মহাকাশের শব্দ শুনতে কেমন

মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

ধরুন, চাঁদে গেলেন। চাঁদের চারপাশটা ঘুরে দেখছেন। কিন্তু সবকিছু কেমন যেন প্রাণহীন মনে হচ্ছে। কারণ, ওখানে কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। পাখির ডাক, হকারের চিৎকার কিংবা বাস-ট্রেনের শব্দও নেই সেখানে। কিন্তু আমরা যদি মহাকাশের শব্দ শুনতে পেতাম? কেমন শোনাত সেই শব্দ? গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা বিশাল ব্ল্যাকহোলের পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময় কি সাঁই সাঁই শব্দ শোনা যেত?

মহাকাশ নিয়ে পরিচিত একটা সংলাপ আছে, মহাকাশে আপনার চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না। কথাটা কিন্তু একদম সত্যি। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানী কিম্বার্লি আরকান্ডের মতে, ‘মহাকাশ আসলে একেবারে নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ জায়গা।’

কিন্তু কেন এই নীরবতা? এই বিষয়টা বুঝতে হলে শব্দের বিজ্ঞানটা একটু বুঝতে হবে। শব্দ হলো এক ধরনের ঢেউ বা কম্পন। আপনি যখন কথা বলেন, তখন আপনার কণ্ঠ থেকে বের হওয়া বাতাস কাঁপতে কাঁপতে অন্যের কানে পৌঁছায়। এই কম্পন যাওয়ার জন্য বাতাসের মতো কোনো একটা মাধ্যম দরকার। সহজ কথায়, শব্দের চলার জন্য একটা মাধ্যম লাগে।

কিন্তু মহাকাশের প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। বিজ্ঞানের ভাষায় একে আমরা বলি ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান। সেখানে বাতাসের কণা এতই কম যে নেই বললেই চলে। আমাদের চারপাশের বাতাসের চেয়েও কোটি কোটি গুণ হালকা সেই পরিবেশ। তাই সেখানে কোনো শব্দ তৈরি হলেও সে কম্পন বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো মাধ্যম নেই। ফলে শব্দ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতেই পারে না। আমাদের কান পর্যন্তও পৌঁছানোরও কোনো উপায় নেই। এ জন্য মহাকাশে কোনো শব্দ শোনা যায় না।

২০০৩ সালে বিজ্ঞানীরা এই শব্দের সুরও বের করেছেন। কিন্তু এই শব্দ এতই গভীর আর নিচু স্বরের যে মানুষের কান তা শুনতে পারে না।

তাহলে কি মহাকাশ পুরোপুরি নিশ্চুপ? আসলে মহাকাশ পুরোপুরি নীরব নয়। এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে শব্দ তৈরি হয়। কিন্তু সেই শব্দ আমরা সাধারণ কানে শুনতে পাই না। যেমন ব্ল্যাকহোলের কথাই ধরুন। বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন, পার্সিয়াস গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের একটি বিশাল ব্ল্যাকহোল থেকে গরম গ্যাসের ঢেউ বের হয়। এই ঢেউ এক ধরনের শব্দতরঙ্গ। ২০০৩ সালে বিজ্ঞানীরা এই শব্দের সুরও বের করেছেন। কিন্তু এই শব্দ এতই গভীর আর নিচু স্বরের যে মানুষের কান তা শুনতে পারে না। আমাদের কানের শোনার যে ক্ষমতা, তা থেকে এই স্বর প্রায় ৫৭ অক্টেভ নিচের।

বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। অক্টেভ হলো শব্দের ফ্রিকোয়েন্সির স্তর মাপার একটি ধারা। প্রতি অক্টেভে শব্দ দ্বিগুণ বা অর্ধেক হয়। যেমন, কোনো স্বর ৪০০ হার্জ হলে তার এক অক্টেভ ওপরের স্বর হবে ৮০০ হার্জ, আর এক অক্টেভ নিচের স্বর হবে ২০০ হার্জ। আমাদের কান সাধারণত প্রায় ২০-২০,০০০ হার্জ পর্যন্ত শব্দ শুনতে পারে। এখন আমাদের শোনার সীমার চেয়ে ৫৭ অক্টেভ নিচে মানে সেই শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি এত কম যে তা শুধু শোনাই অসম্ভবই নয়, কল্পনারও বাইরে।

তাহলে উপায়? আমরা কি কখনো মহাকাশের শব্দ শুনতে পাবো না। আসলে কিছুটা আশা আছে।

সংখ্যাটা একটু হিসাব করলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে। ধরুন, আপনি ২০ হার্জ থেকে নিচের দিকের শব্দ শুনতে চান। এতে প্রতি অক্টেভে ফ্রিকোয়েন্সি অর্ধেক হবে। মানে ২০ হার্জের এক অক্টেভ নিচে ১০ হার্জ। তার নিচে ৫ হার্জ। আরও নিচে ২.৫ হার্জ। এভাবে ৫৭ বার নামতে থাকলে ফ্রিকোয়েন্সি এত কমে যাবে যে সেটি আর শোনা তো যাবেই না বরং ওই স্বর একটি মহাজাগতিক তরঙ্গের মতো দীর্ঘ হয়ে যাবে। যেমন, কিছু ব্ল্যাকহোল থেকে যে কম্পন বের হয়, তা এতই নিচু স্বরের যে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য হতে পারে হাজার হাজার কিলোমিটার! আবার বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের শব্দ শোনার চেষ্টাও করেছেন। নাসার পাঠানো রোভার মঙ্গলের বুকে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ রেকর্ড করেছে। কিন্তু শব্দগুলো এত দুর্বল ও ভিন্ন যে সাধারণভাবে তা কানে শোনা যায় না। বিশেষ যন্ত্রে প্রক্রিয়া করে শোনানো হয়।

তাহলে উপায়? আমরা কি কখনো মহাকাশের শব্দ শুনতে পাবো না। আসলে কিছুটা আশা আছে। বিজ্ঞানীরা একটা দারুণ কাজ করছেন। যে শব্দ আমরা শুনতে পাই না, বিজ্ঞানীরা তাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের শোনার উপযোগী করে তুলছেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় সনিফিকেশন।

ব্যাপারটা একটু সহজে বুঝিয়ে বলি। মহাকাশ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ডেটা বা তথ্য প্রথমে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে শব্দে রূপান্তর করা হয়। নাসার বিজ্ঞানীরা মহাকাশের বিভিন্ন এক্সরে ছবি বা ডেটাকে অসাধারণ সব শব্দে পরিণত করেছেন। ফলে আমরা এখন প্রযুক্তি সাহায্যে শুনতে পাই, একটি ব্ল্যাকহোল কেমন করে গর্জন করছে বা দুটি গ্যালাক্সির মিলনের সময় কেমন সুর তৈরি হচ্ছে।

এই প্রযুক্তির ফলে মহাকাশ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়বে বহুগুণ। কারণ, এতদিন আমরা মহাকাশকে শুধু চোখে দেখেছি। এখন তার শব্দও শুনতে পাবো।

সূত্র: স্পেস ডটকম