সাক্ষাৎকার

বিজ্ঞানে পরিশ্রমের বিকল্প নেই—বিমান নাথ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী

অধ্যাপক বিমান নাথ জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ভারতের বেঙ্গালুরুর রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কর্মরত। বর্তমানে গবেষণা করছেন মহাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গ্যাস এবং সেই গ্যাসের সঙ্গে গ্যালাক্সি ও অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর মিথস্ক্রিয়া নিয়ে।

তাঁর বেড়ে ওঠা ভারতের আসামে। দিল্লি ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। পাশাপাশি বর্তমানে লেখালেখি করছেন বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে। ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে সহজ ভাষায় বই লিখেছেন। তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক বইগুলোর মধ্যে নক্ষত্রের গান, মহাবিশ্বের প্রথম আলো উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন বিবিধ পুরস্কার।

বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের ঝুলি উপুড় করে দিয়েছেন। তাঁর বেড়ে ওঠা, গবেষণার বর্ণনা, ভারতের চন্দ্রজয়সহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।

বিজ্ঞানচিন্তা :

শুরুতেই সাম্প্রতিক একটি বিষয় জানতে চাই। ভারত গত জুলাইয়ে সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান-৩ পাঠিয়েছে। এ নিয়ে আপনি বিজ্ঞানচিন্তায় লিখেছেন। এ ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কী?

বিমান নাথ: এ ব্যাপারে প্রযুক্তিবিদদের সাফল্যের প্রশংসা করতেই হয়। এ সাফল্য ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মনে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। আশা করি, তাঁরা এখানেই থেমে না গিয়ে ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন। যাতে এই সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে শুধু প্রযুক্তি নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও নতুন জোয়ার আসে।

বিজ্ঞানচিন্তা :

আপনার সহকর্মীরা চাঁদকে প্রদক্ষিণরত যন্ত্র বানাতে কাজ করেছেন। আপনি নিজেও কি ভবিষ্যতে কোনো চন্দ্রাভিযান বা মহাকাশ অভিযানের সঙ্গে জড়িত হবেন?

বিমান নাথ: না। আমার গবেষণার ক্ষেত্র ভিন্ন।

বিজ্ঞানচিন্তা :

শুনেছি, নবম-দশম শ্রেণিতে থাকতে আপনার বাবা একটি দুরবিন কিনে দিয়েছিলেন। ওই টেলিস্কোপে আকাশ দেখেই আপনি বড় হয়ে জ্যোতির্বিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এটা কি সত্যি?

বিমান নাথ: হ্যাঁ। দশম শ্রেণির পরীক্ষার সময় নয়াদিল্লির এক কোম্পানির বানানো টেলিস্কোপের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। ২ দশমিক ৫ ইঞ্চি ব্যাসের আয়না লাগানো একটি নিউটনীয় দুরবিন। সেটাই আমাকে কিনে দিয়েছিলেন মা-বাবা।

বিমান নাথের আঁকা ছবি
ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানচিন্তা :

এবার আরেকটু পেছনে ফিরে যাই। আপনার শৈশব-কৈশোরের কথা বলুন, বেড়ে ওঠার কথা বলুন।

বিমান নাথ: আমার বাবা ছিলেন পূর্ত বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার। বদলির চাকরি ছিল তাঁর। তাই জায়গা বদলের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আমার জন্ম আসামের ধুবড়ি শহরে। শৈশব কেটেছে বাসুগাঁও নামের এক ছোট গ্রামে। রেলস্টেশনের কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। বিদ্যুৎ ছিল না তখন। মা–বাবার ইচ্ছা ছিল বাড়িতেই পড়াশোনা করি। ফলে তাঁদের কাছেই হাতেখড়ি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমরা দক্ষিণ আসামে চলে যাই। তেমন পরিচিত নাম নয়, এমন কয়েকটি শহরে থাকার পর চলে আসি শিলচরে। গ্রামের স্কুলে পড়ার জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে আমাকে মানুষের কাছাকাছি থাকতে সাহায্য করেছে। সেটা নক্ষত্রের জগতে উঁকি দেওয়ার সময়ও। লেখার সময়ও সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগে। যেমন মনে আছে, ছোটবেলায় এক পীর সাহেব আমাদের বাড়িতে আসতেন। পরে ফকির বিদ্রোহ নিয়ে উপন্যাস লেখার সময় সেই ছোটবেলার পীর সাহেবের স্মৃতি কাজ করেছিল আমার কল্পনায়।

ছেলেবেলায় খুব অসুখে ভুগতাম। বোধ হয় সে কারণে খেলার মাঠের চেয়ে বইয়ের সঙ্গে বেশি সখ্য তৈরি হয়েছিল। সেই অভ্যাস এখনো আঁকড়ে ধরে আছি।

দাদা ও ছোট বোনের তুলনায় আমার ছোটবেলা ছিল অসুখে ভরা। টনসিল থেকে শুরু করে এমন কোনো অসুখ নেই, যাতে আমি ভুগিনি। তাই খেলাধুলা পারতাম না বিশেষ। বই পড়ে অবসর সময় কাটত।

বিজ্ঞানচিন্তা :

আপনি যে টেলিস্কোপ কিনতে চাইলেন, এতে আগ্রহী হলেন কীভাবে? বিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে কি বিশেষ কোনো ঘটনা আছে?

বিমান নাথ: মনে আছে, নবম শ্রেণির পাঠ্যবইতে নক্ষত্রের দূরত্ব মাপার কথা পড়ে খুব অবাক হয়েছিলাম। তখন আমরা আসামের শিলচরে থাকি। স্থানীয় সরকারি পাঠাগারে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই খুঁজে পড়তে শুরু করেছিলাম। সে এক নেশার মতো পেয়ে বসেছিল আমাকে। দিন দিন সেই আগ্রহ বেড়েছে। আকাশের তারাগুলোর সঙ্গে চেনাজানা তখনই। তারপর দুরবিন পাওয়ার পর চাঁদের গর্তগুলোর দিকে নজর পড়েছিল। সেগুলোর উচ্চতা মাপতাম। লাইব্রেরিতে গিয়ে প্যাট্রিক মুরের লেখা অ্যাস্ট্রোনমার’স স্টারস বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিতাম, আমার মাপজোখ ঠিক আছে কি না। ক্যামেরা ছিল না। তাই যতটুকু পারি স্কেচ করে রাখতাম। সেই থেকে স্কেচ করার শখ জন্মেছিল। সেই শুরু। তবে এখন আর চাঁদ নয়, পছন্দের জিনিস দেখলে পেনসিল নিয়ে বসে যাই।

বিজ্ঞানচিন্তা :

ভারতীয় উপমহাদেশে—ভারত, বাংলাদেশে সাধারণত মা–বাবা টেলিস্কোপ বা এ ধরনের বিষয়ে আগ্রহ দেখান না। আপনার বাবা এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম। শুনেছি, তাঁর জন্ম বাংলাদেশে। তাঁদের কথা—আপনার বাবা, মা, ভাই ও বোনের কথা বলুন।

বিমান নাথ: বাবা অনেক দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন। পেশায় পূর্ত বিভাগের এক সাধারণ ইঞ্জিনিয়ার হলেও তাঁর আগ্রহ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে। আমাদের তিন ভাইবোনের জন্য বাড়িতে এক অভিনব পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রায় দুই বছর অন্তর বিভিন্ন জায়গায় বদলি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বাড়িতে বইয়ের ভালো সংগ্রহ ছিল। সেখানে ক্ল্যাসিক বইগুলো ছিল। দেশ, শুকতারা ম্যাগাজিন ইত্যাদি আসত নিয়মিত। এগুলো আমাদের বাসায় বাঁধাই করে রাখা হতো। বাংলার সঙ্গে যাতে ইংরেজি শিখতে পারি, সেদিকে নজর ছিল তাঁর। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি নিয়মিত আসত বাড়িতে। দৈনিক খবরের কাগজ তো ছিলই। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ের পেপারকাটিংয়ের সংগ্রহ ছিল। কোনো বই পড়ার পর সেই বই সম্পর্কে নিজের চিন্তা লিখে রাখার অভ্যাস করিয়েছিলেন আমাদের। দুই ভাষায় লেখালেখি করার ইচ্ছা বোধ হয় সেখান থেকে এসেছিল।

বাবা নিজে গান শেখার সুযোগ পাননি। কিন্তু মা–বাবা দুজনেরই শখ ছিল। তাই বাড়িতে গানবাজনার জলসা বসত। যাতে শুনতে শুনতে আমাদের গানের কান তৈরি হয়। তখনকার দিনে যেভাবে আমাদের সবাইকে শাস্ত্রীয় সংগীতের হাতেখড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, সে কথা ভেবে এখনো অবাক হই। কারণ, বেশির ভাগ সময় আমরা ছোট জায়গায় থেকে বড় হয়েছি। অনেক দূর থেকে শিক্ষকদের আসতে হতো। এ ছাড়া ডাকটিকিট সংগ্রহের আগ্রহ তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন। বাবার বদলির কারণে যখন ছোট প্রত্যন্ত গ্রামে থাকতে হতো, তখনো। ডাকটিকিট সংগ্রহবিষয়ক ম্যাগাজিনও আসত আমাদের বাড়িতে।

বাবার ব্যতিক্রমী স্বভাব সম্ভবত আমার ঠাকুরদার কাছে থেকে পাওয়া। বাংলায় বল্লাল সেনের আমল থেকে নাথ-গোষ্ঠী ব্রাত্য। তা সত্ত্বেও সেই গ্রামে আমার ঠাকুরদার এক বিশেষ অবস্থান ছিল তাঁর আত্মদীপ্ত মনোভাবের জন্য। তিনি চেয়েছিলেন ছোট ছেলেকে, মানে আমার বাবাকে চাষবাসের বদলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে। বাবার জন্ম শ্রীহট্ট বা সিলেটের (পঞ্চখণ্ড) লাউতা গ্রামে। সেখানকার প্রকৃতির কোলে বড় হওয়ার অনেক গল্প শুনেছি তাঁর কাছে। পরে বিয়ানীবাজারে এমই স্কুল এবং তারপর করিমগঞ্জের নীলমণি হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে পাস করে গুয়াহাটিতে যান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। আমার মাতৃবংশও শ্রীহট্টের করিমগঞ্জের কাছে। দুল্লভছড়া গ্রামে বসতি ছিল তাঁদের। মৃত্যুর আগে বাবাকে একবার তাঁর জন্মভূমি দেখাতে পারলাম না, এ আফসোস আমার আজীবন থাকবে।

বাবা-মার সঙ্গে ছোট্ট বিমান নাথ ও তাঁর বোন
ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানচিন্তা :

এটা আসলেই খুব দুঃখজনক। বাংলাদেশে এলে আপনার বাবার হয়তো ভালো লাগত। আচ্ছা, এবারে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানতে চাই। আপনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। আসাম থেকে দিল্লিতে গিয়ে মানিয়ে নেওয়া এবং সেখানে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

বিমান নাথ: ১৭ বছর বয়সে আমি প্রথম বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলাম তা নয়, আসামের বাইরেও সেই আমার প্রথম পদক্ষেপ। তাই খুব অসুবিধা হয়েছিল। বিশেষ করে ভাষা নিয়ে। তবে বন্ধুবান্ধব পেতে সময় লাগেনি। আর শিক্ষকেরাও ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। পদার্থবিদ্যার সঙ্গে সেখানেই প্রকৃত পরিচয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার পাঠ্যক্রম তখন খুব আধুনিক ও ব্যতিক্রমী ছিল। পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর সময় গণিতের ওপর আর কোথাও এত জোর দেওয়া হতো বলে মনে হয় না। পরিচয় হয়েছিল জীবনের সঙ্গেও। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে একাধিক কলেজগুলোর যে মিলিত পরিবেশ, তা আর কোথাও নেই বলে আমার ধারণা।

পদার্থবিদ্যার সহপাঠীরা তো ছিলই, ইংরেজি সাহিত্যের একাধিক বিদেশি (তিব্বতি, আফ্রিকান) ছাত্রদের সঙ্গে মিশতাম। তাদের পাঠ্যবই ধার করে নিয়ে পড়তাম। কঠিন অংশগুলো বুঝিয়ে দিত তারা। অর্থনীতির ছাত্রদের সঙ্গেও আমার ছিল বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে শুধু অন্য বিষয় সম্পর্কে কৌতূহলীই করেনি; বরং পদার্থবিজ্ঞানই সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়—এমন ভুল ভাবনা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা :

এরপর আপনি যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন পড়াশোনা করতে। সেখানেই মাস্টার্স ও পিএইচডি করলেন। আপনার পিএইচডি গবেষণা কী নিয়ে ছিল?

বিমান নাথ: যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান আরও গভীর পাঠের সুযোগ পেয়েছিলাম। পিএইচডির বিষয় ছিল বিশ্বতত্ত্ব বা কসমোলজি। মহাবিশ্বের ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে শক্তিশালী বিস্ফোরণের ফল কী হতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা দিয়ে এ বিষয়ে আমার হাতেখড়ি।

বিজ্ঞানচিন্তা :

এখানে আরেকটু জানতে চাই। আপনার তো আগ্রহ ছিল পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায়। সেখান থেকে তাত্ত্বিক বিষয়ে আগ্রহী হলেন কীভাবে?

বিমান নাথ: হ্যাঁ, সত্যি আমার পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা করার ইচ্ছা ছিল। এ জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কয়েকটা বিষয়ে হাতেখড়িও নিয়েছিলাম। রেডিও তরঙ্গ পর্যবেক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার কিট পিক মানমন্দিরে গিয়েছিলাম। ফ্ল্যাগস্টাফ লোয়েল মানমন্দিরে ধূমকেতু নিয়ে কাজ করেছি। তথ্য বিশ্লেষণের কাজও করেছিলাম সক্রিয় গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে। এ কাজগুলোর ওপর লেখা গবেষণামূলক প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। কিন্তু একই সময় ডেভিড আইকলারের সঙ্গে তাত্ত্বিক কাজ করেছিলাম। সে গবেষণার অভিজ্ঞতা এত ভালো লেগেছিল যে আর ফিরে তাকাইনি। তাঁর চিন্তা করার ধরন আমার কাছে খুব আকর্ষক মনে হয়েছিল। তিনি একসময় ইসরায়েল চলে গেলে আমিও এক বছরের জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। সে আরেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কারণ, সে সময় প্রথম ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

বিমান নাথের শৈশবের ছবি
ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানচিন্তা :

পরে কী হলো?

বিমান নাথ: এর মধ্যে দুই বছর জার্মানির বন শহরে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব রেডিও অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছিলাম। পিটার বিয়ারম্যানের সঙ্গে নভোরশ্মি (কসমিক রে) নিয়ে গবেষণা করি। সেখানে সমবয়সী অন্য গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করে আরও নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করি, যেমন সক্রিয় গ্যালাক্সি নিয়ে। বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে কাজ করার সাহস পেয়েছিলাম এ অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে। সেগুলো পরে আমার গবেষণায় পাথেয় হয়েছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা :

আচ্ছা, এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। বিজ্ঞানের কি শেষ গন্তব্য বলে কিছু আছে? থাকলে সেটা কী?

বিমান নাথ: বিজ্ঞানের লক্ষ্য যদি হয় প্রকৃতিকে গভীরভাবে জানা, তাহলে আমার মনে হয় না শেষ গন্তব্য বলে কিছু আছে। কারণ, গভীর থেকে গভীরতর স্তরে এই যাত্রার কোনো শেষ নেই। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না। কারণ, গন্তব্যে পৌঁছানোর তুলনায় যাত্রাপথের রোমাঞ্চটা আমার কাছে বড় বলে মনে হয়। কার্ল সাগান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘The universe will always be much richer than our ability to understand it।’ মানে আমাদের যতটা বোঝার সক্ষমতা আছে, মহাবিশ্ব তার চেয়েও ব্যাপক, তার চেয়েও রহস্যময়। আমারও তা–ই মনে হয়।

বিজ্ঞানচিন্তা :

থিওরি অব এভরিথিং কি বিজ্ঞানীরা আদৌ অর্জন করতে পারবেন?

বিমান নাথ: আমার মনে হয় না। ওটা তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাহায্যে পদার্থবিদেরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, কীভাবে একটা সাধারণ সাইকেল ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে! থিওরি অব এভরিথিংয়ের কথা তাই হাস্যকর।

বিমান নাথের বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানচিন্তা :

এবার আপনার লেখালেখির বিষয়ে জানতে চাই। আপনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতে বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছেন, এখনো করছেন। লেখালেখির আগ্রহ বা তাড়না আপনার মধ্যে কীভাবে এল?

বিমান নাথ: লেখার ভূত বোধ হয় শৈশবে চেপেছিল। তখন থেকেই বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই লেখার চেষ্টা করেছি। দিল্লিতে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনার সময় হিন্দুস্তান টাইমস-এর রোববারের ক্রোড়পত্রে লিখেছিলাম দুবার। একবার কলেজ থেকে হিমালয়ে গিয়েছিলাম—সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছি। এ লেখার সঙ্গে আমার আঁকা স্কেচও ছাপা হয়েছিল। আরেকবার লিখেছিলাম সারনাথ বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে। ইসরায়েলে থাকার সময় হিব্রু ভাষার ঔপন্যাসিক আমোস অজের সাক্ষাৎকার নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লিখেছিলাম। তবে লেখার ক্ষেত্রে আমার জীবনে একটা মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল ইসরায়েলে এক বছর থাকার সময়। প্রথম ইরাক যুদ্ধের সময় একাকিত্ব কাটাতে আবিষ্কার করেছিলাম, আমি সত্যি লিখতে ভালোবাসি। শুধু কোনো পত্রিকায় লেখা প্রকাশের আনন্দ নয়, মনের কোনো ভাব বোঝাতে জুতসই শব্দবন্ধ খুঁজে পাওয়ার আনন্দের কথা বলছি।

বিজ্ঞানচিন্তা :

আপনি তো ফিকশনও লিখেছেন?

বিমান নাথ: আগে ভাবিনি, উপন্যাস লিখব। কিন্তু অনেক দিন একটা গল্প মাথায় ঘুরছিল। প্রথমে অনেক চেষ্টা করেছিলাম বিষয়টি গুরুত্ব না দেওয়ার। কিন্তু একসময় যেন ভূতে ধরার অবস্থা হলো। না লিখে উপায় ছিল না আমার। প্রায় পরপর দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছিলাম। নাথিং ইজ ব্লু (হার্পারকলিন্স ইন্ডিয়া, ২০০৯) ছিল সপ্তম দশকের গল্প। সেখানে একটি চরিত্রে হিউয়েন সাং ছিলেন। কল্পনা করার চেষ্টা করেছিলাম, তিনি যখন শূন্যতা নিয়ে আলোচনা করতেন, ঠিক সেই সময় ব্রহ্মগুপ্ত গণিতের শূন্যের কথা বলেছিলেন। সেই কথা শুনে হিউয়েন সাং কী ভেবেছিলেন?

এরপর ফকির বিদ্রোহ নিয়ে মেতে ছিলাম কয়েক বছর। দ্য টাটুড ফকির (প্যানম্যাকমিলান ২০১২) লেখার সময় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামায় মজনু শাহর গল্প পড়েছিলাম। তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে গিয়েছিলাম সেই সময়কার ইতিহাসের খোঁজে। লিখতে বসে পুতুল খেলার মতো সেসব কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে সময় কাটানোর আনন্দ তো আছেই, আরও খুশি হয়েছিলাম বই প্রকাশের পর মাকানপুরে মজনু শাহর সমাধি যাঁরা দেখভাল করেন, সেই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে। যেখানে মজনু শাহর ফকিরের দল প্রতিবছর এসে জমায়েত হতো। যে জায়গার কথা কল্পনা করে রাতের পর রাত বসে লিখেছি, সেই জায়গায় একটা দিন কাটাতে পেরেছিলাম। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। আমার নিতান্ত সাদামাটা জীবনে এসব মুহূর্ত স্বর্গীয় আনন্দ এনে দিয়েছে।

বিজ্ঞানচিন্তা :

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? অবসরের পরে কী করবেন, ভেবেছেন কিছু?

বিমান নাথ: এখনো জানি না। যদিও গত দু–তিন দশকে গবেষণার ধরন অনেকটা বদলেছে। তারপরও নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছি। অবসরের পরও তা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। দেখা যাক। পাশাপাশি লেখার কাজ তো চলবেই, যত দিন না শরীর বাদ সাধে। কারণ, আরও অনেক বিষয় নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে।

বিজ্ঞানচিন্তা :

বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আপনার ধারণা কী?

বিমান নাথ: বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে বিশদভাবে পরিচিত নই। তবে এখানকার ছাত্রদের সম্বন্ধে যতটুকু জানি, তাতে মনে হয় ভবিষ্যৎ অনেক সম্ভাবনাময়। তবে তার সঙ্গে সরকারের সদিচ্ছা ও অনুদান দরকার। বিশেষ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। খুব ভালো হতো যদি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের জগতে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়ত। তাহলে তৈরি হতো একযোগে কাজ করার সম্ভাবনা।

বিজ্ঞানচিন্তা :

বিজ্ঞানচিন্তায় আপনি লিখছেন। বিজ্ঞানচিন্তা নিয়ে আপনার মতামত শুনতে চাই।

বিমান নাথ: বাংলায় বিজ্ঞানের এমন একটা মাসিক ম্যাগাজিন বের করা সহজ নয়। সম্পাদকমণ্ডলী সেই কঠিন কাজটা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টা সত্যি প্রশংসনীয়। যেভাবে একেকটা বিষয় নিয়ে লেখা থাকে প্রতি সংখ্যায়, তাতেই বোঝা যায়, এর পেছনে রয়েছে অনেক দিনের পরিকল্পনা ও কাজ। খুব গর্ব হয় এ কথা ভেবে যে আমার মাতৃভাষায় এমন একটি ম্যাগাজিন আছে। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আগামী সংখ্যাগুলোর জন্য।

বিজ্ঞানচিন্তা :

যাঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে পড়তে চান, তাঁদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? শিক্ষার্থীদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরও আগ্রহী করে তুলতে কী করা যেতে পারে?

বিমান নাথ: জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রস্তুতির জন্য অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ নেওয়া জরুরি। আমার মনে হয়, স্নাতক পর্যায়ের পাঠগুলো মনোযোগ দিয়ে করা খুব দরকার। তা হলেই পায়ের নিচের জমি শক্ত হবে। আজকাল ইন্টারনেটের বদৌলতে অনেক কিছু শেখার সুযোগ আছে। সেগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা কাজে লাগাতে পারে। সেটা প্রোগামিং হোক বা অন্য কিছু। সম্ভব হলে অ্যাস্ট্রোনমির অ্যামেচার ক্লাবগুলোতে যোগ দিলে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা হবে। এতে এ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ আরও বাড়বে।

বিজ্ঞানচিন্তা :

বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকেরা কিশোর ও তরুণ। তাঁদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক কিছু বলুন।

বিমান নাথ: বেড়ে ওঠার সময় স্বপ্ন দেখা খুব জরুরি। কারণ, কৈশোরের স্বপ্নগুলো জীবনের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করে। তবে সেই স্বপ্ন সফল করার জন্য দরকার পরিশ্রম করার প্রতিশ্রুতি। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিশ্রমের বিকল্প নেই।

*সাক্ষাৎকারটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত