নাসার ডার্ট মিশনে গ্রহাণুর সঙ্গে সফল সংঘর্ষ

৩০ জুন ১৯০৮। মাত্র ৪ হাজার কিলোমিটারের জন্য ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেল রাশিয়ার রাজধানী মস্কো। দ্বিতীয়বার ভ্লাদিভস্তক শহরের ৪০০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে আঘাত হানল একটি গ্রহাণু। শকওয়েভের ধাক্কায় ইউরেনিয়াম বোমার মতো প্রচণ্ড শক্তি ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। তবে সে যাত্রায়ও বেঁচে গেল মানুষ৷ কারণ, গ্রহাণুটি আঘাত করেছে বিশাল জনমানবহীন বনভূমিতে।

 তৃতীয়বারের মতো যখন দানবীয় আরেকটি গ্রহাণু ছুটে এল, তখন ২০৭৭ সাল। ১১ সেপ্টেম্বর। ইউরোপের মানুষ দেখল, আকাশের বুকে সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল এক গোলা ছুটে যাচ্ছে। অস্ট্রিয়ার ওপরে থাকাকালীন গোলাটা ভাঙতে শুরু করল বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে। সেকেন্ডে ৫০ কিলোমিটার তার গতি। কয়েক হাজার টন পাথরের এই গোলা যখন উত্তর ইতালির বুকে আছড়ে পড়ল, পাদুয়া এবং ভেরোনা শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। ডুবে গেল ভেনিস। মারা গেল ৬ হাজার মানুষ। ইতিহাস, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবের কথা আলাদা করে বলা বাতুলতা। এ ক্ষতি অপরিসীম।

 শুরুতে না বুঝলেও ২০৭৭ সালের কথা পড়ে নিশ্চয়ই বুঝেছেন, ওপরের দৃশ্যকল্পটি বাস্তব না। কল্পবিজ্ঞানের পুরোধা আর্থার সি ক্লার্কের লেখা বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী রন্দেভু উইথ রামা-র শুরুটা হয়েছে এভাবেই। এরই সূত্র ধরে পৃথিবীকে গ্রহাণুর আঘাত থেকে বাঁচাতে গড়ে তোলা হয় 'স্পেসগার্ড' নামের একটি প্রোগ্রাম। বাস্তবে নাসা স্পেসগার্ড নামে কোনো প্রোগ্রাম তৈরি করেনি। তবে ঠিক এরকমই একটি প্রকল্প তারা শুরু করেছিল বছর কয়েক আগে। আর তার প্রথম সফল পরীক্ষা হয়ে গেল বাংলাদেশ সময়ে আজ সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টা ১৪ মিনিটে।

ডাবল অ্যাস্টেরয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট বা ডার্ট সফলভাবে লক্ষ্যভেদ করেছে। ডাইমরফোস নামের একটি গ্রহাণুর বুকে আছড়ে পড়েছে সর্বশক্তিতে। উদ্দেশ্যটা সহজ, গ্রহাণুটির যাত্রাপথের দিক বদলে দেওয়া। বলে রাখা প্রয়োজন, ডাইমরফোস পৃথিবীর জন্য ঝুঁকি ছিল না। এটা শুধুই পরীক্ষার জন্য করা।

 ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয় ডার্ট। ডাইমরফোস নামের ৫৩০ ফুট ব্যাসের গ্রহাণুটিকে আঘাত করাই ছিল এর লক্ষ্য। এই গ্রহাণুটি একটি ছোট মুনলেট। বাংলায় বলা যায় উপচাঁদ, কারণ এটা ডিডিমস নামের পাঁচ গুণ বড় আরেকটি গ্রহাণুকে ঘিরে ঘুরছে। পৃথিবী থেকে এরা আছে ১ কোটি ১০ লাখ কিলোমিটার দূরে।

 তবে ডার্ট বেশ কিছুদিন মহাকাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। এ সময় নানা কিছু পরীক্ষা করে দেখেছেন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা। চলতি বছরের ২৭ জুলাই এটি গ্রহাণুটিকে ৩২ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে শনাক্ত করে ও সেভাবে নিজের গতিপথ ঠিক করে নেয়। ১১ সেপ্টেম্বর এটি সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া লাইট ইতালিয়ান কিউবস্যাট ফর ইমেজিং অব অ্যাস্টেরয়েড বা লাইসিয়াকিউব নামের একটি ন্যানোস্যাটেলাইটকে মুক্ত করে দেয় মহাকাশে। এই স্যাটেলাইটটিই মূলত ডার্টের সংঘর্ষের ছবি দিয়েছে। অবশ্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশের বিজ্ঞানীরাই অধীর প্রতীক্ষায় ছিলেন ডার্টের। তাই জেমস ওয়েব নভোদুরবিন, হাবল নভোদুরবিনের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নভোদুরবিনও এই সংঘর্ষের সময় ডার্টের ওপর চোখ রেখেছে ও ছবি পাঠিয়েছে পৃথিবীতে।

সংঘর্ষের ৪ ঘণ্টা আগে ডার্ট পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে শুরু করে। পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা এর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেন। নিজস্ব নেভিগেশন প্রযুক্তি 'স্মার্ট ন্যাভ গাইডেন্স সিস্টেম' ব্যবহার করে ডার্ট ছুটে যায় ডাইমরফোসের দিকে। সংঘর্ষের ধাক্কায় এটি গ্রহাণুটির কক্ষপথ ১% বা ১০ মিনিটের মতো ছোট করে আনবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। আসলেই তা হয়েছে কি না বা কতটা হয়েছে, সেটা নিখুঁতভাবে জানতে লেগে যাবে প্রায় এক মাস। প্রশ্ন আসতে পারে, গ্রহাণুটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল না কেন? কেউ যদি এমনটা ভেবে থাকেন, তাহলে জানিয়ে রাখি, এর প্রয়োজন নেই। কক্ষপথ বা গ্রহাণুটির যাত্রাপথের দিক খানিকটা বদলে দিলেই চলে। পুরো সংঘর্ষটি সরাসরি সম্প্রচার করেছে নাসা।

যাঁরা ছোটবেলায় ভাবতেন, বিশাল কোনো গ্রহাণু বা উল্কাপিণ্ড ছুটে এসে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়লে কী হবে, তাঁরা এবারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এই সফল পরীক্ষা প্রমাণ করল, পৃথিবীর দিকে প্রলয়ংকরী কোনো গ্রহাণু ছুটে এলে ডাইনোসরদের মতো কিংবা আর্থার সি ক্লার্কের কল্পনার মানব সভ্যতার মতো অসহায়ভাবে ধংসের মুখে আত্মসমর্পণ করতে হবে না পৃথিবীকে।

 একটা মজার জিনিস জানিয়ে শেষ করি। গুগলে 'Dart Mission' বা 'Dart Mission Nasa' লিখে সার্চ করলে দারুণ এক অ্যানিমেশন দেখা যাবে। বাম থেকে এসে ডার্ট ধাক্কা মারবে আপনার স্ক্রিনের ডান পাশে, আর পুরো ওয়েবপেজ হেলে পড়বে একদিকে। ভয় পাবেন না। ডার্ট আপনার পাশেই আছে।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নাসা, উইকিপিডিয়া