জেমস ওয়েব মহাবিশ্বের একটি খুব ছোট অংশের ছবি তুলেছে, তার মধ্যে বহু গ্যালাক্সি ছড়ানো মণি-মুক্তার মতো। সেই ছবিটির যথার্থ রস আস্বাদনের জন্য সেই মণি-মুক্তার অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝা দরকার। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, জেমস ওয়েবের বিজ্ঞানীরা সেই কাজটি যথার্থভাবে করেননি, অর্থাৎ সাধারণকে সেই গভীর সময়ের ছবিটির পুরোপুরি অর্থ ব্যাখ্যা করেনি। পরবর্তীকালে তারা অবশ্য সেই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করেছেন। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ কিছুদিন যখন কৃষ্ণগহ্বরের ছবি প্রকাশ করেছিল, তখনো আমার মনে হয়েছিল সাধারণের কাছে এই ধরনের জনপ্রিয় আবিষ্কারকে তুলে ধরার সময় বিজ্ঞানীরা খুব সরল বর্ণনার আশ্রয় নেন। ব্যাপারটা এমন যে, তাঁরা অবিশেষজ্ঞদের প্রাকৃতিক বিচক্ষণতায় আস্থা রাখেন না।
প্রথমেই বলি এই ধরনের গভীর সময়ের ছবি হাবল দুরবিনও তুলেছে। যদিও সেগুলোর স্পষ্টতা কম ছিল, কিন্তু সেই ছবিগুলোর গ্যালাক্সিগুলো থেকে আলো আসতে ১৩০০ কোটি বছরের বেশি সময় লেগেছে। এবার জেমস ওয়েবের ছবিটি দেখা যাক :
১. ছবিটিতে উজ্জ্বল তারাগুলো- যেগুলো থেকে আটটি ছটা বের হচ্ছে- সেগুলোকে অগ্রাহ্য করুন। সেগুলো আমাদের গ্যালাক্সির তারা। এই ছটাগুলোকে বলে ডিফ্রাকশন স্পাইক (diffraction spike), সেগুলো কাছের তারাদের অতি উজ্জ্বল আলো জেমস ওয়েব দুরবিনের বিভিন্ন অংশে প্রতিফলনের কারণে তৈরি হয়েছে।
২. ছবিটির কেন্দ্রের দিকে দেখবেন, কিছু সাদা গ্যালাক্সি জটলা পাকাচ্ছে। এটাকে বলা হচ্ছে এসমএসিএস ০৭২৩ গ্যালাক্সিদল (cluster)। এটি একটি অখ্যাত গ্যালাক্সিদল– যদিও হাবল দুরবিন এটিকে পর্যবেক্ষণ করেছিল। এটি সম্বন্ধে আমাদের সেরকম কিছু বলা হয়নি, শুধু জানি এখান থেকে আলো আসতে ৪৬০ কোটি বছর লাগছে।
৩. খেয়াল করে দেখুন, কেন্দ্রের চারদিকে একটি বৃত্তের পরিধিতে কয়েকটি সরু বক্রাকার গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে। মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের ফলে একটি পেছনের গ্যালাক্সির আলো তার সামনে কোনো বড় ভর থাকলে সেটির দেশকালের বক্রতা অনুসরণ করে ভরটির সামনে (তার চারদিকে) কয়েকটি বিম্বে বিভক্ত হয়ে যায়। এরকম লেন্সিংয়ের বহু উদাহরণ আছে। মনে হচ্ছে, এরকম অন্তত একটি গ্যালাক্সিকে আমরা দেখছি। ওয়েবের বিজ্ঞানীরা লেন্সিংয়ের ফলে ঠিক কটি গ্যালাক্সি আমরা দেখছি, সেটি বলছেন না। কিন্তু তারা কি এই লেন্সড গ্যালাক্সিগুলোর আলোর বয়স ১৩০০ কোটি বলছেন? মনে হয় না, কারণ লেন্সড গ্যালাক্সিটি (বা গ্যালাক্সিগুলি) এসমএসিএস ০৭২৩ গ্যালাক্সিদল থেকে খুব পেছনে মনে হয় না।
৪. খেয়াল করুন, ছবিতে আরও বক্রাকার গ্যালাক্সি আছে। সেগুলোও কি লেন্সড? মনে হয় না, কিন্তু এর মধ্যে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ক্যামেরার লেন্সড ডিস্ট্রোশন (distortion)-এ অনেক গ্যালাক্সিই কেন্দ্রের চারদিকে একটা বক্রাকার পথে সজ্জিত। তবে কয়েকজন জ্যোতির্বিদ বলছেন, এই গ্যালাক্সিগুলি পারস্পরিক আকর্ষণের কারণে এরকম আকার পেতে পারে।
৫. ওপরের কথনটিকে সিরিয়াসলি নিতে বলছি না, কিন্তু তুলনা হিসেবে হাবল ডিপ ফিল্ডের একটি ছবি দেখাচ্ছি। এরকম ডিস্ট্রোশন প্রথম দৃষ্টিতে সেখানে স্পষ্ট নয়।
৬. তাহলে কোন গ্যালাক্সিটা সবচেয়ে দূরে? ওয়েবের NIRSpec যন্ত্রটি একইসঙ্গে কয়েকটি গ্যালাক্সির বর্ণালী বিশ্লেষণ করতে পারে। সেই ভিত্তিতে এই ছবির বাইরের দিকে ম্লান লাল গ্যালাক্সিগুলো থেকে আলো আসতে ১৩০০ কোটি বছরের ওপরে লাগছে।
৭. এই ছবিটি আকাশের কতটা অংশ জুড়ে আছে? ওয়েবের বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি বালুকণাকে এক হাত দূরত্বে রাখলে সেটি আমাদের চোখে যে আকার সৃষ্টি করবে আকাশে এই ছবিটির আকার ততটুকুই। এই উপমাটি আমার পছন্দ হয়নি। একটি বালুকণার আকার কতটুকু? সেটা 0.05 থেকে 2 মিলিমিটার হতে পারে। আর এক হাত দূরত্বটাই বা কত? আমি যদি এক হাত দূরত্ব 0.5 মিটার ধরি, তবে সেই বালুকণা আমার চোখে 0.005 থেকে 0.2 ডিগ্রি কোণ প্রক্ষেপণ করবে। পূর্ণ চাঁদ হল 0.5 ডিগ্রি। ওনারা কি বলতে পারতেন না, এই ছবিটি চাঁদের 0.2/0.5 = 40% অংশ বা 0.005/0.5 = 1%? 1% আর 40% এর মধ্যে তো বিশাল পার্থক্য, প্রথমেই দরকার ছিল ছবিটি চাঁদের তুলনায় কতটা ছোট সেটা বলে দেয়া।
৮. বিজ্ঞানকে সাধারণের কাছে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা দরকার। অনেক বিজ্ঞানীই সাধারণের বোধ-ক্ষমতার ওপরে আস্থা রাখেন না। এই সব সমালোচনার উদ্দেশ্য জেমস ওয়েবকে খাটো করার জন্য নয়, এটি মানুষের কৌতূহল, মেধা ও সৃষ্টিশীলতার এক অত্যাশ্চর্য মেলবন্ধন। সেই দুরবিন যা পাবে তা আমাদের সবার সম্পদ। আমরা সেই সম্পদকে গুরুত্ব দিই বলে এত কথা।
লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র