শনি গ্রহ কি পানিতে ভাসতে পারে?

সৌরজগতের গ্রহগুলো মূলত দুই ধরনের। পাথুরে গ্রহ আর গ্যাসদানব। এই গ্যাসীয় দৈত্যেরা আকারে অনেক বড়। দানব নাম তো আর শুধু শুধু আসেনি! কত বড়, তার একটা ধারণা দিই। বৃহস্পতির কথাই ধরুন। এই গ্যাসদানবের মাঝে আঁটানো যাবে মাত্র ১৩শ পৃথিবী!

এসব গ্যাসদানবের অবস্থান সৌরজগতের বাইরের দিকে। মজার ব্যাপার হলো, আকারে বড় বা পৃষ্ঠে মহাকর্ষ বল বেশ শক্তিশালী হলেও এদের গঠন উপাদানের ঘনত্ব অনেক কম। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে কম ঘনত্বের গ্রহটি হলো শনি। এ কারণে শনির ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত আছে—শনি নাকি পানিতে ভাসতে পারবে! আসলেই কি তাই? চলুন, বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক।

প্রথমেই যে বিষয়টা বোঝা প্রয়োজন, কঠিন কোনো বস্তু পানিতে ভাসে কীভাবে? কথায় আছে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। আসলে ভেতরে বাতাস থাকলে ভাসতে পারে লোহার মতো ভারী বস্তুও। মোটের ওপর এর পেছনের বিজ্ঞানটা হলো, বস্তুটির ঘনত্ব হতে হবে পানির চেয়ে কম। অথবা বস্তুটিকে পানিতে রেখে দিলে যে পরিমাণ পানির জায়গা এটি দখল করে নেবে, সেটুকু পানির ওজন হতে হবে বস্তুটির চেয়ে বেশি। বইয়ের ভাষায় কথাটা এমন—বস্তুর নিচ থেকে অপরাসিত পানির ওজন হতে হয় বস্তুর ওজনের চেয়ে বেশি।

শনির বেলায় প্রথম শর্তটি সত্যি। গঠনগত দিক থেকে শনি অন্যান্য গ্যাসদানবের চেয়ে অনেক হালকা। কারণ আর কিছু না—শনির ভেতরে ভারী ধাতু খুব একটা নেই। তবে শনি পৃথিবীর তুলনায় আকারে ৯ গুণ বড়। আর এর ভর পৃথিবীর প্রায় ৯৫ গুণ! এত ভারী হলেও এর ঘনত্ব পানির চেয়ে কম। বিশ্বাস না হলে অঙ্ক কষে নিজেই দেখে নিন। শনির ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে প্রায় ০.৬৮৭ গ্রাম। আর পানির ঘনত্ব প্রতি সেন্টিমিটারে প্রায় ০.৯৯৭ গ্রাম। অর্থাৎ পানির ঘনত্ব প্রতি সেন্টিমিটারে প্রায় ০.৩ গ্রাম বা ৩০০ মিলিগ্রাম বেশি! তার মানে বুঝতেই পারছেন, তাত্ত্বিকভাবে শনি গ্রহ পানিতে ভাসতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেটা অসম্ভব।

প্রথম কথা হলো, জলাধারের আকার। অত বড় জলাধার আপনি পাবেন কোথায়! দ্বিতীয়ত, বিষয়টা খুবই কঠিন। আক্ষরিক অর্থেই! শনিকে ভাসানোর জন্য এতো বেশি পানির প্রয়োজন হবে যে মহাশূন্যে এই পরিমাণ পানি তরল অবস্থাতেই থাকতে পারবে না। তীব্র মহাকর্ষ বল পানির ঘনত্ব বাড়িয়ে কঠিন বানিয়ে ফেলবে।

কোনোভাবে যদি এই পরিমাণ পানি তরল অবস্থায় রাখার মতো জলাধারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, তাহলেও সমস্যা আছে। শনির পৃষ্ঠে মহাকর্ষ বলের মান ১০.৪৪ মিটার/বর্গ-সেকেন্ড। মানে, শনিকে পানিতে ভাসানোর আগেই তীব্র সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যাবে ওই জলাধার। আর শনির ‘পৃষ্ঠ’জুড়ে তৈরি হবে এক মহাসমুদ্র।

পৃষ্ঠজুড়ে মহাসমুদ্র তৈরি হবে, কথাটা শুনে আমাদের কল্পনায় যে দৃশ্যটা ভেসে ওঠে, বিষয়টা কিন্তু সেটা নয়। মহাসমুদ্র বলতে আমরা বুঝি, মাটি বা গ্রহের উপাদানে তৈরি একটা বিশাল, অতি বিশাল জলাধার। পানিতে ভরপুর। সমুদ্রের সব পানি থাকে পৃথিবী বা কোনো গ্রহের পৃষ্ঠের গভীর কোন অঞ্চলে। কিন্তু শনিকে ভাসানোর মতো এত এত পানি যদি শনির মহাকর্ষে আবদ্ধ হয়, তবে সবটা পানি ছড়িয়ে পড়বে শনির পুরো পৃষ্ঠজুড়ে। বাইরে থেকে শনিকে আর গ্যাসদানব বলে মনে হবে না। মনে হবে জলদানো। কিংবা জল-গোলক।

মানে, আক্ষরিক অর্থে শনিকে ভাসানো যাবে না। শনিই বরং নিজের গায়ে জড়িয়ে নেবে সব পানিকে। সৌরজগৎ আপাতদৃষ্টিতে পাবে নতুন এক জলদানো।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস