বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরার কার্যক্রম শুরু ২৩ জুন

আগামী ২৩ জুন, সোমবার যাত্রা শুরু করবে বহুল প্রতীক্ষিত মহাকাশ জরিপ ‘লিগেসি সার্ভে অব স্পেস অ্যান্ড টাইম, সংক্ষেপে এলএসএসটি। এই জরিপ প্রতি তিন রাতে একবার করে পুরো আকাশের ছবি তুলবে। জরিপটি পরিচালিত হবে দশ বছর ধরে। এই সময়ের মধ্যে পুরো আকাশ ৮০০ বার চিত্রায়িত হবে।

এলএসএসটি প্রকল্পটি ২০০৬ সালে ‘লার্জ সিনোপটিক সার্ভে টেলিস্কোপ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরে এর নাম বদলে রাখা হয় ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরি। অর্থাৎ রুবিন মানমন্দির। ডার্ক ম্যাটারের আবিষ্কারক মার্কিন জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিনের নামে এর নাম রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পের পরিচালক জেলকো ইভেজিক। মানমন্দিরটি স্থাপন করা হয়েছে চিলির আন্দিজ পর্বতমালার সেরো পাচোন পর্বতে। এর অবস্থান চিলির লা সেরেনা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। এ মানমন্দিরের অর্থায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং এলএসএসটি কর্পোরেশন। প্রকল্পটি পরিচালনা করছে অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি ফর রিসার্চ ইন অ্যাস্ট্রোনমি।

এতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩.২ গিগাপিক্সেল, অর্থাৎ ৩ হাজার ২০০ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা। এত বড় ক্যামেরা আর নেই। এ ক্যামেরার ভর প্রায় ২ হাজার ৮০০ কিলোগ্রাম। এটি বসানো হয়েছে ৮.৪ মিটার ব্যাসের সিমনি সার্ভে টেলিস্কোপে। ক্যামেরাটিতে ছয়টি ফিল্টার আছে। এগুলো অতিবেগুনি থেকে শুরু করে অবলোহিত আলো পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারে। প্রতি রাতে এই ক্যামেরা ২০ টেরাবাইট ডেটা সংগ্রহ করবে। বিজ্ঞানীদের আশা, এর মধ্যে থাকবে সহস্রাধিক নতুন আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার নিশ্চিত করা এবং ফলোআপ করা জোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বিভিন্ন টিম গঠন করে দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করার মতো অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে এ জন্য।

ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরি

এলএসএসটি মূলত ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির স্বরূপ সন্ধান, ট্রানজিয়েন্ট বা পরিবর্তনশীল ঘটনা, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এবং সৌরজগৎ জরিপ করবে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন। যেমন মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু কীভাবে বিন্যস্ত আছে এবং সময়ের সঙ্গে কীভাবে বদলে যাচ্ছে? গ্যালাক্সিদের গঠনে এই ডার্ক ম্যাটার কী ভূমিকা রাখে? ডার্ক এনার্জি বা গুপ্ত শক্তি আসলে কী? মহাবিশ্বের প্রসারণে এটি কীভাবে কাজ করছে? মহাবিশ্বের ব্যাপক কাঠামো কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে? সৌরজগৎ কীভাবে তৈরি হয়েছে, শুরুতে কী ধরনের মৌল ছিল এবং সেগুলো সৌরজগতে কীভাবে এল? পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ কী ধরনের বস্ত আছে আকাশে? নেপচুনের পরে কি অজানা কোনো গ্রহ, অর্থাৎ নবম গ্রহ, সত্যিই আছে? এরকম আরও বহু প্রশ্নের জবাব খোঁজা হবে। মহাকাশে দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাগুলোর উৎস, কোন ধরনের তারাদের ক্ষেত্রে অতি উজ্জ্বল বিস্ফোরণ ঘটে, তারাদের উজ্জ্বলতার পর্যায়ক্রমিক তারতম্য থেকে কী জানা যায়, অজানা আর কী ধরনের ট্রানজিয়েন্ট ঘটনা আছে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির গঠন রহস্য, সূর্যের নিকতবর্তী তারাদের সঙ্গে সূর্যের মিল এবং সৌরজগৎ তৈরিতে এদের ভূমিকাসহ মিলতে পারে আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর।

আরও পড়ুন
এলএসএসটির ক্যামেরা প্রতি রাতে যে পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করবে, তা একটানা তিন বছর ভিডিও দেখার সমতুল্য। ১০ বছরে ক্যামেরাটি দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ ছবি তুলবে।

এসব প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে বেশ কয়েকটি কোলাবরেশন গঠিত হয়েছে। এগুলো হলো: অ্যাকটিভ  গ্যালাক্টিক নিউক্লিই, ডার্ক এনার্জি সায়েন্স, গ্যালাক্সি সায়েন্স, ইনফরম্যাটিকস এন্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল সায়েন্স, স্ট্রং লেন্সিং সায়েন্স, স্টারস, মিল্কিওয়ে অ্যান্ড লোকাল ভলিউম সায়েন্স, সোলার সিস্টেম সায়েন্স এবং ট্রানজিয়েন্ট এন্ড ভ্যারিয়েবল স্টার সায়েন্স। সব মিলে, বিজ্ঞানীদের আশা, জোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এলএলএসটি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। এর মাধ্যমে অজানা অনেক নতুন মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এলএসএসটির ক্যামেরা প্রতি রাতে যে পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করবে, তা একটানা তিন বছর ভিডিও দেখার সমতুল্য। ১০ বছরে ক্যামেরাটি দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ ছবি তুলবে। এর মোট আকার হবে ৬০ পেটাবাইট। বলে রাখি, ১ পেটাবাইট সমান ১ হাজার টেরাবাইট বা ১০ লাখ গিগাবাইট। এ তো শুধু ধারণকৃত ছবির সাইজ বা আকার। এই ছবি প্রসেস করলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ পেটাবাইট! এসব ছবি বিশ্লেষণ করে যে ক্যাটালগ তৈরি করা হবে, তাতে প্রায় ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি তারা, ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি গ্যালাক্সি এবং কয়েক মিলিয়ন ট্রানজিয়েন্ট ঘটনা। বিভিন্ন কোলাবরেশনের বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণাপত্রে সিমুলেশনের মাধ্যমে এই সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ফলাফলগুলোর পূর্বাভাষ প্রকাশ করেছেন। 

ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরি

প্রতি রাতে পর্যবেক্ষণ চলাকালীন এলএসএসটির ক্যামেরা থেকে প্রাপ্ত ছবি প্রসেস এবং বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহ করা হবে তিনভাবে—অ্যালার্ট, ক্যাটালগ এবং ছবি আকারে। ট্ট্রানজিয়েন্ট ঘটনা শনাক্ত হলে মিনিটের মধ্যে অ্যালার্ট দেওয়া হবে। ক্যাটালগে থাকবে ছবি থেকে শনাক্তকৃত সব ধরনের মহাজাগতিক বস্ত। প্রতিটি ছবি থেকে ক্যাটালগ তৈরি হবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। আর সব ধরনের ছবি প্রকাশ করা হবে ছবি ধারণের ৮০ ঘণ্টা পর। তবে ছবিগুলো শুধু যাঁদের কাছে রুবিন মানমন্দিরের ডেটা রাইটস, অর্থাৎ ডেটা দেখা এবং এক্সেস করার অধিকার আছে, তাঁরাই পাবেন।

এলএলএসটি ক্যামেরা থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করতে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ ট্রিলিয়ন ক্যালকুলেশন করতে পারে, এমন ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ফ্যাসিলিটিতে এই ডেটা প্রসেস এবং সংরক্ষণ করা হবে।

আরও পড়ুন
হাবল স্পেস টেলিস্কোপ বা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেকাংশে এগিয়ে নিয়েছে। রুবিন মানমন্দির এবং এলএসএসটি আমাদের সেই জ্ঞান আরও একধাপ এগিয়ে নেবে।

এলএসএসটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হবে ট্রানজিয়েন্ট ঘটনা আবিষ্কার। ট্রানজিয়েন্ট ঘটনা মানে পরিবর্তনশীল বা হঠাৎ আবির্ভাব হয়েছে, এমন কিছু বোঝায়। যেমন সুপারনোভা বিস্ফোরণ, ধূমকেতু, গ্রহাণু বা যেকোনো কিছুর উজ্জ্বলতার তারতম্য। প্রতি রাতে প্রায় ১০ মিলিয়ন ট্রানজিয়েন্ট অ্যালার্ট তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব অ্যালার্ট প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হবে অ্যালার্ট ব্রোকার। এটি আসলে কমিউনিটি ব্রোকার, যা রুবিন মানমন্দিরের সঙ্গে কাজ করবে। 

ব্রোকারের কাজ হলো রুবিন মানমন্দির থেকে প্রকাশিত অ্যালার্টগুলোকে বিভিন্ন ট্যাগ দেওয়া। এর মানে, কিছু শনাক্ত হলে সেটা আগের কোনো ক্যাটালগে আছে কি না, তা মিলিয়ে দেখা হবে। এরপর একটা অ্যালার্ট থেকে নতুন কিছু পাওয়া গেলে সেটা কী হতে পারে, তার প্রাথমিক যাচাই সম্পন্ন করে অ্যালার্টটি সুপারনোভা নাকি অন্যকিছু, তার একটা সম্ভ্যাব্যতা দেওয়া। জোতির্বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কমিউনিটি ব্রোকারের মাধ্যমে নিজ নিজ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান অনুযায়ী অ্যালার্ট থেকে প্রাপ্ত ঘটনার ফলোআপ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ বা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেকাংশে এগিয়ে নিয়েছে। রুবিন মানমন্দির এবং এলএসএসটি আমাদের সেই জ্ঞান আরও একধাপ এগিয়ে নেবে। এ জন্য সব জোতির্বিদ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন।

লেখক: শিক্ষক, জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগ, সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং সহযোগী সদস্য, সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি, স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

সূত্র:  ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি মিডিয়া কিট