ডাইসনকে নিয়ে দুটি কথা

ডাইসন আক্ষরিক অর্থে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর কাজের ব্যাপ্তি ছিল বহুমাত্রিক। যেহেতু আমি নিজে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি, তাই শুধু পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

বিজ্ঞান আর গণিতজগতে তাঁর পথচলার শুরু কিশোরবেলাতেই। ১৭ বছর বয়সে বিখ্যাত গণিতবিদ জি এইচ হার্ডির সঙ্গে ডাইসন কাজ করার সুযোগ পান। (হার্ডি নিজে বড় গণিতবিদ ছিলেন, তবে সবচেয়ে বড় কাজ তাঁর শ্রীনিবাস রামানুজনকে আবিষ্কার)। কেমব্রিজের পড়াশোনার পর্ব শেষ করার পর ডাইসন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। পিএইচডি শুরু করেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত পদার্থবিদ হান্স বেথের তত্ত্বাবধানে। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণ পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের সঙ্গে। আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁদের মধ্যে।

সে সময় ফাইনম্যান কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির বিখ্যাত ফাইনম্যান নীতি প্রণয়ন করছিলেন। ডাইসনের ভাষ্যমতে ফাইনম্যান সে সময় কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির দুর্বোধ্য প্রণালিগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। তারপরও ছবি এঁকে, অঙ্ক কষে ঠিকই তিনি কোয়ান্টাম তড়িৎগতিবিদ্যার হিসাবগুলো ঠিক ঠিক মেলাতে পারছিলেন। এই হিসাবগুলো জুলিয়ান শুইঙ্গার আগেই শাস্ত্রীয় মতে করে রেখেছিলেন। সমস্যা হচ্ছিল ফাইনম্যান আর শুইঙ্গারের কাজ অন্যদের কাছে ছিল দুর্বোধ্য। অথচ দুটি কাজ অনেকটা একই দুর্ঘটনার দুটি আলাদা ভাষায় বর্ণনা করা বিবরণের মতো বলে মনে করতেন ডাইসন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেখালেন যে ফাইনম্যানের প্রণালি শুইঙ্গারের নিয়মের পুরোপুরি সমতুল্য। কিন্তু ফাইনম্যানের নিয়মে কাজ করা অনেক অনেক সহজ ও দ্রুত। শুইঙ্গারই এ জন্য বলেছেন, ফাইনম্যান চিত্রের কারণেই যে কারোর পক্ষেই কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি নিয়ে কাজ করা সম্ভব হলো।

ডাইসন আর শুইঙ্গারের কাজ যে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, সে প্রমাণটা দেখানোর সময়ই ডাইসন তাঁর বিখ্যাত ডাইসন সিরিজটির অবতারণা করেন। মজার ব্যাপার, এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার পর ডাইসন তাঁর পিএইচডির থিসিসটা জমা না দিয়ে ইংল্যান্ডে ফেরত গেলেন।

তখন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে হাঁটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে পিইচডি থাকাটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ডাইসনকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং ডাইসন আবার দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। এরপরই ছিল আরেক চমক। তখন পারমাণবিক বোমার জনক রবার্ট ওপেনহাইমার আজীবনের জন্য ডাইসনকে প্রিন্সটন অব অ্যাডভান্সড নিয়ে আসেন আজীবনের জন্য নিয়োগ দিয়ে। এখানে গবেষণা করা ছাড়া ডাইসনের আর কোনো দায়িত্ব ছিল। তাই নানা রকম প্রজেক্টে কাজ করা শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করে মহাকাশের রকেট বানানোর ডিজাইন করা। মহাকাশ আর গ্রহান্তরে জীবন নিয়ে ডাইসনের কৌতূহলের শুরু বোধ করি এখান থেকে শুরু হয়।

এবার পদার্থবিজ্ঞানে ডাইসনের অন্য গুরুত্বপুর্ণ কাজগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। একটা র‌্যান্ডম ম্যাট্রিক্স নিয়ে আর অন্যটা পদার্থের সাম্যাবস্থা নিয়ে। দ্বিতীয় সমস্যাটা বোঝানো তুলনামূলক সহজ। কারণ এটা আমরা দৈনন্দিন জীবনে দেখি। র‍্যান্ডম ম্যাট্রিক্সের সমস্যাটা একটু বেশি গাণিতিক। এ জন্য সুযোগ পেলে অন্য কোনো সংখ্যায় আলোচনা করব। পদার্থের সাম্যাবস্থার সমস্যাটাকে এভাবে দেখা যাক। আমরা জানি, নিউক্লিয়াসের আকর্ষণে ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর ভেতর আবদ্ধ থাকে। আবার পরমাণুগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ থাকে বলেই অনেকগুলো পরমাণু মিলে কঠিন বস্তু তৈরি করে। তাহলে কেন পদার্থ নিজের আকর্ষণের কারণেই আরও ঘন হয় না, চুপসে যায় না?

অনেক দিন পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে সমধর্মী চার্জের পারস্পরিক বিকর্ষণের কারণে এ ব্যাপারটি ঘটে না। ডাইসন ও তাঁর সহযোগী লেনার্ড ১৯৬৭ সালে দুটি পেপার লিখে প্রমাণ করেন, এই ধারণাটি ভুল। আদতে এর জন্য দায়ী পাউলির বর্জননীতি। সেটা একাদশ আর দ্বাদশ শ্রেণির রসায়নে পড়াই। অবশ্য গাণিতিকভাবে ডাইসনদের প্রমাণে সামান্য ত্রুটি ছিল। পরে লিয়েব আর থিরিং সংশোধন করেন সেটা। এই দ্বিতীয় প্রমাণটি তুলনামূলকভাবে সহজ যদিও ডাইসনদের যুক্তির লাইনটিই সঠিক।

ডাইসন একসময় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়েও কাজ করেছিলেন। যদিও তাঁর ধারণায় আমরা তাঁর ঋণাত্মক দিকটাই বাড়িয়ে দেখছি। তিনি মনে করতেন পৃথিবী গরম হচ্ছে কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাবটা আমরা বাড়িয়ে বলছি। তিনি বলতেন এর প্রভাবে যে শস্যাদির ফলন বাড়বে, সেটা কেউ হিসেবে আনছে না। ডাইসন কতটা সঠিক ছিলেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের যে ক্ষতিটা হবে তার জন্য আমরা তৈরি তো?

লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফিজিক্যাল সায়েনেস, ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়