মহাবিশ্বের সব আলো নিভে গেলে পরে

উৎসর্গ:

জামাল নজরুল ইসলাম শ্রদ্ধাস্পদেষু

কল্পান্তে যখন তার সকল প্রদীপ নিবিয়ে

সৃষ্টির রঙ্গমঞ্চ দেবে অন্ধকার করে

[রবীন্দ্রনাথ]

শেষ সপ্তক নামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কাব্যগ্রন্থ আছে। ওপরের পঙ্‌ক্তি দুটো সেই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার অন্তর্গত। ওই কবিতায় তিনি আমাদের মহাবিশ্বের এমন এক ছবি এঁকেছেন, দেখলে মনে হবে, কোনো বিজ্ঞানী যেন মহাবিশ্বের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ মেলে ধরেছেন আমাদের চোখের সামনে। মহাবিশ্বের বিপুল দেশকালে অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে বিশ্বরা উদ্ভূত হচ্ছে, ঝাঁকে ঝাঁকে তারারা আলো জ্বালাচ্ছে, পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে পতঙ্গের মতো—

                                                    সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে

                                       জ্যোতিষ্ক-পতঙ্গ দিয়েছে দেখা,

                                                    গণনায় শেষ করা যায় না।

                                       তারা কোন্ প্রথম প্রত্যুষের আলোকে

                                       কোন্ গুহা থেকে উড়ে বেরোল অসংখ্য,

                                       পাখা মেলে ঘুরে বেড়াতে লাগল চক্রপথে

                                                      আকাশ থেকে আকাশে।

হাজারো কোটি বছর মহাবিশ্বকে আলোকিত করে, বিপুল সৃষ্টি-উৎসবে আকাশে আকাশে আতশবাজির মশাল হয়ে জ্বলে জ্যোতিষ্কপতঙ্গরা অবশেষে মরে যাচ্ছে। ওদের পাখা যাচ্ছে খসে, আলো যাচ্ছে নিভে, সৃষ্টির এই বিশাল রঙ্গমঞ্চ হয়ে যাচ্ছে অন্ধকারময়—

                                         একদিন আসবে কল্পসন্ধ্যা,

                                               আলো আসবে ম্লান হয়ে,

                                                        ওড়ার বেগ হবে ক্লান্ত

                                                              পাখা যাবে খসে,

                                                               লুপ্ত হবে ওরা

                                                    চিরদিনের অদৃশ্য আলোকে।

সত্যি কি একদিন নিভে যাবে আকাশের তারারা? নিভে যাবে মহাবিশ্বের সব আলো? পাখিডাকা শিশিরস্নিগ্ধ ভোর, রোদেলা সকাল, আলুলায়িত ক্লান্ত বিকেল, রক্তিম গোধূলি, জোছনাভরা রাত, ধবল চাঁদ, তারাভরা আকাশ—এই সবকিছু কি একদিন নিমজ্জিত হয়ে যাবে আন্ধকারের অতলে? সূর্য উঠবে না, ফুল ফুটবে না, পাখি ডাকবে না, রঙিন ডানার প্রজাপতি উড়ে বেড়াবে না ফুলে ফুলে? কোনো কবিতা থাকবে না সেদিন? আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকানোর কেউ থাকবে না? নাকি আকাশও থাকবে না?

আমাদের প্রিয় এই পৃথিবী একসময় ছিল না। চাঁদ-সূর্য-গ্রহ-তারা কিছুই ছিল না। এমনকি ছিল না আকাশও। সময়ও না। বিজ্ঞানীরা বলেন, দেশহীন-কালহীন সে কালে ছিল শুধু প্রায় অসীম ঘন ও অসীম উত্তপ্ত অন্তহীন সম্ভাবনার এক মহাবিশ্ববীজ। সেই মহাবিশ্ববীজ একদিন ফেটে পড়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে। বিপুল বস্তুরাশি অসংখ্য তারা আর বিশ্বের বীজ বুকে নিয়ে চারদিকে ছুটতে শুরু করে প্রচণ্ড বেগে। শুরু হয় কালের যাত্রা। পর মুহূর্তেই দেশের ঘটে এক অভাবনীয় স্ফীতি। বিজ্ঞানীরা তাকে অভিহিত করেছেন মহাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন বলে। এতে এক সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে মহাবিশ্বের আয়তন বেড়ে যায় কোটি কোটি গুণ। মহাবিশ্ববিদ স্টিফেন হকিং একটি উপমা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন সেই মহাস্ফীতিকে। তিনি বলেছেন, সে যেন এক সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি ছোট্ট সিকি বা আধুলির পক্ষে হঠাৎ করেই ছায়পথের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বড় হয়ে যাওয়া। ছায়াপথ হচ্ছে আমাদের নিজেদের বিশ্ব—গ্যালাক্সি। গ্রামের চাঁদহীন, মেঘহীন অন্ধকার কালো রাতে একে আকাশের উত্তরদিক থেকে দক্ষিণদিক পর্যন্ত টাঙানো একটি উজ্জ্বল আলোর চাঁদোয়ার মতো দেখা যায়। এটি প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি তারার এক বিশাল সমাবেশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে বলেছেন নাক্ষত্রচক্রবর্তী। এর এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত যেতে আলোর সময় লাগে প্রায় একলাখ বছর, যে-আলো এক সেকেন্ডেই দৌড়োতে পারে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার পথ।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব ঘোষণা করেছিলেন ১৯১৫ সালে। সেই তত্ত্বের সমীকরণ ব্যবহার হরে আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান নামে এক রুশ বিজ্ঞানী ১৯২২ সালে মহাবিশ্বের একটি সম্ভাব্য নকশা উপস্থাপন করেছিলেন। সেই নকশায় মহাবিশ্ব শুরু হয় প্রায় শূন্য-আয়তনের একটি বিন্দু থেকে। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রসারিত হতে থাকে। ১৯২৪ সালে এডুইন হাবল নামের এক মার্কিন বিজ্ঞানী সে সময়ের সবচেয়ে বড় দুরবিনের পর্দায় দেখতে পান, প্রতিটি গ্যালাক্সি আমাদের কাছ থেকে অত্যন্ত দ্রুত বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি যে গ্যালাক্সি রয়েছে যত বেশি দূরে, তার দূরে সরে যাওয়ার গতিবেগ যেন ততো বেশি। তার মানে, মহাবিশ্ব আয়তনে বড় হচ্ছে। ১৯২৯ সালে হাবল ঘোষণা করেন তাঁর আবিষ্কার।

ইতিমধ্যে ১৯২৭ সালে, জর্জেস লেমিত্রি নামে এক বেলজীয় বিজ্ঞানীও প্রস্তাব করেন, মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল অতি উত্তপ্ত এক আদিম পরমাণু থেকে। ১৯৪৮ সালে জর্জ গ্যামো নামে আরেক রুশ বিজ্ঞানী বলেন, অতি উত্তপ্ত অবস্থার কোনো আদিম পরমাণু ফেটেই যদি মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়ে থাকে, তবে তার উষাকালে বিকীর্ণ তেজের তরঙ্গধারার কিছু অবশেষ এখনও থেকে যাবে। ১৯৬৫ সালে আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন নামের দুজন মার্কিন বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের সৃষ্টি-উৎসবের সেই আদি নির্ঝরের একটি ক্ষীণ রেশ আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা দেখতে পান, মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ নামের এক আদি জ্যোতিতে সবটুকু মহাবিশ্ব ভরপুর হয়ে আছে। অর্থাৎ আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যানের নকশায় যেমন প্রস্তাব করা হয়েছে—মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল এক অনন্য বিন্দু থেকে। মহাবিশ্বের সেই সূচনাবিন্দুটিকে আজকের বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন মহাবিস্ফোরণ। ইংরেজিতে বলা হয় বিগ ব্যাং।

ওপরে আমরা যে-মহাবিশ্ববীজের কথা বলেছি, সেটি আসলে সত্যি সত্যি ফল বা শস্যের বীজের মতো কিছু নয়। প্রায় শূন্য-আয়তনের সেই গাণিতিক বিন্দু, যেখানে সংঘটিত হয়েছিল মহাবিস্ফোরণ। আজকের মহাবিশ্বের সব বস্তু সে সময় সেই শূন্য-আয়তনিক সেই বিন্দুর মধ্যেই ঠাসা ছিল। কোনো কোনো বিজ্ঞানী তাকে বলেন মহাবিশ্বডিম্ব। মহাবিশ্ববীজ, মহাবৈশ্বিক ডিম বা আদিম পরমাণু—যে নামেই তাকে ডাকি না কেন, যে মুহূর্তে সেটি ফেটে পড়েছিল, সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিই হলো মহাবিস্ফোরণ। সেটি ছিল আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মহাবিশ্বের প্রথম উষাকাল। সেখান থেকেই সূচিত হয় দেশ ও কালের যাত্রা।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিস্ফোরণের সূচনালগ্নে মহাবিশ্ব উত্তপ্ত ছিল প্রায় অসীমভাবে। তাঁরা হিসেব করে বলছেন, মহাবিস্ফোরণের এক সেকেন্ডের মধ্যে তার এমন বিপুল বিস্তার ঘটেছিল যে প্রায় অসীম উত্তপ্ত অবস্থা থেকে তাপমাত্রা নেমে এসেছিল মোটামুটি এক হাজার কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই উত্তাপ সূর্যের বুকের বর্তমান উত্তাপের প্রায় এক হাজার গুণ। তখন মহাবিশ্বে ছিল শুধুই ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদির মতো অতিপরমাণুরা। মহাবিশ্বের জন্মের প্রায় তিন মিনিট পর যখন তার তাপমাত্রা নেমে এসেছিল মোটামুটি একশ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে, প্রোটন ও নিউট্রন জোড় বেঁধে গঠন করেছিল প্রথম পরমাণুকোষ (বিজ্ঞানীদের শব্দ, পরমাণুকেন্দ্র)। ওগুলো ছিল দুটো হালকা মৌল, হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস। বিজ্ঞানীদের হিসেব মতে, মহাবিশ্বের প্রায় চারভাগের তিনভাগ হাইড্রোজেন ও একভাগ হিলিয়াম পরমাণুর কেন্দ্র সে সময়েই গঠিত হয়েছিল। তাঁদের গণনা মতে, মহাবিশ্বে তখন প্রতি আটাশিটি প্রোটনের বিপরীতে নিউট্রনের সংখ্যা ছিল বারোটি। একটি হিলিয়াম কেন্দ্রীণের গঠনে দরকার হয় দুটো প্রোটন ও দুটো নিউট্রন। এ ক্ষেত্রে বারোটি নিউট্রন বারোটি প্রোটনের সঙ্গে জোড় বেঁধে ছয়টি হিলিয়াম কেন্দ্রীণ গঠন করে। অবশিষ্ট ছিয়াত্তরটি প্রোটন পড়ে থাকে একাকি। এদের প্রত্যেকটিকে হাইড্রোজেন কেন্দ্রীণ বলা যায়। কারণ এর নিউক্লিয়াসে কোনো নিউট্রন থাকে না, থাকে কেবল একটি প্রোটন। এর কয়েক হাজার বছর পর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এত নিচে নেমে এল যে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম কেন্দ্রীণের চারপাশে এক বা একাধিক নৃত্যপথ রচনা করে নাচতে শুরু করল ইলেকট্রনরা। গঠিত হলো মহাবিশ্বের প্রথম পরমাণুরা। তারপর প্রায় দশ লাখ বছর পর্যন্ত মহাবিশ্বে আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। তখন মহাবিশ্ব কেবল প্রসারণশীল এক তেজোময় অগ্নিগোলক মাত্র।

যত সময় গড়িয়েছে, মহাবিশ্ব তত প্রসারিত হয়েছে। যত প্রসারিত হয়েছে, তত কমে এসেছে তার তাপমাত্রা আর ঘনত্ব। আদিম মহাবিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলের ঘনত্ব হয়তো ছিল অন্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা বেশি। সেই বাড়তি ঘনত্বের কারণে সেখানকার বস্তুপুঞ্জের মহাকর্ষের টান হয়তো ওই প্রসারণকে তুলনামূলকভাবে একটু কমিয়ে দিয়েছিল। ফলে হাইড্রোজেনের মেঘেরা চুপসে গিয়ে গঠন করেছিল প্রথম প্রজন্মের তারাদের। তাদের বুকে জ্বলে উঠেছিল মহাবিশ্বের প্রথম আলো। আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তারাবিশ্বগুলো। কোনো কোনো তারার চারপাশে বস্তুপুঞ্জ ঘনীভূত হয়ে হয়তো গঠন করেছিল গ্রহদের।

তারাগুলো মহাবিশ্বের সন্তান। ওরা মূলত এক একটি পারমাণবিক চুল্লি। ওদের বুকের গভীরে সাধারণত হাইড্রোজেন পরমাণু পুড়ে হিলিয়াম গঠিত হয়। সমস্ত হাইড্রোজেন পুড়ে শেষ হয়ে গেলে হিলিয়াম জ্বলতে শুরু করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, সোডিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি থেকে শুরু করে লোহা পর্যন্ত গঠিত হয় ওদের পরমাণুচুলায়। কিন্তু লোহার পরমাণু জ্বালানি হিসেবে আর কাজে আসে না। এ অবস্থায় ভেঙে পড়ে তারাটির কেন্দ্রবস্তু ও তার বাইরের স্তরের মধ্যকার ভারসাম্য। তখন সেটি একটি অতিনবতারা রূপে ফেটে পড়ে বিপুল বিস্ফোরণে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন সুপারনোভা। এতে ছত্রখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার দেহের কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদির মতো ভারী পরমাণুগুলো। কোটি কোটি বছর ধরে সেগুলো বয়ে চলে মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে। হয়তো একদিন বহু দূরের কোনো হাইড্রোজেনের কুয়াশাকে গিয়ে আন্দোলিত করে। তাতে যেন সোনার কাঠির ছোঁয়া লাগে। জেগে ওঠে সুপ্ত হাইড্রোজেনমেঘ, রাজকুমারের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় যেমন জেগে ওঠে পাতালপুরীর ঘুমন্ত রাজকন্যা। হাইড্রোজেনের কুয়াশা ঘনীভূত হয়ে এতে শুরু হতে পারে অন্য একটি নক্ষত্রশিশুর জন্মপ্রক্রিয়া। এভাবে মহাবিশ্বে আসে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের তারারা। এ রকম একটি তারা আমাদের সূর্য। এর চারপাশের কক্ষপথগুলোর কয়েকটিতে এসে জমেছে অতিনবতারার দেহপোড়া ছাই—আমাদের শরীর গঠনকারী কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ক্যালসিয়াম, লোহা প্রভৃতির পরমাণুসমূহ। এ রকম একটি গ্রহে—পৃথিবীতে—একদিন ঘটল প্রাণের বিস্ফোরণ। কালক্রমে আমরা এসে উপনীত হলাম এখানে।

আগেই বলা হয়েছে, তারারা হচ্ছে এক একটি পরমাণুচুল্লি। এদের বুকের গভীরে বস্তুপুঞ্জ পুড়ে শক্তি উৎপন্ন হয়। আমাদের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব শক্তি আমরা পাচ্ছি একটি তারার কাছ থেকে। এই তারাটির নাম সূর্য। এটি প্রতিদিন আকাশে জ্বলে জ্বলে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় আলো ও উত্তাপ তৈরি করছে। সেই আলো ও উত্তাপের কল্যাণে বয়ে চলেছে পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ। এখানে গাছে গাছে ফুল ফোটে, পাতার আড়ালে বসে পাখি গান করে মধুর সুরে, ডানা মেলে উড়াল দেয় আকাশে, প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় ফুলে ফুলে, মাছেদের নৃত্যে আন্দোলিত হয় নদী ও সমুদ্র, বনাঞ্চল কেঁপে ওঠে চতুষ্পদ প্রাণীর পদসঞ্চালনে, ফলে-ফসলে নুয়ে পড়ে গাছের ডালসমূহ, এমনকী পৃথিবীর গর্ভ ভরে ওঠে খনিজ জ্বালানিতে। এই সবই সম্ভব হয়েছে সূর্যের অফুরান শক্তির কল্যাণে।

মানুষের মতো তারাদেরও আছে জন্ম, শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য, যৌবন-বার্ধক্য-জরা এবং অবশেষে মৃত্যু। একটি তারা যাপন করে মানুষের তুলনায় অনেক অনেক লম্বা একটি জীবন। কোনো তারা হয়তো বাঁচে মাত্র কয়েক লাখ বছর। কোনো তারা হয়তো কয়েকশ কোটি বছর থেকে শুরু করে কয়েক হাজার কোটি বছর পর্যন্ত। সূর্য একটি মাঝারি আকৃতির তারা। এটি সৌরজগতের প্রাণ। এর এখন টগবগে যৌবন। পৃথিবীকে এটি আলো আর উত্তাপ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রায় পাঁচশ কোটি বছর ধরে। বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি আরও অন্তত পাঁচশ কোটি বছর আকাশে এভাবে আলো জ্বালাবে, বিলাবে উত্তাপ। তারপর একদিন ফুরিয়ে আসবে তার ভান্ডারে সঞ্চিত জ্বালানি। বুড়ো হয়ে যাবে সে। মরে যাওয়ার আগে সে হয়ে উঠবে একটি অতিবিস্ফারিত লাল দানবতারা, রেড জায়ান্ট। দারুণ ফুলে-ফেঁপে উঠবে তার শরীর। সে বুধ ও শুক্রগ্রহকে নেবে আত্মসাৎ করে। মুখ হাঁ করে হয়তো এগিয়ে আসবে পৃথিবীকে গ্রাস করবে বলে। আজকের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বড় ও উজ্জ্বল টকটকে লাল সূর্য সেদিন বিরাট এক টিপ হয়ে জ্বলবে আকাশের কপালে। কিন্তু জগতের সেই শ্রান্ত সন্ধ্যা রবির শোভা তাকিয়ে দেখবে না কেউ। কারণ তার বহু আগেই শূন্যে উড়ে যাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল, উবে যাবে সমুদ্রসমূহ। স্বর্গসম পৃথিবী মরে গিয়ে পরিণত হবে এক উত্তপ্ত নরকে। এর পরের কয়েক কোটি বছরের মধ্যে সূর্য তার শরীরের বাইরের খোলস মহাশূন্যে উড়িয়ে দিয়ে প্রথমে হয়ে উঠবে একটি শাদা বেঁটে তারা, হোয়াইট ডোয়ার্ফ। তারপর একটি অতি ঘনীভূত কালো বামন হয়ে নিভে যাবে অবশেষে। তবে মানুষ হয়তো এর বহু আগেই উড়ে যাবে সূর্যের মতো অন্য কোনো তারার চারপাশে আবর্তনরত এমন কোনো গ্রহে, যেখানে রয়েছে জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ। সেই তারা থেকেই হয়তো সে পেয়ে যাবে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব শক্তি, খাদ্য, রসদ।

সূর্য না হয় একদিন নিভে যাবে, নিভে যাবে পৃথিবীর জীবনপ্রদীপও। কিন্তু সমগ্র মহাবিশ্বে কি কোনোদিন অন্ধকার নেমে আসবে? আকাশে আকাশে যে অগুনতি তারা আর কোটি কোটি তারাবিশ্ব জ্বলছে উজ্জ্বল আলোর ফুল হয়ে, ওরা কি কোনোদিন নিভিয়ে দেবে আলোর প্রদীপ? মহাবিশ্ব কি কোনোদিন হয়ে যাবে তমিস্রার মতো? কী লেখা আছে এর কপালে?

আইনস্টাইনের সমীকরণ ব্যবহার করে আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান যে বিশ্বনকশা প্রণয়ন করেছিলেন, তা থেকে আসলে বেরিয়ে আসে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতির তিন তিনটি নকশা। এই যে গ্যালাক্সিগুলো অবিরাম ছুটে চলেছে সুদূরের পানে, মহাবিশ্বের পরিণতির ক্ষেত্রে এটিই শেষকথা নয়। মহাকর্ষ হয়তো একসময় মহাবিশ্বের প্রসারণের এই রাশ টেনে ধরবে। তাতে একসময় হয়তো প্রসারণ থেমে যাবে, শুরু হবে তার সংকোচনের পালা। বিশ্বগুলো পরস্পরের কাছাকাছি আসতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে আকাশ, হয়ে উঠবে অসহনীয় উজ্জ্বল। এমনকি রাতের আকাশও হয়ে উঠবে এখনকার সবচেয়ে উত্তপ্ত তারার চেয়েও উজ্জ্বল। গলে যেতে শুরু করবে গ্রহ, উপগ্রহ ও নক্ষত্রগুলো। মহাবিশ্ব নিজেকে গুটিয়ে নেবে দুমড়ানো কাগজের মতো। গ্যালাক্সিগুলো একদিন একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে মহাহুংকারে। বেজে উঠবে প্রলয়নিনাদ। ফুঁসে উঠবে মহাপ্রলয়ঙ্করী এক উন্মাতাল অগ্নিতরঙ্গিণী। মহাবিশ্বজুড়ে নেমে আসবে মহাবিপর্যয়। যে আগুন সেদিন জ্বলে উঠবে, তাতে পরমাণুগুলোর বাঁধন যাবে ছিঁড়ে। উড়ে পালাবে ইলেকট্রনরা। পরমাণু কেন্দ্রগুলো ভেঙে যাবে অতিপরমাণু প্রোটন ও নিউট্রনে। আরও পরে এরাও গলে যাবে তাদের মূল উপাদান কোর্য়াকে। অতিউচ্চ তাপমাত্রায় একদিন সেই কোর্য়াকও যাবে গলে। মহাবিশ্বে থাকবে না কোনো বস্তুকণা, থাকবে শুধু তেজ। তারপর একসময়, সূচনাবিন্দুর মতো, দেশহীন কালহীন এক অনন্য বিন্দুতে এসে ধসে পড়বে মহাবিশ্ব। বিজ্ঞানীরা এই মহাধসের নাম দিয়েছেন মহাসংকোচন। ইংরেজিতে যাকে বলে বিগ ক্রাঞ্চ। এই বিশ্বনকশায় বর্তমান মহাবিশ্বের এখানেই সমাপ্তি। বিশ্বতত্ত্বে এই নকশা আবৃত বিশ্বনকশা বা ক্লোজড ইউনিভার্স  নামে পরিচিত।

মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি সংক্রান্ত দ্বিতীয় নকশায় গ্যালাক্সিগুলো এত দ্রুত বেগে বাইরের দিকে বেরিয়ে যাবে যে মহাকর্ষ কখনোই প্রসারণের লাগাম টানতে পারবে না। সব গ্যালাক্সি একসময় একাকি হয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে দিগন্তের ওপারে। কোনো জ্যোতির্বিদ কোনোদিন তাঁর যন্ত্রের পর্দায় কোনো গ্যালাক্সির আলোকে আর প্রতিবিম্বিত হতে দেখবেন না। অবশ্য বিজ্ঞানীদের কোনো প্রতিনিধি যদি আদৌ সেদিন তাঁর যন্ত্রপাতি নিয়ে উপস্থিত থাকেন আকাশ দেখবেন বলে, তবে। এই নকশার নাম বিবৃত বিশ্বনকশা বা ওপেন ইউনিভার্স। আর তৃতীয় ধরনের নকশার নাম সমতল বিশ্বনকশা বা ফ্ল্যাট ইউনিভার্স। এই নকশায় মহাবিশ্ব যেমন কখনও সংকুচিত হবে না, তেমনই অনন্তকাল ধরে প্রসারিতও হবে না। বিশ্বগুলোর বাইরের দিকে ছুটে চলার বেগ একসময় হয়তো কমে আসবে, কিন্তু কখনও একেবারে থেমে যাবে না এই বেগ। সমস্ত বিশ্ব কোনোদিন দিগন্তরেখার ওপারে চলে যাবে না। কিন্তু তারার প্রদীপগুলো যেহেতু একদিন সব নিভে যাবে, দৃষ্টিগোচর হবে না কোনো বিশ্বই। অবশ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখারও হয়তো কেউ থাকবে না সেদিন।

আবৃত বিশ্বনকশায় মহাবিশ্ব দেশকালের একটি সীমায়িত পরিসর। এটি আপনাতে আপনি ঘেরা। স্টিফেন হকিং খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন এই বিষয়টি। তিনি বলেছেন, এই নকশায় মহাবিশ্ব গোল হয়ে নিজেই নিজের ওপর বেঁকে যায়, গোলকের পৃষ্ঠতলের মতো। কিন্তু এর কোনো প্রান্ত বা কিনারা নেই। এই বিশ্বনকশার উদাহরণ দেওয়া হয় পৃথিবীর পিঠের সঙ্গে। এটি একটি বদ্ধ এলাকা। কিন্তু কেউ এর ওপর অনন্তকাল ধরে ঘুরে বেড়ালেও কোনোদিন এর কিনারা খুঁজে পাবে না। এই বিশ্বের জ্যামিতি বাঁকা। ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি এখানে একশ আশি ডিগ্রির বেশি। সমান্তরাল আলোর রেখাগুলো এই বিশ্বে দূর দিগন্তে গিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মিলবে, ছেদ করে যাবে পরস্পরকে।

বিবৃত নকশায়ও মহাবিশ্বের জ্যামিতি বাঁকা। তবে সেটি অনেকটা ঘোড়ার জিনের পিঠের মতো উল্টো দিকে বেঁকে গিয়ে প্রসারিত হয়ে গেছে অসীমের দিকে। ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি এই নকশায় একশ আশি ডিগ্রির চেয়ে কম। সমান্তরাল আলোর রেখাগুলো এই বিশ্বে কখনোই পরস্পরের সঙ্গে মিলবে না, বরং ক্রমেই দূরে সরে যাবে একে অন্যের কাছ থেকে। অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হয়ে মহাবিশ্ব এগিয়ে যাবে এক শীতল মৃত্যুর দিকে। বিশ্বগুলো অবিরাম ছুটে চলবে বাইরের দিকে। একসময় ওরা সব একাকি হয়ে যাবে। তারাগুলো পুড়িয়ে শেষ করে ফেলবে তাদের পারমাণবিক জ্বলানি। একদিন ওরা নিভে যাবে সবাই, রেখে যাবে তাদের ছাইসমূহ—কালো বেঁটেতারা, নিউট্রনতারা ও কৃষ্ণবিবরদের। মহাবিশ্বজুড়ে নেমে আসবে এক পরম সুষুপ্তি। কোথাও থাকবে না একফোঁটা আলোও। থাকবে শুধু অন্ধকার।

আর সমতল বিশ্বনকশায় মহাবিশ্বের জ্যামিতি চ্যাপ্টা ধরনের, কাগজের পৃষ্ঠার মতো। এতে ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি ঠিক একশ আশি ডিগ্রি। সমান্তরাল আলোর রেখাগুলো এই বিশ্বে পরস্পরকে কখনও যেমন ছেদ করবে না, তেমনই একে অন্যের সাপেক্ষে দূরেও সরে যাবে না। এগিয়ে যাবে সমান্তরালভাবে, সমান্তরাল রেললাইন যেভাবে এগিয়ে যায় পরস্পরের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। এই দুটো নকশায়—বিবৃত ও সমতল—মহাবিশ্ব অনন্ত, অসীম।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই তিন নকশার মধ্য থেকে ঠিক কোন নকশাটি আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ধাবমান গ্যালাক্সিগুলো কি কোনোদিন তাদের বাইরের দিকে ধেয়ে চলার পালা বন্ধ করবে? যদি কোনোদিন এমন হয়, তবে আমাদের মহাবিশ্ব আবৃত। যদি বাইরের দিকে ছুটে চলা গ্যালাক্সির দলগুলো তাদের দৌড়বেগ কোনোদিন না থামায়, অনন্তকাল ধরে ছুটতে থাকে বাইরের দিকে, আর একসময় বিশ্বঝাঁকগুলোর পারস্পরিক মহাকর্ষবল শিথিল হয়ে গিয়ে ওরা সব একাকি হয়ে যায়, তবে আমাদের মহাবিশ্ব বিবৃত। আর যদি বিশ্বগুলো কোনোদিন ভেতরের দিকে ছুটেও না আসে, আবার অনন্তকাল ধরে বাইরের দিকে বেরিয়েও না যায়, তবে সে ক্ষেত্রে মহাবিশ্ব সমতল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মহাবিশ্ব আবৃত, বিবৃত না সমতল, তা ঠিকঠাক বলে দেওয়ার জন্য এর ভেতরকার মোট বস্তুর পরিমাণ খুঁজে বের করা। পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ বস্তুর খোঁজ পাওয়া গেছে, তা মহাবিশ্বের বর্তমান প্রসারণ থামানোর পক্ষে মাত্র এক শতাংশ। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এর দশগুণ বস্তু হয়তো আছে অগোচর অবস্থায়। এদেরকে বলা হয় ডার্ক ম্যাটার। কিন্তু তাতেও মহাবিশ্বের বর্তমান প্রসারণের হার কমে না।

বস্তুপুঞ্জ ছাড়াও মহাবিশ্বের বিপুল শূন্যস্থানে থাকতে পারে অগোচর শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব মতে, বস্তু ও শক্তি যেহেতু পরস্পর সমতুল, আশা করা যায়, মহাবিশ্বের অদৃষ্টের ওপর থাকবে এই লুকোনো শক্তির কার্যকর প্রভাব। বাইরের দিকে ধাবমান গ্যালাক্সিগুলোর লাগাম টেনে ধরতে এটি হবে সহায়ক। কিন্তু বিশ শতকের শেষদিকে বিজ্ঞানীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলেন, মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটছে আমাদের পূর্বেকার ধারণার চেয়ে অনেক বেশি হারে। তাঁদের ধারণা, এর পেছনে আছে এই লুকোনো শক্তি। এর প্রভাব বস্তুর ঠিক বিপরীত। বস্তুপুঞ্জ যেখানে গ্যালাক্সিঝাঁকগুলোর দৌড়ের লাগাম টেনে ধরতে পারে, মহাবিশ্বের প্রসারণকে দিতে পারে থামিয়ে, লুকোনো শক্তি সেখানে গ্যালাক্সিঝাঁকগুলোকে বিপুল বেগে ঠেলে দিতে পারে বাইরের দিকে, বাড়িয়ে দিতে পারে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার।

মহাবিশ্ব বিপুল সৃষ্টিযজ্ঞের এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ। এর সৃষ্টিশীল চরিত্র এখানে জড় পরমাণুকে উত্তীর্ণ করেছে আর এক সৃষ্টিশীল চরিত্রে, যে উপভোগ করে এর সৌন্দর্য; গড়ে তোলে সভ্যতা; উদ্ভাবন করে ভাষা-শিল্পকলা-বিজ্ঞান-দর্শন; রচনা করে কবিতা, বানায় গল্প; নক্ষত্রপুরীতে পরিচালনা করে অভিযান; আবিষ্কার করার চেষ্টা করে বৈজ্ঞানিক বিধি, যেগুলো দ্বারা মহাবিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হয়; গণনা করে এর ভবিষ্যৎ; উদ্ভাবন করে এমন নকশাগুলো, যেগুলোর মাধ্যমে মহাবিশ্বকে বোঝা যায়, ধারণা পাওয়া যায় এর উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির, আদি ও অন্তের; উপলব্ধি করার চেষ্টা করে মহাবিশ্বের মহিমাকে। এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ কোটি বছর আগে, বস্তু ও শক্তির অসীম ঘন ও অসীম উত্তপ্ত এক বিন্দুতে এক প্রচণ্ড মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে। এর পরিণতি সংক্রান্ত তিনটি নকশার একটিতে—আবৃত বিশ্বনকশায় দেখা যায়, এটি শেষ হয় এক মহাপ্রলয়ের মধ্য দিয়ে। এই নকশায় মহাবিশ্ব বিলুপ্ত হয় মহাসংকোচন নামে খ্যাত এক মহাধসে। তাতে কালেরও ঘটে এক মহাবিলুপ্তি। এক অর্থে এই নকশায় মহাবিশ্ব চিরজীবী। কারণ, কালের ব্যাপ্তি যতটুকু—মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাসংকোচন পর্যন্ত—মহাবিশ্বের আয়ুও ঠিক ততটুকুই। আর এটিই চিরকাল।

অন্য দুটো নকশায় দেখা যায়, অন্তিম পরিণতিতে সৃষ্টির এই বিশাল রঙ্গমঞ্চ তার সব প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে হয়ে যাচ্ছে অন্ধকারময়। বিবৃত নকশায় মহাবিশ্ব ঠিক বিলুপ্ত হয় না। তবে এটি মরে যায়, রেখে যায় তার হিমায়িত শব। এতে কালের সূচনাবিন্দু আছে, কিন্তু নেই কোনো সমাপ্তিবিন্দু। অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত একটি বিপুল প্রসারণশীল শূন্য হয়ে গহিন তমিস্রায় ফুলে উঠতে থাকে মহাবিশ্বের তুষারিত অবশেষ। আর সমতল মহাবিশ্বও শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকে না। তার ভাগ্যেও নেমে আসে এক অন্ধকারময় মৃত্যু। এতেও আছে কালের সূচনাবিন্দু, কিন্তু নেই তার সমাপ্তিসূচক কোনো বিন্দু। তবে মহাবিশ্বের কপালে যা-ই থাকুক না কেন—মহাপ্রলয় কিংবা হিমায়িত তমিস্রা—বিজ্ঞানীরা বলেন, সেটি লুকিয়ে আছে অতিদূর ভবিষ্যতের গর্ভে। এখনই বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, মহাবিশ্বের বিপুল অন্ধকারে তারারা আলো জ্বালাবে আরও বহু বহু কোটি বছর।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা বিভাগ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম

সূত্র: ১. আবদুল্লাহ আল-মুতী, মহাকাশে কী ঘটছে, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭

২. আবুল বাসার (অনূদিত), সময়ের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (মূল: স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দ ম্লোডিনো), সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৭

৩. জামাল নজরুল ইসলাম, কৃষ্ণবিবর, বাংলা একাডেমী ঢাকা, ১৯৮৫

৪. জামাল নজরুল ইসলাম, মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা, চট্টগ্রাম, ১৯৯৭

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা ১৪১০ বঙ্গাব্দ      

৬. Carl Sagan, Cosmos Ballantine Books,  New York, 1985

৭. Jamal N. Islam, The Ultimate Fate of the Universe., Cambridge University Press. Cambridge, 2009     

৮. Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing. New York, Atria, 2013

৯. Stephen Hawking, The Illustrated A Brief History of Time. Bantam Press.London, 2018

১০. Steven Weineberg, The First Three Minutes. Basic Books, New York, 1993