আমরা কি নিশ্চিত যে প্লুটো গ্রহ নয়

প্লুটো আবিষ্কারের ৯৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি মাইক ব্রাউন এবং ফিলিপ মেটজগারের মুখোমুখি হয়েছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের লেখক এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি  ও ইতিহাসবিষয়ক সম্পাদক এরিক আল্ট। সেই সাক্ষাৎকারটি বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার

১৯৩০ সালে ক্লাইড টমবো আবিষ্কার করলেন সৌরজগতের নতুন গ্রহ—প্লুটো। এরপর একে আমাদের সৌরজগতের নবম গ্রহ ঘোষণা করা হয়। প্লুটো দ্রুতই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর পেছনে মিকি মাউস কার্টুনের কিছুটা ভূমিকা আছে। কারণ মিকি মাউসের পোষা কুকুরের নামটাও ছিল ছোট্ট এ গ্রহের নামে।

কিন্তু ২০০৫ সালে প্লুটোর ভাগ্যে নেমে আসে ‘শনির দশা’ (পড়ুন, প্লুটোর দশা)। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটির জ্যোতির্বিদ অধ্যাপক মাইক ব্রাউন সৌরজগতে প্রায় প্লুটোর সমান একটা বস্তু আবিষ্কার করেন। এরিস নামের সেই বস্তুটার অবস্থান কুইপার বেল্টে। শুধু এরিসই নয়, প্লুটোর সমান আরও বস্তু আছে সৌরজগতে। ফলে প্লুটোকে আসলেই গ্রহ বলা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে জ্যোতির্বিদ ও গ্রহবিজ্ঞানীদের মধ্যে।

তুমুল তর্ক-বিতর্কের পর মহাকাশের কোনো বস্তুকে গ্রহ বলা যায় কি না, তার জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন, সংক্ষেপে আইএইউ (IAU)। কোনো বস্তুকে গ্রহের মর্যাদা দিতে হলে সেটিকে অবশ্যই এ শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। প্রথমত, গ্রহ হতে হলে একটা বস্তুকে সরাসরি একটি নক্ষত্রের চারদিকে ঘুরতে হবে (এই শর্তে চাঁদ গ্রহ নয়, উপগ্রহ)। দ্বিতীয়ত, নিজের মহাকর্ষ বলের প্রভাবে বস্তুটিকে গোল আকার ধারণ করতে হবে; এবং তৃতীয়ত, নিজের কক্ষপথে এত প্রভাবশালী হতে হবে, যাতে কক্ষপথ থেকে অন্য বস্তুগুলো সাফ করতে সক্ষম হয়। নতুন এই সংজ্ঞা অনুযায়ী গ্রহের মর্যাদা হারিয়ে বামন গ্রহের তালিকায় নাম ওঠে প্লুটোর।

এরপর থেকে প্লুটোবিরোধী এবং প্লুটোপন্থীদের মধ্যে প্লুটোর ভাগ্য নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। এসব বিষয় নিয়ে নিজের যুক্তি তুলে ধরে মাইক ব্রাউন একটি বইও লিখেছেন, যার শিরোনাম হাউ আই কিলড প্লুটো অ্যান্ড হোয়াই ইট হ্যাড ইট কামিং। অন্যদিকে প্লুটোপন্থীদের কাছেও প্লুটোর গ্রহ হওয়ার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্লুটোপন্থীদের মধ্যে অন্যতম হলেন নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারের সাবেক বিজ্ঞানী এবং ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার বর্তমান সহযোগী বিজ্ঞানী ফিলিপ মেটজগার।

প্লুটো আবিষ্কারের ৯৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি মাইক ব্রাউন এবং ফিলিপ মেটজগারের মুখোমুখি হয়েছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের লেখক এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি  ও ইতিহাসবিষয়ক সম্পাদক এরিক আল্ট। সেই সাক্ষাৎকারটি বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার

এরিক আল্ট: মাইক, আপনি কীভাবে সিদ্ধান্তে এলেন যে প্লুটো গ্রহ নয়? আর ফিলিপ, আপনি কেন এর বিপরীত ধারণায় বিশ্বাস করেন?

মাইক ব্রাউন: আমি ক্যালটেকে আসার পর থেকে সৌরজগতের বাইরের বস্তু এবং কুইপার বেল্ট নিয়ে গবেষণা করছি। ২০০০ সালের দিকে আমরা প্রথমবারের মতো বড় মাপের অনুসন্ধান শুরু করি। সেটা আমরা করেছিলাম প্লুটোর মতো বড় অন্য বস্তু খোঁজার জন্য। সেই সময় ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট (বামন গ্রহ) শব্দটা ছিল না। বামন গ্রহ নামটাই বাজে—কারণ এতে শুধু বিভ্রান্তি বাড়ে। আগে আমরা এদের বলতাম প্ল্যানেটয়েড। মানে ছোট গ্রহের মতো বস্তু। সেটাই বরং অনেক যুক্তিসংগত ছিল।

এরিক আল্ট: শব্দটাকে বিভ্রান্তিকর বলছেন কেন?

মাইক ব্রাউন: ‘বামন গ্রহ’ শব্দটা আসলে প্লুটোর পক্ষে থাকা বিজ্ঞানীরাই চালু করেন। কারণ তাঁদের আশা ছিল, পরে ভোট দিয়ে এই বামন গ্রহটাকে আবারও গ্রহের মর্যাদা দেওয়া যাবে। কিন্তু ভোটে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। তবে শব্দটা আমরা এখনও বয়ে চলেছি। আমি সেজন্য প্লুটোপন্থীদের দোষ দিই।

ফিলিপ মেটজগার: আমরা বলব, কুইপার বেল্টে অনেক বামন গ্রহ। আর কুইপার বেল্টে এই বামন গ্রহগুলোই হলো আসল গ্রহ। আমরা প্লুটোকে ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করছি না, বরং আমরা বলছি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সেই ভোটটাই অপ্রাসঙ্গিক। আইএইউ-এর আসলে এ ধরনের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। তারা নিজেদের নিয়ম ভেঙে সেই ভোট করেছে। আমাদের দাবি হলো, এটা কখনো গ্রহ থেকে বাদ পড়েনি। কারণ বিজ্ঞান তো চলমান প্রক্রিয়া। শ্রেণিবিন্যাস তো বিজ্ঞানেরই অংশ। আর এই শ্রেণিবিন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো, সেটা বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন এবং দরকারি বলেই মনে করেছেন। অথচ আইএইউ যেটা করেছে, সেটা জনসাধারণের জ্যোতিষবিদ্যাভিত্তিক মানসিকতা থেকে এসেছে। সেটা বিজ্ঞানের জন্য কার্যকর নয়। সেটা কোনো তত্ত্বের সঙ্গেও সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু দুভার্গ্যের ব্যাপার হলো, আইএইউ সেটাই গ্রহণ করেছে।

প্লুটো গ্রহ

এরিক আল্ট: তাহলে কোনো বস্তুর গ্রহ হওয়ার শর্তগুলো কী?

ফিলিপ মেটজগার: ২০০৬ সালে আইএইউ বলেছিল, গ্রহ হতে হলে তিনটি শর্ত মানতে হবে। প্রথমত, সেটাকে সরাসরি একটি তারাকে (যেমন সূর্য) প্রদক্ষিণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিজের মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নিজেকে গোলাকার রূপ দিতে হবে, যাকে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল রাউন্ডিং। আর তৃতীয় র্শত হলো, নিজের কক্ষপথে প্রভাব বিস্তার করে আশপাশের বস্তু সরিয়ে ফেলতে হবে।

এই শেষ শর্তটা বানানোই হয়েছিল প্লুটোকে বাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা এটা কীভাবে মাপবে, তা নির্দিষ্ট করেনি। তারা হয়তো দাবি করবে পৃথিবীও কোনো গ্রহ নয়, কারণ পৃথিবীও তো তার কক্ষপথ পুরোপুরি পরিষ্কার করতে পারে না। কাজেই এই শর্তটা নিজেই অস্পষ্ট।

মাইক ব্রাউন: ২০০০ সালের গোড়ার দিকে ডিজিটাল ক্যামেরার বেশ উন্নতি হয়েছিল। ফলে আমরা পুরো আকাশের ছবি একবারে তুলতে পারতাম। সেই প্রযুক্তি দিয়ে আমরা এরিসসহ আরও অনেক বড়, উজ্জ্বল বস্তু খুঁজে পাই। এরিস তো প্লুটোর চেয়েও বেশি ভারী। তখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হলো—আমরা নতুন অনেক গ্রহ যোগ করব, নাকি কিছু বাদ দেব। বর্তমানে যদি প্লুটো আবিষ্কৃত হতো, তাহলে কেউই একে গ্রহ বলত না।

এরিক আল্ট: তাহলে কি আমরা শুধু নয় সংখ্যার মোহে আটকে আছি? নয়টি গ্রহই চাই কেন? আটটি অথবা অসীম সংখ্যক গ্রহের কথা ভাবলেই কি আমাদের অস্বস্তি হয়?

মাইক ব্রাউন: না, ‘নয়টি গ্রহ’ কোনো ম্যাজিক নম্বর নয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে প্লুটোকে বাদ দিতেই হবে; আসল কথা হলো, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে গ্রহ সম্পর্কে আমরা এখন যা জানি, তার সঙ্গে এটি মানানসই নয়। প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে ধরে রাখার জন্য প্লুটোপন্থী দল একটি গ্রহের সংজ্ঞা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের এই সংজ্ঞা মেনে নিলে আমাদের সৌরজগতে আরও ২০০টি গ্রহ যোগ করতে হতো। মজার ব্যাপার হলো, এই প্লুটোপন্থী গোষ্ঠীর বেশির ভাগই নাসার প্লুটোতে নভোযান পাঠানোর মিশনে জড়িত ছিলেন। তাঁরা যখন মিশন শুরু করেন, তখন প্লুটো গ্রহ ছিল। কিন্তু যখন তাঁরা সেখানে পৌঁছান (অর্থাৎ মিশনের নভোযান প্লুটোতে পৌঁছায়), তখন এটি আর গ্রহ ছিল না।

ফিলিপ মেটজগার: এটা আসলে সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক নয়। প্রকৃতিতে কি এমন আর কিছু আছে? আমরা কখনো বলি ‘শুধু নয়টা পর্বত’ থাকবে? কিংবা ‘নয়টা নদী’ বা ‘নয়টা পোকা’? আমরা তো প্রকৃতি নিয়ে এমন সীমা দিই না।

এরিক আল্ট: স্কুলে আমাদের শেখানো হয়েছিল, সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যা নয়টি। তাহলে কি স্কুলে এ বিষয়টিকে আরও বিবর্তনশীল ধারণা হিসেবে পড়ানো উচিত?

ফিলিপ মেটজগার: একদম। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের শিক্ষা এখনো একটা পুরোনো ধারনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে—একটা সুশৃঙ্খল, নির্দিষ্ট সংখ্যার গ্রহ নিয়ে। এটা একধরনের পুরাতন ভ্রান্ত বিশ্বাস—যেন গ্রহেরা একেকজন দেবতা, যারা তাদের কক্ষপথে রাজত্ব করছে। এর ফলে আমরা পুরোনো ভূ-কেন্দ্রিক ধারণায় ফিরে যাচ্ছি। আমাদের যুক্তি হলো, তাদের শেখানো উচিৎ আমাদের মহাবিশ্ব গতিশীল। এখানে সবকিছু বদলায়, বিকশিত হয়। গ্রহেরাও তাদের কক্ষপথ বদলাতে পারে।

এরিক আল্ট: বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, প্লুটোর একটা বিকল্প থাকতে পারে—নতুন নবম গ্রহ। সেটা কি কেবল প্লুটোর একটা বিকল্প চাওয়ার কারণে?

মাইক ব্রাউন: না, নবম গ্রহ একধরনের জোরালো ব্যাখ্যা—এটা অনেক অজানা জিনিস বোঝার জন্য এবং ব্যাখ্যা করার জন্য খুব ভালো অনুমান। আমরা অনেক কিছু দেখছি, কিন্তু তার জন্য আমাদের কাছে অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে এখনো আমরা নবম গ্রহ দেখতে পাইনি। এটা এখনো কেবল একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।

কাল্পনিক প্ল্যানেট নাইন
উকিপিডিয়া

এরিক আল্ট: মানুষ প্লুটোকে নিয়ে এত আবেগী কেন? নবম গ্রহ বা অন্য নতুন গ্রহদের নিয়ে কেন এত অনীহা?

ফিলিপ মেটজগার: আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, নিউ হরাইজন নামের নভোযান যখন প্লুটোর পাশ দিয়ে উড়ে গলে, তখন আমি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। ওদের কন্ট্রোল সেন্টারে। প্রথম ছবিটা যখন ভেসে ওঠল, সেই মুহূর্তটা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর… এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ। সেখানে রকি পর্বতমালার মতো উঁচু পর্বতমালা আছে, হিমবাহ প্রবাহিত হচ্ছে, একটি বায়ুমণ্ডল আছে, সম্ভবত একটি ভূগর্ভস্থ সমুদ্র আছে এবং গ্রহের পৃষ্ঠের সর্বত্র জৈব পদার্থ আছে—আর সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে জীবনের মূল উপাদান। প্লুটো শুধু গ্রহই নয়—বরং আরেক পৃথিবীর মতো গ্রহ।

মাইক ব্রাউন: আমিও প্লুটোর প্রতি টান অনুভব করি। ছোটবেলায় আমাদের কাছে এটা ছিল অদ্ভুত, রহস্যময় একটা বস্তু। এটা যে অদ্ভুত, ছোট্ট এবং সুন্দর, তা কে অস্বীকার করতে পারবে? আর এখন এর ছবি দেখেছি। এটি দেখতে দারুণ। জায়গা হিসেবেও প্লুটো চমৎকার।