মহাকাশে কি মহাকর্ষ আছে?

প্রকৃতির মৌলিক বলগুলোর মধ্যে মহাকর্ষ আমাদের সবচেয়ে পরিচিত। প্রতিদিনের জীবনে এটি আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। এর কারিকুরি নিয়মিতই দেখতে পাই আমরা। কাজে লাগে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে। অথচ এই মহাকর্ষ নিয়েই রহস্যটা সবচেয়ে বেশি।

সেই ১৭ শতকে নিউটন আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এই বলের সঙ্গে। তিনি বলেন, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু এই বল দিয়ে যুক্ত। আকর্ষণ করছে একে অন্যকে। এই আকর্ষণ বলের মান নির্ভর করে বস্তুর ভর আর মধ্যকার দূরত্বের ওপর।

মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে তা জানা গেলেও, মহাকর্ষ জিনিসটা আসলে কী, সেটা সে সময় জানা যায়নি। বিজ্ঞানীরা নানা সময় নানাভাবে এটিকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। অবশেষে তাত্ত্বিকভাবে মহাকর্ষকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন আইনস্টাইন। আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন স্থানকালের ধারণার সঙ্গে। বলেন, ভরযুক্ত প্রতিটি বস্তু নিজের চারপাশের স্থানকাল বাঁকিয়ে দেয়। সহজ করে তাই অনেকে বলেন, ভারী বস্তু বাঁকিয়ে ফেলে তার চারপাশে স্থানকালের চাদর। এই বেঁকে যাওয়া স্থানকালের প্রভাব হিসেবে আবির্ভূত হয় মহাকর্ষক্ষেত্র। যেহেতু মহাবিশ্বের সব ত্রিমাত্রিক ভরযুক্ত বস্তু স্থানকালের (Space-time Fabrication) মাঝেই রয়েছে, তাই সবারই আছে নিজস্ব মহাকর্ষক্ষেত্র।

আমরা মহাশূন্যে গ্রহ-নক্ষত্রদের ভেসে বেড়াতে দেখি। নভোচারীরাও যখন মহাশূন্যে যান, তারা ভেসে বেড়ান মুক্তভাবে। দেখে হয়ত মনে হতে পারে, মহাকাশে বুঝি মহাকর্ষ নেই। কারণ, পৃথিবীর মহাকর্ষের কারণেই তো আমরা পৃথিবীর বুকে আটকে থাকতে পারি। মহাকর্ষ না থাকলে এই আটকে থাকা সম্ভব ছিল না। মহাশূন্যে তাই ভাসমান মহাকাশচারীদের দেখে ‘মহাকর্ষ নেই’—এমন ধারণা আসা অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, মহাকাশের প্রতিটি বস্তুরই আছে মহাকর্ষক্ষেত্র। যেমনটা আগেই বলেছি। শুধু তাই নয়, আমরা মহাকাশের যে স্থানকে শূন্য মনে করি, সেখানেও আছে মহাকর্ষ। বস্তুর ভর যত বেশি হয়, তত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে থাকে তার মহাকর্ষক্ষেত্র। ছোট বস্তুর মহাকর্ষক্ষেত্রও হয় ছোট। এই ছোট মহাকর্ষক্ষেত্রের নাম, মাইক্রো গ্র্যাভিটি।

অনেকেই হয়ত জিরো গ্র্যাভিটি কথাটি শুনেছেন, কিন্তু মাইক্রো গ্র্যাভিটির কথা সেভাবে শোনেননি। আসলে, জিরো গ্র্যাভিটি বা ‘শূন্য-মহাকর্ষ’ নামে কিচ্ছু নেই!

এবার হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, মহাশূন্যে যদি মহাকর্ষ থাকেই, তাহলে মহাশূন্যে মানুষ বা অন্যান্য জিনিস ভাসে কেন? এর কারণটা বেশ মজার। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কথাই বলা যাক। সেখানে নভোচারীরা পুরোপুরি মুক্ত অবস্থায় ভাসতে থাকেন। কারণটা হচ্ছে, তাঁরা মূলত পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের মাঝেই মুক্তভাবে পড়ছেন। নিউটনেরও আগে গ্যালিলিও বলে গিয়েছিলেন, মুক্তভাবে পড়ন্ত সব বস্তুই সমান সময়ে একই দূরত্ব অতিক্রম করে। অর্থাৎ পৃথিবীতেই যদি বাতাসের সবটুকু বাধা সরিয়ে ফেলা যায় আর আপনি যদি উঁচু কোনো জায়গা থেকে লাফ দেন, তাহলে কিছু সময়ের জন্য মনে হবে আপনি পাখির পালকের মতোই ভেসে আছেন। তবে এই কাজটি ভূলেও সত্যি সত্যি করতে যাবেন না যেন! চাইলে চলে যেতে পারেন এজন্য বানানো বিশেষ কোনো বিনোদন কেন্দ্রে। পৃথিবীর অনেক বিনোদন কেন্দ্রে এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ আছে। তবে সেজন্য অর্থমূল্যে চড়া দরও পরিশোধ করতে হবে।

বুঝতেই পারছেন, ভেসে থাকার জন্য মহাকর্ষ শূন্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ভারহীনতা ও মহাকর্ষ শূন্যতা এক বিষয় না।

এবারে আপনার জন্য একটা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বা পৃথিবীর বাইরের মহাকাশে কোনো নভোচারী যদি মুক্তভাবে পড়তেই থাকেন, তাহলে কেন আসলেই পড়ে যান না? ভেসে থাকতে কেন দেখি? ভাবতে থাকুন। অন্য কোনোদিন হয়ত সেই গল্প করা যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: নাসা