মহাকাশ
মহাকাশের বৈচিত্র্যময় ভূমি
মহাকাশেও আছে পৃথিবীর মতো ভূমি। তবে সেগুলো বৈচিত্র্যময়। একেকটা পাথুরে গ্রহ একেক রকম। অনেক উপগ্রহ আছে পাথুরে, সেগুলোতেও ভূমি আলাদা ধরনের। বরফের আগ্নেয়গিরি, ধুলোর পুকুর, বড় খাদ, বাঘের ডোরাকাটা, বরফের সমভূমি ইত্যাদি নানা ধরনের ভূমি রয়েছে। এরকম কিছু ভূমি নিয়েই এ লেখা।
১. ক্রায়োভলকানো বা বরফের আগ্নেয়গিরি
ক্রায়োভলকানো একধরনের আগ্নেয়গিরি। প্রাচীন গ্রিক শব্দ ক্রুওস (kruos) থেকে এসেছে শব্দটা। এর অর্থ ঠান্ডা বা তুষারপাত। ভূত্বকের নিচে গলিত লাভার পরিবর্তে পানি, তরল অ্যামোনিয়া বা মিথেন, উদ্বায়ী উপাদান ও হাইড্রোকার্বন নির্গত হয়। পদার্থগুলো দ্রুত জমে যায় প্রচণ্ড ঠান্ডায়। তাই একে বলে বরফের আগ্নেয়গিরি। দেখতে অনেকটা শঙ্কু বা গম্বুজ আকৃতির। প্রতি সেকেন্ডে ২৫০ কেজির মতো নানা উপাদান বিস্ফোরিত হয়, বলা ভালো, নির্গত হয়। সেরেস গুহাণুর বৃহত্তম পর্বত অহুনা মনস (Ahuna Mons), শনির চাঁদ টাইটানের ডুম মনস ও বামন গ্রহ প্লুটোর রাইট মনসে এ ধরনের বরফের আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
২. ডাস্টপন্ট বা ধুলোর পুকুর
ডাস্টপন্ট লাতিন শব্দ। এর অর্থ নোংরা বা ধুলো। আর পন্ড মানে পুকুর। অর্থাৎ ধুলোর পুকুর। সৌরজগতে বেশ কিছু মহাজাগতিক জ্যোতিষ্ক (বস্তু) রয়েছে, যেগুলোর পৃষ্ঠদেশে রয়েছে বহু বায়ুহীন গর্ত। এসব গর্ত বা পুকুরের কণাগুলো সিলিকেট পদার্থে সমৃদ্ধ। বিজ্ঞানীদের মতে, এ ধরনের ভূমি সাধারণত ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিকের ফলে সৃষ্টি হয়। সূর্য থেকে আসা ইনফ্রারেড ও অতিবেগুনি রশ্মি গ্রহপৃষ্ঠে উপস্থিত ধূলিকণায় চার্জিত হয়ে ওপরে উঠে যায়। রাতে সৌরবায়ু থেকে ইলেকট্রন চার্জ হয়ে ধূলিকণাকে নিয়ে যায় আরও উঁচুতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো চার্জ হারিয়ে মাটিতে পড়ে। গর্তগুলোর গভীরতা প্রায় ২০০ মিটার পর্যন্ত হয়। ইটোকাওয়া, ইরোস বা ভেস্তার পৃষ্ঠে এ ধরনের ভূমি দেখা যায়।
৩. ইমপ্যাক্ট ক্রেটার বা সংঘর্ষে সৃষ্ট খাদ
কোনো পৃষ্ঠের ওপর মহাজাগতিক বিভিন্ন বস্তু, যেমন বড় উল্কা বা গ্রহাণু ছুটে এসে আঘাত করে প্রায়ই। এই মহাজাগতিক সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট গর্তকে বলে ইমপ্যাক্ট ক্রেটার বা খাদ। এর প্রভাবে আশপাশের অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। উল্কাপিণ্ডের গর্তগুলো শুধু চাঁদের মতো পাথুরে পৃষ্ঠে পড়ে না। ধূমকেতু বা বিভিন্ন গ্রহের বরফ-ঢাকা উপগ্রহপৃষ্ঠেও দেখা যায় এ ধরনের খাদ। দেখতে অনেকটা বৃত্তাকার হয়, যদিও আসল আকৃতি উপবৃত্তাকার। সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট এসব খাদ বিভিন্ন খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। যেমন শনি গ্রহের চাঁদ আইপেটাসের ‘সারাগোসা টেরা’ একটি বড় খাদের নাম। মঙ্গল গ্রহেও রয়েছে এমন খাদ। যেমন নেস্টেড ক্রেটার।
৪. টাইগার স্ট্রাইপস বা বাঘের ডোরাকাটা
সৌরজগতে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে রয়েছে শৈলশিরা। এগুলো দেখতে অনেকটা বাঘের ডোরাকাটার মতো। সে জন্য এগুলোকে বলা হয় টাইগার স্ট্রাইপস বা বাঘের ডোরাকাটা। এই ডোরাকাটা ঘিরে থাকা শিলাগুলো প্রায়ই মোটা দানাযুক্ত, স্ফটিক জলের বরফে ঢাকা থাকে। নীল-সবুজ রঙের হয়। প্রতিটি বাঘের ডোরা প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং ৫০০ মিটার পর্যন্ত গভীর হতে পারে। আশপাশের শিলাগুলো গড়ে ১০০ মিটারের মতো লম্বা হয়, পাশে হয় ২-৪ কিলোমিটার চওড়া। যেমন শনির চাঁদ এনসেলাডাসের দক্ষিণ মেরু, গ্যানিমেড এবং মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠে এ ধরনের ডোরাকাটা শৈলশিরা দেখা যায়।
৫. বরফের সমভূমি
সৌরজগতের বেশির ভাগ উপগ্রহের পৃষ্ঠ বরফ দিয়ে গঠিত। তাই এসব উপগ্রহের পৃষ্ঠকে বলা হয় বরফে ঢাকা সমতল ভূমি। এই বরফগুলো মূলত বিভিন্ন হিমায়িত গ্যাস—যেমন মিথেন, অ্যামোনিয়া ও তরল নাইট্রজেন এবং নানা রকম উদ্বায়ী পদার্থ—যেমন হাইড্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড ও মিথেন দিয়ে তৈরি। বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপা, শনির চাঁদ এনসেলাডাস, নেপচুনের চাঁদ ট্রাইটন ও বামন গ্রহ প্লুটোয় এ ধরনের বরফের সমভূমির দেখা মেলে।
৬. বরফের বালিয়াড়ি
সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে রয়েছে প্রচুর বালু। এসব বালুতে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোকার্বন (কার্বন ও হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত জৈব যৌগ, যেমন মিথেন) মিশ্রিত থাকে। এগুলো কফি পাউডারের বিশাল স্তুপের মতো জমে থাকে। এগুলো বরফের বালিয়াড়ি নামে পরিচিত। বালির দানা বা মিথেনের বরফকণার ব্যাস প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ মাইক্রোমিটার হতে পারে। বালিয়াড়ির সর্বোচ্চ উচ্চতা ১০০ মিটার। এর কাছেই দেখা যায় হাইড্রোকার্বনের সাগর, আগ্নেয়গিরি, ক্ষয়জাত ভূমি ইত্যাদি। নাসার নিউ হরাইজন নভোযান এ ধরনের বরফের বালিয়াড়ির ছবি তুলেছে। প্লুটোর স্পুটনিক প্ল্যান্টিয়া নামে একটি সমভূমি অঞ্চল এবং টাইটানের বিষুবরেখার কাছে জানাডু (Xanadu) অঞ্চলে রয়েছে রয়েছে এ রকম বালিয়াড়ি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মঙ্গল, শুক্র ও ধূমকেতু ই৬৭-তেও এ রকম বালিয়াড়ি রয়েছে।