পাওয়া বেশিরভাগ উল্কাপিণ্ডই প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি বছর পুরোনো। কারণ, এসব উল্কাপিণ্ড আসলে গ্রহাণুর টুকরো। গ্রহাণু বলয়ের এসব গ্রহাণু তৈরি হয়েছিল সৌরজগৎ তৈরির সময়। বলা বাহুল্য, সৌরজগৎ গঠিত হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগে।

পৃথিবীতে পাওয়া কোনো উল্কাপিণ্ডের বয়স সাড়ে ৪০০ কোটি বছরের কম বা বেশি হলে বুঝতে হবে, সেই পাথরখণ্ডের জন্ম গ্রহাণু বলয়ের মাঝে নয়। বয়স এর কম হলে বুঝতে হবে, সেটা অন্য কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের টুকরো। কারণ, সৌরজগতের গ্রহ বা উপগ্রহের বুকেই কেবল সাড়ে ৪০০ কোটি বছরের কম পুরোনো পাথর তৈরি হতে পারে। এর বেশি বয়সের পাথরখণ্ড পাওয়া গেলে বুঝতে হবে, এই উল্কার জন্ম সৌরজগতের বাইরে কোথাও।

বিজ্ঞানীরা এমনকিছু উল্কাপিণ্ডের সন্ধান পেয়েছেন, যাদের মাঝে পাওয়া অক্সিজেন আইসোটোপের অনুপাত পৃথিবীর অক্সিজেন আইসোটোপের অনুপাতের চেয়ে ভিন্ন। এমনটা কেন হয়েছে, তা এখনও তাঁরা পুরোপুরি জানেন না। তবে কিছু উল্কাপিণ্ডের আইসোটোপিক গঠন একদম মঙ্গল গ্রহের বুকে পাওয়া পাথরের মতো। পাশাপাশি, এসব উল্কাপিণ্ডের মাঝে এমন বায়ুমণ্ডলীয় উপাদানের সন্ধান মিলেছে, যেগুলো মঙ্গলের সঙ্গেই কেবল মেলে। এসব তথ্য একটা দিকেই নির্দেশ করে। উল্কাগুলোর জন্ম কোনো গ্রহাণুতে নয়। বরং এগুলো খোদ মঙ্গল গ্রহেরই একটা অংশ ছিল কোনো একটা সময়। এই উল্কাপিণ্ডকে ইংরেজিতে বলা হয় মার্শিয়ান মিটিওরাইট বা মঙ্গলের উল্কাপিণ্ড।

এবারে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া যাক। এগুলো যদি মঙ্গলেরই অংশ হয়, তবে পৃথিবীতে এল কীভাবে?

এগুলো যদি মঙ্গলেরই অংশ হয়, তবে পৃথিবীতে এল কীভাবে?

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, অতীতের কোনো একসময় ধূমকেতু বা শক্তিশালী গ্রহাণুর আঘাতে মঙ্গল গ্রহের কিছু অংশ ভেঙে ছড়িয়ে যায় মহাকাশে। এসব ছড়িয়ে পড়া মঙ্গলের টুকরোই কালের পরিক্রমায় মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে এসে থেমেছে পৃথিবীর বুকে।

পৃথিবীতে উল্কা সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্তের রেকর্ড রাখে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর মিটিওরিকস অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স কতৃপক্ষ। তাদের দ্য মিটিওরিটিকেল সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত পৃথিবীতে আসা মঙ্গলীয় উল্কার সংখ্যা ৩৪৭ টি।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, দ্য মেটিওরিটিক্যাল সোসাইটি