আইনস্টাইন, আপেক্ষিকতা এবং নাটকীয় শেষ সপ্তাহ

আলবার্ট আইনস্টাইন কি একাই আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন? জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট, আপেক্ষিকতা এবং আইনস্টাইনের যুগান্তকারী আবিষ্কার... জেনে নিন...

সাধারণ আপেক্ষিকতা আবিষ্কার করেন কে? মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন। সবাই জানি। কিন্তু তাঁর এই আবিষ্কারের শেষ দিকের কয়েক বছরের ঘটনা সম্পর্কে আমরা কতজন জানি? ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর ছিল রীতিমতো উত্তেজনাপূর্ণ। একসময় মনে হচ্ছিল, আইনস্টাইনের তত্ত্ব আবিষ্কারের কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে যেতে পারেন অন্য একজন। জোরালো সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, সাধারণ আপেক্ষিকতা আবিষ্কারের কৃতিত্ব পেয়ে যেতে পারেন অন্য একজন গণিতবিদ।

কিন্তু তা হয়নি। প্রখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট স্বীকার করেন, সমীকরণ চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে তিনি হয়তো প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতা বা জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির ক্রেডিট পাবেন আইনস্টাইনই।

অবশ্য হিলবার্টও তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হননি। শুধু প্রায়োগিক কৌশলগত দিক দিয়ে নয়, উপযুক্তভাবে সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণটি প্রকাশের ক্ষেত্রে দুজনের নামই উল্লেখিত হয়েছে।

এর আগে ১৯১২ সালেই আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের মূল তাত্ত্বিক দিকটি আবিষ্কার করেন। কিন্তু একটা জায়গায় এসে আটকে যান। তাঁর তত্ত্বটি গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন। এ জন্য গণিতের কয়েকজন অধ্যাপকের শরণাপন্ন হন তিনি। তাঁদের সঙ্গে চিঠি লিখে মতবিনিময় করেন। কথা বলেন। তিন বছর ধরে আইনস্টাইন গাণিতিক সমীকরণের পেছনে লেগে থাকেন। হাল ছাড়েন না।

এ সময় আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হয় প্রখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের। এর পরের ঘটনা তো শুনলেনই। শেষ অধ্যায়ের এই তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনাবলিতে যাওয়ার আগে আসুন আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের চিন্তাটা তাঁর মাথায় ঢুকল কীভাবে?

এখানেই আইনস্টাইনের কৃতিত্ব। সবাই ধরে নিয়েছিলেন, মহাকর্ষ বলের বিষয়ে নিউটনই শেষ কথা বলে গেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন সেখানে আরও কিছু বিষয় রয়ে গেছে। তিনি শুরু করেন নিউটনের মহাকর্ষ বল থেকে। তাঁর চিন্তাভাবনা ও গবেষণার শুরু ১৯০৭ সালে। এর আড়াই শ বছর আগে নিউটন যেখানে শেষ করেন, আইনস্টাইনের শুরু  সেখান থেকে।

নিউটনের সূত্র অনুযায়ী আপনি যদি কোনোভাবে সূর্যকে নড়িয়ে দিতে পারেন, তাহলে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পৃথিবীও নড়ে উঠবে। কারণ, এরা একে অপরের সঙ্গে মহাকর্ষ বলের বন্ধনে আবদ্ধ।

নিউটন থেকে আইনস্টাইন

নিউটন এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এর মূল কারণ মহাকর্ষ বল। এই আকর্ষণ বলের জন্যই পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারপাশে, চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীর চারপাশে, অন্য গ্রহ-নক্ষত্রও চলছে নিজ নিজ কক্ষপথে।

কিন্তু মহাকর্ষ বলের এমন কী জাদু আছে, যা দিয়ে সে মহাজাগতিক বস্তুগুলোকে এভাবে ঘোরাচ্ছে? আসুন প্রথমে সেটা বোঝার চেষ্টা করি।

বলা হয়, গাছ থেকে মাটিতে আপেল পড়তে দেখে বিজ্ঞানী নিউটনের মনে প্রশ্ন দেখা দেয় এবং তিনি মাধ্যাকর্ষণ বলের (মহাকর্ষ বল) সূত্র আবিষ্কার করেন। আসলে ব্যাপারটি সে রকম নয়। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ বছর আগে ১৬৬৫-১৬৬৬ সালে ইউরোপে মারাত্মক প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে আইজ্যাক নিউটন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ছেড়ে নিজের বাড়ি লিংকনশায়ারে চলে আসেন। সেখানে অলস মুহূর্ত কাটানোর সময় তিনি উপলব্ধি করেন যে মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। এটাই মহাকর্ষ (পৃথিবীর ক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণ) বল, যা নির্ভর করে বস্তুগুলোর ভর কত এবং একে অপরের থেকে কত দূরে তার ওপর।

নিউটনের সূত্র অনুযায়ী আপনি যদি কোনোভাবে সূর্যকে নড়িয়ে দিতে পারেন, তাহলে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পৃথিবীও নড়ে উঠবে। কারণ, এরা একে অপরের সঙ্গে মহাকর্ষ বলের বন্ধনে আবদ্ধ। নিউটনের সূত্র অনুযায়ী মহাকর্ষ বল মহাশূন্যে অবস্থিত বস্তুগুলোর ওপর তাত্ক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে। আইনস্টাইন এ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। পরে তিনি সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখান কীভাবে এই মহাকর্ষ বল পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এর আগেই ১৯০৫ সালে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে তিনি দেখান, কোনো কিছুর গতিই আলোর গতির চেয়ে বেশি হতে পারে না।

আইজ্যাক নিউটন

নিউটনের মহাকর্ষ বলের আবিষ্কার ছিল যুগান্তকারী। এর আগে সবাই দেখেছে মহাবিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্র ও অন্যান্য বস্তু একে অপরের চারদিকে ঘুরছে। একে অপরকে আকর্ষণের কারণেই যে ঘুরছে, সেটা সবাই বুঝত। কিন্তু কীভাবে এই আকর্ষণশক্তি কাজ করে, সেটা জানত না। নিউটনই প্রথম এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেন এবং গাণিতিক সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান, m1 ও m2 ভরের দুটি বস্তু d দূরত্বে থাকলে তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল F = G (m1 × m2)/ d2, যেখানে  G = মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (ইউনিভার্সাল গ্র্যাভিটেশনাল কনস্ট্যান্ট)। অর্থাৎ, মহাকর্ষ বল দুটি বস্তুর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।

আইনস্টাইন দেখলেন, নিউটনের তত্ত্ব সৌরজগতের ক্ষেত্রে মোটামুটি সঠিক। কিন্তু দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। প্রথমত, সূর্যের তো কোনো হাত-পা নেই যে পৃথিবীকে টেনে কাছে ধরে রাখবে। তার কাছে শক্ত কোনো শেকলও নেই যে সে পৃথিবীকে বেঁধে রাখবে। তাহলে নয় কোটি ত্রিশ লাখ মাইল দূর থেকে সূর্য কীভাবে পৃথিবীকে টানছে, কীভাবে মহাকর্ষ বল কাজ করছে? আরেকটি প্রশ্ন হলো, এই আকর্ষণ বল তাত্ক্ষণিকভাবে ক্রিয়াশীল হয় বটে, কিন্তু সেটা কি আলোর গতির চেয়েও দ্রুততর গতিতে কাজ করে?

আইনস্টাইন এই সিদ্ধান্তে আসেন যে মহাকর্ষ বল নিশ্চয়ই মহাশূন্যের দ্বারাই প্রযুক্ত হয়। কিন্তু কীভাবে, সেটাই প্রশ্ন। ১৯১৫ সালে তিনি এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক সূত্র উপস্থাপন করেন।

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা

গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি প্রশ্নের উত্তর বের করেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। তিনি নিউটনের আবিষ্কারের প্রায় আড়াই শ বছর পর তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখান, মহাজগতে বস্তুগুলো পারিপার্শ্বিক মহাশূন্যকে (স্পেস) এমনভাবে প্রভাবিত করে, যার মাধ্যমে মহাকর্ষ বল ক্রিয়াশীল হয়। এর আগে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা বা স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে প্রমাণ করেন যে, কোনো বস্তু বা সংকেত আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারে না। এর গাণিতিক প্রমাণও তিনি দেন।

তাহলে নিউটনের সূত্রের সঙ্গে আইনস্টাইনের এই তত্ত্বের একটু গড়মিল দেখা গেল। নিউটন অবশ্য ব্যাখ্যা করতে পারেননি কীভাবে মহাকর্ষ বল এত দূর থেকে একে অপরকে আকর্ষণ করে। এবং এই ব্যর্থতার বিষয়টি তিনি তাঁর একটি লেখার ফুটনোটে উল্লেখও করে গেছেন। প্রায় দুই শ বছর পর্যন্ত ফুটনোটের কথা সবার অজানাই ছিল। আইনস্টাইনই প্রথম বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

আইনস্টাইন এই সিদ্ধান্তে আসেন যে মহাকর্ষ বল নিশ্চয়ই মহাশূন্যের দ্বারাই প্রযুক্ত হয়। কিন্তু কীভাবে, সেটাই প্রশ্ন। ১৯১৫ সালে তিনি এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক সূত্র উপস্থাপন করেন। তাঁর চমত্কার ব্যাখ্যাটি হলো এ রকম: মহাশূন্যে সূর্য ও পৃথিবীর মতো বস্তুগুলোর প্রভাবে তাদের চারপাশের মহাশূন্য (স্পেস) বক্রাকার (কার্ভ) ধারণ করে। মহাশূন্যের এই বাঁকানো আকৃতির কারণে তার পাশ দিয়ে অতিক্রমের সময় অন্য বস্তুর গতিপথ প্রভাবিত হয়। এভাবে মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে মহাকর্ষ বল কাজ করে।

আইনস্টাইনের এই আবিষ্কার নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ বলের সূত্রকে পূর্ণতা দান করে। আইনস্টাইন তখন বার্লিনে একজন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন। তাঁকে প্রুশান একাডেমি অব সায়েন্সেসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এ সময় স্ত্রী মিলেভাম্যারিকের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুই সন্তান নিয়ে স্ত্রী চলে যান জুরিখে। এই দুঃসময় অবশ্য তাঁকে একটি বিরল সুযোগও এনে দেয়। তিনি দিন-রাত কাজ করে ১৯১৫ সালের ২৫ নভেম্বর বার্লিনে প্রুশান একাডেমি অব সায়েন্সে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের গাণিতিক সূত্র পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেন। এই সূত্রের মাধ্যমে মহাকর্ষ বল সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানা ও বোঝা সম্ভব হয়। গত বছরের নভেম্বরে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের শতবর্ষ পূর্ণ হয়।

মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে মহাকর্ষ বল কীভাবে কার্যকর হয়, তার একটি ব্যাখ্যা আমরা এভাবে দিতে পারি। ধরা যাক, একটি সমতল পিঠের কাঠের খণ্ডের ওপর দিয়ে একটা মার্বেল গড়িয়ে দিলাম। তাহলে মার্বেলটি সোজা পথে গড়িয়ে যাবে। এদিক-ওদিক বাঁকাবে না। কিন্তু যদি পানিতে ভিজে সেই কাঠের খণ্ডটির উপরিতল আঁকাবাঁকা হয়ে যায়, তাহলে মার্বেলটি আর সোজা গড়িয়ে যাবে না, আঁকাবাঁকা পথে চলবে। ঠিক সে রকম, মহাশূন্যে কোনো বস্তুর প্রভাবে চারপাশের স্পেস যখন বক্রাকার ধারণ করে, তখন সেই স্পেস দিয়ে অতিক্রমের সময় অন্য বস্তুও বক্রাকার পথেই চলে। এ জন্যই সূর্যের চারদিকে পৃথিবী উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে। এভাবেই মহাকর্ষ বল এত দূর থেকেও পৃথিবীর গতিপথকে প্রভাবিত করছে।

আইনস্টাইন উপলব্ধি করলেন যে, একই কারণে সময়ও প্রভাবিত হতে পারে। সাধারণত আমরা ধরে নিই, একটি ঘড়ি যেখানেই থাকুক, তার কাঁটা সমান হারেই ঘুরবে।

আইনস্টাইনের যুগান্তকারী আবিষ্কার

মহাকর্ষ বলের এই ব্যাখ্যা আবিষ্কার করতে আইনস্টাইন প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করেন। ১৯১২ সাল থেকেই তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। তিনি এর সমস্যাটির সমাধান কেমন হতে পারে বুঝতে পারেন। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে চারপাশের শূন্যস্থান বক্রাকার ধারণ করার বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে। এবং এ কারণেই যে মহাশূন্যে বস্তুগুলো একে অপরকে আকর্ষণসূত্রে আবদ্ধ করে, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হন।

এটা ছিল মহাকর্ষ-সম্পর্কিত চিন্তার জগতে এক বিরাট উল্লম্ফন। আইনস্টাইনের ব্যতিক্রমী চিন্তা এখানেই যে, তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করলেন যেহেতু সূর্য ও পৃথবীর মধ্যে শূন্যস্থান ছাড়া আর কিছু নেই, তাহলে আকর্ষণ বল নিশ্চয়ই এই শূন্য (স্পেস) দ্বারাই কার্যকর হচ্ছে। তার মানে, মহাশূন্যে প্রতিটি বস্তু চারপাশের স্পেসকে প্রভাবিত করছে এমনভাবে যে, তা একে অপরকে আকর্ষণ করে।

উপরন্তু তিনি আরও বড় কিছু করলেন। আইনস্টাইন উপলব্ধি করলেন যে, একই কারণে সময়ও প্রভাবিত হতে পারে। সাধারণত আমরা ধরে নিই, একটি ঘড়ি যেখানেই থাকুক, তার কাঁটা সমান হারেই ঘুরবে। কিন্তু আইনস্টাইন প্রস্তাব করলেন, ঘড়ি কোনো বেশি ভরের বস্তুর যত কাছাকাছি থাকবে, তার কাঁটা তত ধীরগতিতে চলবে বা সময় ধীরগতিতে চলবে (একে বলে কাল দীর্ঘায়ন বা টাইম ডায়ালেশন)। আইনস্টাইনের সিদ্ধান্ত হলো, বিভিন্ন বস্তু সেই সব অবস্থানের দিকেই যায়, যেখানে সময় আরও ধীরগতিতে চলে।

আলবার্ট আইনস্টাইন

স্থানকাল (স্পেস-টাইম) সম্পর্কিত মৌলিক আবিষ্কারের পরও আইনস্টাইনের আবিষ্কার করলেও একটি সমস্যা থেকে গেল। তাঁর মৌলিক কাঠামোগত আবিষ্কারটি যে যুগান্তকারী, সেটা দাবি করার জন্য একে গাণিতিক কাঠামোতে প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ, একটি সমীকরণের সাহায্যে স্থান,  কাল বা সময় ও বস্তুর (ম্যাটার) সমন্বিত অবস্থান প্রকাশ করে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সুনিশ্চিত প্রমাণ উপস্থিত করার প্রয়োজন দেখা দিল। জুরিখে তাঁর এক গণিতবিদ সহকর্মী মার্সেল গ্রসম্যানের সাথে কাজ করেছিলেন আইনস্টাইন। সে সময় তিনি তাঁর সমস্যার সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে যান। বছর খানেকের মধ্যে তিনি মহাকর্ষকে জ্যামিতিক কাঠামোয় এনে স্থান-কাল বা স্পেস-টাইমের পুনঃসূত্রায়ণ করেন।

কিন্তু এরপর তাঁর আবিষ্কৃত নতুন সমীকরণগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন। পরীক্ষা করে দেখার সময় একটি টেকনিক্যাল ত্রুটির জন্য তাঁর মনে হলো সব ভুল। তিনি ভাবলেন, গতির সাধারণ সূত্র সঠিকভাবে বর্ণনা করতে তিনি ব্যর্থ। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। বারবার তাঁর সূত্র পরীক্ষার কাজ অব্যাহত রাখলেন।

বছর দুয়েকের মধ্যে তিনি আশার আলো দেখেন। সমীকরণ পরীক্ষার সময় যে টেকনিক্যাল ত্রুটি হয়েছিল, সেটা তিনি সংশোধন করেন এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা আবিষ্কারের সমাপনী অধ্যায়ে পৌঁছান।

হিলবার্ট তাঁর গাণিতিক সূত্র লিখে পাঠান। আইনস্টাইন তাঁর বিরক্তি ঢেকে রেখে উত্তর দেন, ‘তোমার সমাধান, যা দেখছি, ঠিক আমার সঙ্গে মিলে গেছে, যেটা কয়েক সপ্তাহ আগে আমি বের করেছি এবং একাডেমিতে জমা দিয়েছি।’

নাটকীয় শেষ সপ্তাহ

কিন্তু শেষ মুহূর্তের গাণিতিক সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের সময় ঘটনাবলি হঠাৎ যেন এক বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে যায়। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার কয়েক মাস আগে প্রখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের সঙ্গে আইনস্টাইনের পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে আইনস্টাইন তাঁর নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব সম্পর্কিত সব চিন্তাভাবনা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন। কিন্তু পরে আইনস্টাইন জানতে পারেন যে তাঁর আলোচনায় হিলবার্ট দারুণ উদ্যোগে নিজেই আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। আইনস্টাইন হতাশ হন। এরপর সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে দুজনের মধ্যে যেসব চিঠি ও পোস্টকার্ড চালাচালি হয়, তাতে বোঝা যায় তাদের মধ্যে আন্তরিকতা সত্ত্বেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। হিলবার্ট ভাবছিলেন, একটি অসম্পূর্ণ মহাকর্ষ তত্ত্বকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে তিনি একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা করছেন। আর আইনস্টাইন একে তাঁর একক সাফল্যের চূড়ান্ত পর্বে হিলবার্টের একটি খারাপ ধরনের কাজ বলে ধরে নিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের এই দুর্ভাবনা একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। ১৯১৫ সালের ১৩ নভেম্বর হিলবার্ট একটি চিঠিতে আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, তিনি আইনস্টাইনের ‘বিরাট সমস্যার সমাধান’ বের করেছেন। এ সম্পর্কে জানার জন্য হিলবার্ট আইনস্টাইনকে গোটিনজেনে আমন্ত্রণ জানান। আইনস্টাইন এতে আপত্তি তোলেন এবং গোটিনজেনে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

এর কয়েক দিন পরই হিলবার্ট তাঁর গাণিতিক সূত্র লিখে পাঠান। আইনস্টাইন তাঁর বিরক্তি ঢেকে রেখে উত্তর দেন, ‘তোমার সমাধান, যা দেখছি, ঠিক আমার সঙ্গে মিলে গেছে, যেটা কয়েক সপ্তাহ আগে আমি বের করেছি এবং একাডেমিতে জমা দিয়েছি।’

ডেভিড হিলবার্ট

এক সপ্তাহ পর ২৫ নভেম্বর প্রুশান একাডেমিতে হল ভরা শ্রোতাদের সামনে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের চূড়ান্ত সমীকরণ উপস্থাপন করেন।

কেউ জানে না শেষ এক সপ্তাহে কী ঘটেছে। আইনস্টাইন কি নিজেই তাঁর সমীকরণ চূড়ান্ত করেছিলেন? হিলবার্টের সমীকরণ কি ঠিক ছিল? নাকি তিনি আইনস্টাইনের কিছু তথ্য সংযোজন করেছিলেন? মজার ব্যাপার হলো, হিলবার্টের লেখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাতা পরে উধাও হয়ে যায়।

যা-ই হোক, পরে হিলবার্ট বলেন, সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্রেডিট আইনস্টাইনেরই। এবং কার্যত সেটাই হয়েছে। আইনস্টাইনই এই তত্ত্বের জনক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

তবে হিলবার্টও তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেয়েছেন। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণ প্রকাশের প্রায়োগিক কৌশলগত দিক দিয়ে উপযুক্তভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে দুজনের নামই উল্লেখিত হয়েছে। হিলবার্টের অবদান অস্বীকার করা হয়নি।

নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের যথোপযুক্ত প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা বুধগ্রহের কক্ষপথের একটা ব্যাপার কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। এই অসামঞ্জস্যটা আইনস্টাইন তাঁর প্রণীত সাধারণ আপেক্ষিকতার আলোকে সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারলেন।

চূড়ান্ত প্রমাণ

আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী দূরের কোনো তারার আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে হলে সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় আলোর পথ বেঁকে যাবে। এটা ঠিক কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দিনের বেলা তো আকাশের তারা দেখা যায় না। তাহলে কীভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাবে যে তারার আলো বাঁকা পথ ঘুরে আসে কি না?

বিজ্ঞানীরা ভেবে দেখলেন এটা পরীক্ষা করা সম্ভব সূর্য গ্রহণের সময়। তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায় এবং সে সময় তারার আলোর গতিপথ পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সূর্যগ্রহণের তারিখ ছিল ২৯ মে ১৯১৯। বিজ্ঞানীরা সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। নির্দিষ্ট দিনে সূর্যগ্রহণের সময় বিজ্ঞানীরা ব্রাজিল, আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল প্রভৃতি স্থান থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ছবি তোলেন। এরপর প্রায় চার মাস সেই সব ছবি পরীক্ষা করে দেখা হয়। তাঁরা দেখেন সূর্যের পাশ দিয়ে দূরের তারার আলো বাঁকা পথে ঘুরে আসছে। প্রমাণিত হলো, আইনস্টাইনের তত্ত্ব সঠিক। ১৯১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আইনস্টাইন একটি টেলিগ্রাম পেলেন। সেখানে লেখা ছিল, সূর্যগ্রহণের সময় পরিচালিত পরীক্ষায় আইনস্টাইনের তত্ত্বের সত্যতা পাওয়া গেছে। এভাবে আইনস্টাইনের যুগান্তকারী আবিষ্কার সাধারণ আপেক্ষিকতা বাস্তবে প্রমাণিত হয়।

নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের যথোপযুক্ত প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা বুধগ্রহের কক্ষপথের একটা ব্যাপার কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। এই অসামঞ্জস্যটা আইনস্টাইন তাঁর প্রণীত সাধারণ আপেক্ষিকতার আলোকে সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারলেন। ফলে তাঁর জ্যামিতি-ভিত্তিক সাধারণ আপেক্ষিকতা যে মাধ্যাকর্ষণের নিউটনীয় বিবরণের তুলনায় শ্রেয়, এ নিয়ে আইনস্টাইনের মনে কোনো দ্বিধা রইল না।              

২০১৬ সালের নভেম্বর মাস ছিল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বা জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের ১০১তম বছর।

সূত্র: ব্রায়ান গ্রিন, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, মে ২০১৫

*লেখাটি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত