পৃথিবী ও আকাশ
দূরবীক্ষণ ও মানমন্দির
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পেশার প্রথম ও সবচেয়ে জরুরি হাতিয়ার হলো দূরবীক্ষণ। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে দূরবীক্ষণ আবিষ্কার এত বড় ভূমিকা রাখে যে এর বিষয়ে অল্প কিছু অন্তত জানা দরকার।
কয়েকজনের হয়তো চোখ খারাপ, সামনের বা দূরের জিনিস দেখতে কষ্ট হয়। কেউ বা কাছের জিনিস দেখে, দূরের জিনিস ঠিক মতো বুঝতে কষ্ট হয়। অন্যরা দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখে, কিন্তু ছাঁচে সুতো পরানো বা বইয়ের অক্ষরবিচার আসে না।
চশমার সাহায্যে চোখ খারাপ সারাতে শেখে লোকে দীর্ঘ দিন আগে। যারা দূরের জিনিস দেখে, তাদের লেন্স দুদিকে উত্তল বা কনভেক্স। আর যারা কাছের জিনিস দেখে, তাদের লেন্স অবতল বা কনকেভ।
প্রথম ধরনের লেন্সের দুটো দিকই উদ্গত, মধ্যিখানটা ধারের চেয়ে পুরু। আকারটা আতশি কাচের মতো। দুদিক কনভেক্স লেন্সের মধ্য দিয়ে বইয়ের অক্ষর বড় দেখায়—সে জন্য এর নাম ম্যাগনিফায়িং গ্লাস। দুদিক কনকেভ লেন্স ঠিক তার উল্টো—ধারগুলো মধ্যিখানের চেয়ে পুরু। এতে জিনিস দেখায় ছোট।
এভাবে-ওভাবে চোখের সামনে সেগুলো রাখতে রাখতে অতর্কিতে একটা লেন্স রাখল অন্যটার সামনে—মনে হলো দূর গির্জার গম্বুজটা হঠাৎ অতি কাছে এসে পড়েছে। বাপকে কথাটা বলায় সে দুটো লেন্সকে একটা টিউবের মধ্যে রাখে। এভাবে নাকি প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভব
সাড়ে তিন শ বছর আগে আচমকা একটা আবিষ্কারের গল্প প্রচলিত আছে। এক চশমানির্মাতার ছেলে দুদিক কনভেক্স ও দুদিক কনকেভ লেন্স নিয়ে খেলছিল। এভাবে-ওভাবে চোখের সামনে সেগুলো রাখতে রাখতে অতর্কিতে একটা লেন্স রাখল অন্যটার সামনে—মনে হলো দূর গির্জার গম্বুজটা হঠাৎ অতি কাছে এসে পড়েছে। বাপকে কথাটা বলায় সে দুটো লেন্সকে একটা টিউবের মধ্যে রাখে। এভাবে নাকি প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভব।
গল্পটা সত্যি কি মিথ্যে, তাতে কিছু এসে-যায় না। জরুরি কথাটা হলো এই—১৬০৫ সাল নাগাদ প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র দেখা দিল ইউরোপে। একটা টিউবে তৈরি (এখনকার ফিল্ড বা অপেরা-গ্লাসের মতো দুটোতে নয়), এক চোখ বুজে অন্যটা দিয়ে দেখতে হতো।
গ্যালিলিও যে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আশ্চর্য কয়েকটি আবিষ্কার করেন, সে কথা তোমরা জানো। কিন্তু তাঁর যন্ত্র নিখুঁত ছিল না।
দক্ষ কারিগররা দূরবীক্ষণ যন্ত্রকে আরও ভালো এবং আরও বড় করতে লাগলেন। প্রথম দিককার ছোট ছোট যন্ত্রগুলোকে বলা হতো স্পাই-গ্লাস, বড় যন্ত্রগুলোকে প্রথম বলা হলো দূরবীক্ষণ বা টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপ কথাটা গ্রিক, এর মানে ‘দূর থেকে দেখা’। অনেক দূরের জিনিস চোখে পড়ে বলে যন্ত্রটির নাম টেলিস্কোপ।
প্রথম দিককার বড় দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলো ছিল অসুবিধাজনক। পোল্যান্ডের গ্দান্স্ক শহরে জান হেভেলিউস কর্তৃক নির্মিত বৃহৎ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটির ছবি আছে এই পাতায়। এটার টিউব পর্যন্ত নেই। দড়িতে করে ওঠাতে-নামাতে হতো, ব্যাপারটা অসুবিধাজনক।
বেশি দিন যেতে না যেতে প্রতিফলক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভব হলো। এর প্রধান অংশ হলো ঝকঝকে পালিশ করা কনকেভ আয়না, এর দেহটি দেখতে আকাশমুখী প্রকাণ্ড কামানের মতো।
১৯৪১ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানী দ. দ. মাকসুতভ সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এবং আরও নিখুঁত একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন। তাঁর যন্ত্রের প্রধান অংশ হলো একটি কনকেভ আয়না এবং একটি লেন্স, যার একপিঠ কনকেভ ও অন্যটা কনভেক্স। এ লেন্স কাটলে দেখা যায় চাঁদের কাস্তের মতো একটি মেনিসকাস [ইংরেজি সি (C) আকৃতির]। নতুন যন্ত্রটির নাম লাতিন থেকে বিজ্ঞানীরা রেখেছেন মেনিসকাস টেলিস্কোপ।
এটিতে প্রতিরূপ বেশ ভালো আসে; এর দেহ বা টিউব পুরোনো ধাঁচের দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলোর চেয়ে অনেক ছোট। ফলে ব্যবহার করা অনেক সহজ।
পর্যবেক্ষণ চলে মানমন্দিরে। সাধারণত এগুলোকে বড় শহর থেকে দূরে তৈরি করা হয় পাহাড় বা এমনকি পর্বতের ওপর—যেখানে মেঘ কম, হাওয়া আরও স্বচ্ছ এবং শান্ত। অনেক উঁচুতে নিম্নভূমির মতো হাওয়া অত স্পন্দিত হয় না।
১৯৪১ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানী দ. দ. মাকসুতভ সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এবং আরও নিখুঁত একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন। তাঁর যন্ত্রের প্রধান অংশ হলো একটি কনকেভ আয়না এবং একটি লেন্স, যার একপিঠ কনকেভ ও অন্যটা কনভেক্স
লেনিনগ্রাদের কাছে পুল্কোভো মানমন্দির দুনিয়ার একটা সেরা মানমন্দির। নানা আবিষ্কার এবং নিখুঁত পর্যবেক্ষণের জন্য এর প্রসিদ্ধি। বিদেশি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পুল্কোভোর নাম দিয়েছেন ‘দুনিয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় রাজধানী’। সুপরিচিত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিউকোম্ব একবার বলেন, পুল্কোভোতে একটা পর্যবেক্ষণ গ্রিনউইচে (লন্ডনের কাছে) চারটে পর্যবেক্ষণের সামিল।
মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধের সময়ে নাৎসি হামলাদাররা পুল্কোভো মানমন্দির ধ্বংস করে। পরে এটি আবার নির্মাণ করা হয়।