দীর্ঘ প্রতিক্ষা আর নানা জল্পনা শেষে অবশেষে প্রকাশিত হলো জেমসের ওয়েবের তোলা প্রথম ছবি। বাংলাদেশ সময় ১২ জুলাই ভোর ৪টায় ছবিটি প্রকাশ করা হয়। SMACS 0723 নামে পরিচিত একটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, অর্থাৎ গ্যালাক্সিপুঞ্জ আছে এই ছবিতে। একটি হোয়াইট হাউস ইভেন্টে ছবিটি উন্মোচন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এখন পর্যন্ত মানুষের তোলা সবচেয়ে দূরের মহাকাশের ছবি এটি। আরও ঠিক করে বললে, মহাকাশের একাংশের ছবি। যেখানে জায়গা করে নিয়েছে হাজারও গ্যালাক্সি। সেগুলোর বয়স আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। এজন্য জেমস ওয়েবের বিশাল আয়না এবং ইনফ্রারেড আলো ধরার ক্ষমতাকে স্মরণ করতে হয়।
যাইহোক প্রথমবারের মতো, আমরা এই প্রাচীন গ্যালাক্সিগুলোর এত পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। এই গ্যালাক্সিগুলোতেই তৈরি হয়েছিলো মহাবিশ্বের প্রথমদিককার নক্ষত্রগুলো। বৈশিষ্টের বিচারেও গ্যালাক্সিগুলো বর্তমানে তৈরি হওয়া গ্যালাক্সিগুলোর মতো নয়। এগুলোর বেশিরভাগই হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরা।
ছবির মূল লক্ষ্য SMACS 0723 ক্লাস্টার রয়েছে আমাদের থেকে ৪৬০ কোটি বছর অতীতে। অর্থাৎ এই ক্লাস্টার থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছাতে লাগছে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর।
ছবিটিতে মূলত, বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম কয়েকশো মিলিয়ন বছরে তৈরি হওয়া প্রাচীনতম বস্তুগুলো থেকে আসা আলো ধারণ করা হয়েছে। পুরো ছবিটিতে ছোট গ্যালাক্সিগুলোর একটি বিশাল ক্লাস্টারকে ফ্রেমবন্দি করেছে জেমস ওয়েব।
এখানে কোনো কোনো নক্ষত্রের আলো ১৩ হাজার কোটি বছরেরও বেশি পুরোনো। সহজ ভাষায় বললে, এই ছবিতে আমরা যা দেখছি, তার কিছু অংশ প্রায় ১৩ হাজার কোটি বছর আগের মহাকাশের একটা রূপ। তবে ছবির মূল লক্ষ্য SMACS 0723 ক্লাস্টার রয়েছে আমাদের থেকে ৪৬০ কোটি বছর অতীতে। অর্থাৎ এই ক্লাস্টার থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছাতে লাগছে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। এই মুহূর্তে সেখানে কিছু থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। কিন্তু সেটা কোনো দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। বর্তমানে সেখানে কিছু থাক বা না থাক, দূর অতীতের এই প্রতিচ্ছবিই আমাদের অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবে।
দূরের মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের জন্য আমাদের কাছে থাকা সেরা উপায়ের নাম হচ্ছে ইনফ্রারেড রশ্মি। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ইনফ্রারেড আলো। মহাবিশ্বের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিশদভাবে জানার জন্য এখন পর্যন্ত ইনফ্রারেড রশ্মি পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
ইতিপূর্বে হাবল টেলিস্কোপ দৃশ্যমান আলো ব্যবহার করে ছবি তুলত। জেমস ওয়েব ব্যবহার করছে ইনফ্রারেড। ফলে মহাবিশ্বের অজানা অনেককিছু আরও ভালোভাবে দেখার আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
সেজন্য জেমস ওয়েব ব্যবহার করে SMACS 0723 নামের গ্যালাক্সিপুঞ্জটি যেদিকে আছে, সেদিকের আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই গ্যালাক্সিপুঞ্জটি আছে খ-গোলকের দক্ষিণে ভোলানস (বাংলা নাম পতত্রীমীন) তারামন্ডলে। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে কেউ যদি এই গ্যালাক্সিপুঞ্জটি দেখতে চায়, তাহলে দক্ষিণাকাশে তাকাতে হবে।
এই গ্যালাক্সিপুঞ্জটি পর্যবেক্ষণের কারণ, হাবল টেলিস্কোপ দিয়েও এর আগে মহাকাশের এই অংশটি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু জেমস ওয়েবের তোলা ছবির মতো এত বিশদ ও স্পষ্টভাবে এটি দেখা যায়নি হাবলের পর্যবেক্ষণে। তাছাড়া SMACS 0723 এ ধরনের পর্যবেক্ষণের জন্য চমৎকার একটা লক্ষ্য৷ কারণ, ছবিটির সামনের অংশে রয়েছে বিশাল গ্যালাক্সি ক্লাস্টারটি। এটি একটি দৈত্যাকার মহাজাগতিক ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো কাজ করে। গ্যালাক্সির বিশাল ভরের কারণে, তাদের মাধ্যাকর্ষণ চারপাশে স্থান-কালের বক্রতা সৃষ্টি করে। ফলে ক্লাস্টারের পেছনে থাকা অন্যান্য বস্তুর আলোর বেঁকে যায়। এই ব্যাপারটাকে গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং বলে। এই গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ব্যবহার করে গ্যালাক্সিপুঞ্জটির অনেক পেছনের বিভিন্ন গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। এরজন্যই আমরা ছবিটিতে দেখতে পেয়েছি ১৩ হাজার কোটি বছরেরও বেশি পুরোনো নক্ষত্রের আলো।
এ ধরনের গ্রাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের সাহায্যে এর আগেও দূরবর্তী মহাকাশের ছবি দেখেছি আমরা। হাবল টেলিস্কোপও এ ধরনের গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং কাজে লাগিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করেছে। SMACS 0723-এর এই ছবিটি তুলতে মোট সাড়ে ১২ ঘন্টা এক্সপোজার সময় ব্যয় করতে হয়েছে। ছবিতে আমরা যে হাজার হাজার ছায়াপথ দেখতে পাচ্ছি, তার অনেকগুলোই প্রথমবারের মতো কোনো টেলিস্কোপে ধরা পড়েছে।
১৯৯৬ সালে জেমস ওয়েব নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তার পর থেকে নানা বিপত্তি পেরিয়ে দীর্ঘ দুই যুগ পর শেষ হয় এর নির্মাণ। ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহাকাশে পাঠানো হয় জেমস ওয়েব নভোদুরবনি। আর এখন এই টেলিস্কোপের তোলা ছবি দেখতে পাচ্ছে পৃথিবীবাসী।
কৌতুহল আর অনুসন্ধান মানুষের ডিএনএতে লেখা আছে। এ কারণেই আমরা পাহাড়ে উঠি, অতল সমুদ্রের তল খোঁজার চেষ্টা করি, আকাশে উড়ে বেড়াই, মহাকাশে ঝাঁপ দিই। মহাকাশের এই ছবিটি আমাদের সফল অগ্রযাত্রার আরেকটি স্বীকৃতি। মহাবিশ্বের রহস্য জানতে আমরা কতখানি এগিয়েছি, তার উজ্জ্বল উদাহরণ। মানুষ হিসেবে এটা আমাদের জন্য গৌরব আর অনুপ্রেরণার।
ইতোমধ্যেই জেমস ওয়েবের তোলা আরও বেশকিছু ছবি প্রকাশ করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা। এর প্রতিটিই আমাদের ভবিষ্যৎ মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ
সূত্র : নাসা, সায়েন্স অ্যালার্ট