মহাবিশ্বের বয়স মাপে কীভাবে

When life is full of trouble,

And mostly frost and bubble,

I turn to Doctor Hubble,

He is the man for me.

ছড়াটি এক ব্রিটিশ পত্রিকায় বের হয়েছিল বিজ্ঞানী হাবলের সম্মানে। সেটা ছিল ১৯২৯ সাল। এডউইন হাবল তখন প্রথম মেপেছেন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি, সেই সঙ্গে মহাবিশ্বের বয়স। একেবারে অবাক করে দেওয়ার মতো আবিষ্কার! মহাবিশ্বের আবার বয়স আছে নাকি? মহাবিশ্বের জন্মতারিখ আছে? আমাদেরই মতো ওর বয়স বেড়ে চলে? সেই চিরন্তন, শাশ্বত, অমর, অবিনাশী, চিরায়ত মহাবিশ্ব একমুহূর্তে বাতিল হয়ে গেল! হাবল এক বিজ্ঞান সেমিনারে এ কথা জানান। সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে হাততালি দেওয়া শুরু করে। এমন সমাদর শুধু কবি, গায়ক এবং সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের কপালেই জোটে। বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে এমন উচ্ছ্বাস একটি বিরল ঘটনা।

অবশ্য মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কথা বিজ্ঞানীরা আগেই শুনেছিলেন। কেউ বিশ্বাস করেননি। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ১৯২২ সালে আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান দেখান যে আইনস্টাইনের সমীকরণের এক সমাধানমতে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে থাকবে। আইনস্টাইন নিজেও সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি। তাই তিনি তাঁর সমীকরণে একটি ধ্রুবসংখ্যা বসিয়ে দেন, যাতে মহাবিশ্ব চিরদিন একই রকম থাকে। এ সংখ্যাটি মহাজাগতিক ধ্রুবক বলে পরিচিত। হাবলের আবিষ্কারের পরে আইনস্টাইন এই সংখ্যাকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে দুঃখ প্রকাশ করেন!

একটা দমকল ভেঁপু বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে। যে মুহূর্তে ও আমাকে অতিক্রম করে যাবে, সেই মুহূর্ত থেকে ওই ভেঁপুর শব্দ আমার কানে অন্য রকম শোনাবে। একে বলা হয় ডপলার ইফেক্ট। আলোর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। একটি আলোর উত্স যদি আমার দিকে ছুটে আসে, তবে ওর রং আসল রঙের চেয়ে কিছুটা নীলাভ দেখাবে (Blue shift)। আলোর উত্স যদি আমার থেকে দূরে ছুটে যেতে থাকে, তবে ওর রং আসল রঙের চেয়ে কিছুটা বেশি লাল দেখাবে (Red shift)। দর্শকের বা উেসর গতি যতই বেশি হবে, এই রঙের তারতম্য ততই বেশি হবে, তাই আসল রঙের সঙ্গে পার্থক্যের পরিমাণ মেপে গতির পরিমাণ মাপা যায়। সে যুগে আমেরিকার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরের ১০০ ইঞ্চি টেলিস্কোপটি ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। এই টেলিস্কোপে রাতের পরে রাত চোখ রেখে বিজ্ঞানী হাবল এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেন, বহুদূরের গ্যালাক্সিগুলো কাছের গ্যালাক্সিগুলো থেকে লাল দেখাচ্ছে, যে যত দূরে তার রং তত বেশি লাল।

তাহলে দূরের গ্যালাক্সিগুলো সব আমাদের ছেড়ে সরে যাচ্ছে, যে যত দূরে সে ছুটছে ততই বেশি বেগে। ব্যাপারটি অবাক করে দেওয়ার মতো। সবাই পালাচ্ছে কেন, কী করেছি আমরা? আমাদের পৃথিবী কি কোনো কিছুর কেন্দ্রবিন্দু? প্রাচীন আমলে মনে করা হতো যে পৃথিবী মহাবিশ্বের মধ্যস্থল, সবাই আমাদের চারদিকে ঘুরছে। পাঁচ শ বছর আগে কোপারনিকাস এসে সেই ধারণা নাকচ করে দেন। আসলে একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে পুরো মহাবিশ্বই সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের যেকোনো গ্যালাক্সি থেকে দেখলে মনে হবে আর সব গ্যালাক্সি তাকে ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের কোনো স্থানই স্বতন্ত্র নয়, সবাই সমান! মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন স্থান তৈরি হচ্ছে। যেমন ধরুন, এক মাঠের এপারে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, ওপারে আপনার বন্ধু। যদি মাঠটির আয়তন দ্বিগুণ হয়ে যায়, তখন আপনি দেখবেন বন্ধু আপনার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে, আপনার বন্ধু দেখবে আপনি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।

মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে কার মধ্যে? মহাবিশ্বের বাইরে কি ফাঁকা জায়গা আগে থেকেই আছে? সেই স্থান কি বর্তমান মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্ত নয়? ধরুন, একটা বেলুনের ওপরে কতগুলো কালো ফোঁটা দিয়ে বেলুনটিকে ফোলাতে শুরু করলেন। বেলুন যতই বড় হবে ফোঁটাগুলোর মাঝের দূরত্ব ততই বাড়তে থাকবে। দুটি ফোঁটার মাঝে যে বাড়তি স্থানটুকু এল, সেটা কি আগে থেকেই ছিল? নাকি নতুন করে তৈরি হলো? মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে এই বেলুনের ফুলে ওঠার মতো ভাবতে পারেন। দুটি ফোঁটার মাঝে নতুন স্থান তৈরি হচ্ছে, তাই মনে হচ্ছে যে ফোঁটাগুলো সরে যাচ্ছে, ওদের মাঝের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। আর এই বেলুন মহাবিশ্বের বাইরে যদি কোনো কিছু থাকে তবে তা বেলুনবাসীর জানার কোনো উপায় নেই। বাইরের এই অংশ আছে কি নেই, তাকে মহাবিশ্বের হিসাবের মাঝে টেনে আনার প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে পদার্থবিদদের মাথা ঘামানোর সময় নেই, ওসব দার্শনিকদের ব্যাপার। অনেক পদার্থবিদ মনে করেন, যা মাপা যায় না, তা নিয়ে কথা বলার অধিকার পদার্থবিদদের নেই।

মহাবিশ্বের কি কোনো প্রান্ত বা কূল-কিনারা আছে? প্রায় সব জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহাজাগতিক নীতিতে (Cosmological principle) বিশ্বাস করেন। এই নীতি অনুসারে মহাবিশ্ব একরূপী (Homogeneous) এবং সমসারক (Isotropic)। অবশ্য এই নীতি শুধুই মহাবিশ্বের একটা বড় অংশের জন্য প্রযোজ্য। এই নীতি অনুসারে আমি মহাবিশ্বের যেখানেই থাকি না কেন, যে দিকেই তাকাই না কেন, মহাবিশ্ব দেখতে একই রকম লাগবে। এই নীতি অনুসারে মহাবিশ্বের কোনো কিনারা থাকতে পারে না। তার মানে এই নয় যে মহাবিশ্ব অসীম। একটা বলের ওপরে যদি দুই মাত্রিক প্রাণী বাস করে, তবে ওরাও বলের সীমানা খুঁজে পাবে না। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্ব অসীম কি না তা আমি জানি না, তবে মানুষের বোকামির কোনো সীমা নেই।’

এবারে অঙ্ক কষে মহাবিশ্বের বয়স বের করা যাক। হাবল কয়েক হাজার গ্যালাক্সির রেড শিফট বা লোহিত বিচ্যুতি মেপে তাদের গতিবেগ বের করেন। এসব হিসাব থেকে তিনি একটি সহজ সমীকরণ দেন: V=Hd,

এটা হাবলের সমীকরণ বলে পরিচিত। এখানে v হলো গ্যালাক্সির পালিয়ে যাওয়ার গতি, d হলো গ্যালাক্সির দূরত্ব এবং H হলো হাবল ধ্রুবক। যাঁরা একটু অঙ্ক জানেন, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন, এটা একটি সরলরেখার সমীকরণ। গতি বনাম দূরত্বের গ্রাফ আঁকলে একটি সরলরেখা পাওয়া যাবে। যার ঢাল (Slope) হচ্ছে হাবলের ধ্রুবক। এই ধ্রুবকের সঙ্গে মহাবিশ্বের বয়স জড়িয়ে আছে। দুটি গ্যালাক্সির কথা ধরা যাক, যাদের মাঝের দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে (t=0) ওরা এক হয়ে মিলেমিশে ছিল। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কারণে ওদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে আজ হয়েছে d। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি যদি v হয় এবং T যদি মহাবিশ্বের বয়স হয়, তবে d=vT, বা T=d/v, কিন্তু হাবলের সমীকরণ থেকে, d/v=1/H, তাহলে দাঁড়ায়—

T=1/H

গ্রাফ থেকে H মেপে ওপরের সমীকরণ ব্যবহার করে হাবল প্রথম মহাবিশ্বের বয়স বের করেন। আরও অনেক উপায়ে মহাবিশ্বের বয়স মাপা যায়। বিজ্ঞানীদের যন্ত্রপাতি যতই উন্নত হচ্ছে, এই বয়স মাপা ততই নির্ভুল হচ্ছে। এখন প্রায় সবাই একমত যে মহাবিশ্বের বয়স ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর (এক বিলিয়ন=১০০ কোটি)।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র