তারা ও গ্রহের পার্থক্য কী

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। ‘পৃথিবী ও আকাশ’ নামে এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

সূর্য একটি প্রকাণ্ড অগ্নিময় গোলক, যাকে কেন্দ্র করে ঘোরে পৃথিবী। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার, তবু চোখ-ধাঁধানো উজ্জল একটা চাকতির মতো লাগে। আর ২/১ মিনিট তাকালে চোখ অন্ধকার দেখতে হয়। শুধু সকালে বা সন্ধ্যের দিকে যখন দিকচক্রবালের কাছে থাকে সূর্য, তখন দেখাটা নিরাপদ। সে সময় ঘন বায়ুস্তর ভেদ করে আসে বলে সূর্যরশ্মির জৌলুষ কিছুটা কমে।

পৃথিবী আরও দূরে সরে এলে সূর্যের বাহ্যিক চেহারা কেমন হবে? আরও ছোট দেখাবে নিশ্চয়ই। যদি আরও কয়েক হাজার কোটি কিলোমিটার দূর থেকে তাকাই, তাহলে দেখাবে ক্ষুদ্র উজ্জল একটা বৃত্তের মতো। যতক্ষণই তাকাই না কেন, আমাদের চোখে ধাঁধা লাগবে না।

সূর্য থেকে দূরে, আরও দূরে সরে গেলে সেটা দেখতে হবে নির্মেঘ আকাশে দৃশ্যমান আরও অনেক নক্ষত্রের মতো।

সূর্য হলো নক্ষত্র। এত বিরাট দেখায় তার কারণ পৃথিবী অনেক কাছে। অন্য নক্ষত্রগুলো প্রত্যেকে একেকটি সূর্য। পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব অনেক।

হাজার হাজার ডিগ্রির তাপযুক্ত অগ্নিময় জ্যোতিষ্ক হলো নক্ষত্র। প্রত্যেকটি তপ্ত জিনিস আলো ছড়ায়—আলো ছড়ায় প্রদীপের অগ্নিশিখা, বিজলী বালবের গনগনে গরম সাদা তার; মেঘ থেকে চকিতে আসা বিদ্যুতের আলোয় আলো হয়ে ওঠে পৃথিবী। কিন্তু প্রদীপশিখা বা বিজলী বালবের সূত্রের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি তাপ ধরে যে কোনো নক্ষত্র। পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব তার চেয়ে কত বেশি দূরত্ব পৃথিবী থেকে অনেক নক্ষত্রের—লাখ লাখ, এমনকি কোটি নিযুত গুণ বেশি, তবু সেগুলো আমাদের চোখে পড়ে। এতে প্রমাণ হয় কি ভীষণ উজ্জ্বল শূন্যের এই অগ্নিগোলকগুলো?

আকাশে অন্য সব দেহ আছে যেগুলো নিজেরা আলো দেয় না, বড় নক্ষত্রের আলো ধার করে ছড়ায়।

সূর্যের দিকে মুখ করালে আয়না পুড়ে যাবে না, উজ্জল সূর্যালোক প্রতিফলিত করবে। সে প্রতিফলন এত তেজী যে তাকানো যায় না। আয়নায় সূর্যরশ্মির প্রতিফলন দেখা যায় বহু দূর থেকে, সঙ্কেত পাঠানোর জন্য একে ব্যবহার করে সৈন্যরা।

চাঁদের ওপরিভাগ অমসৃণ, সূর্যরশ্মির অনেকগুলোকে শুষে নেয়, অন্যগুলোকে করে বিক্ষিপ্ত, তাই কয়েকটি মাত্র রশ্মি আমাদের গোচর হয়।

শুধু আয়নাই সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত করে না; সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয় টেবিল থেকে, বই থেকে, কাচের জলাধার থেকে, দেয়ালের ছবি থেকে, গাছপালা-পাহাড়-পর্বত থেকে, ঘরে যা কিছু আছে আর রাস্তায়, সব থেকে।

সহজ একটা পরীক্ষা করতে পারো। জানলার খড়খড়ি বন্ধ করে দাও বা পর্দা টেনে দাও— রোদে ঝকঝকে ঘরের জায়গায় অন্ধকার।

অন্ধকারটা কী? আশপাশের জিনিস থেকে সূর্যরশ্মি অপ্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে না এলে আমরা বলি অন্ধকার। এবার একটা মোমবাতি ধরাও বা বিজলী বাতিটা জ্বালাও। আবার সবকিছু গোচর হল, অবশ্য সূর্যালোকে যেমন স্পষ্ট দেখা যায় তেমন নয়।

তাহলে আলো-না-ছড়ানো জিনিস আমরা শুধু দেখি এই কারণে যে তারা অন্য একটা উজ্জ্বল জিনিসের রশ্মি প্রতিফলিত করে চালান দেয় আমাদের কাছে।

আয়নায় সূর্যের প্রতিফলন আমাদের চোখে ধাঁধা লাগায় কেন? কেনই বা একই রশ্মিতে আলোকিত অন্যান্য জিনিস যেমন টেবিলে রাখা নোটবই বা বিছানার কম্বল চেয়ে দেখতে পারি বিনা অস্বস্তিতে?

ঝকঝকে মসৃণ বুকওয়ালা উজ্জ্বল জিনিস সূর্যরশ্মিকে প্রতিফলিত করে জোট বাঁধে, আর এই রশ্মির জটলা চোখে ধাঁধা লাগায়। অমসৃণ বুকওয়ালা জিনিস সূর্যরশ্মিকে প্রতিফলিত করে বিভিন্ন দিকে বিক্ষিপ্ত করে। একসঙ্গে কয়েকটি মাত্র রশ্মি চোখে লাগলে ক্ষতি হয় না।

বহির্শূন্যে অন্ধকার ও ঠাণ্ডা দেহ আছে। এদের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে কাছে হলো চাঁদ। তাহলে চাঁদ চোখে পড়ে কেন? কারণ, চাঁদের পৃষ্ঠদেশে প্রতিফলিত হয় সূর্যরশ্মি।

চাঁদের ওপরিভাগ অমসৃণ, সূর্যরশ্মির অনেকগুলোকে শুষে নেয়, অন্যগুলোকে করে বিক্ষিপ্ত, তাই কয়েকটি মাত্র রশ্মি আমাদের গোচর হয়।

সূর্য থেকে দূরত্ব হিসেবে তার গ্রহগুলোর তালিকা হলো: বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল—এগুলোর নাম হলো অন্তর্গ্রহ; বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনস, নেপচুন এবং প্লটো হলো বহিগ্রহ।

চাঁদের উপরিভাগ যদি আয়নার মতো হতো? তাহলে সূর্যের প্রতিফলন হতো অসহনীয় উজ্জ্বল, তাকানো যেত না সে দিকে। আসলে অল্পমাত্র আলো প্রতিফলিত করে চাঁদ, এর ঔজ্জ্বল্য সূর্যের তুলনায় ৪,৩৭,০০০ গুণ কম।

তোমরা হয়তো বলবে, ‘কিন্তু চাঁদ তো বেশ উজ্জ্বল, ঝকঝকে বৃত্ত বা কাস্তের মতো আমাদের কাছে দেখা দেয়। চাঁদের আলোয় অনেক কিছু দেখা যায় আর চাঁদিনী রাতে অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।’

কথাটা সত্যি। তার ব্যাখ্যা: চাঁদ হলো বড় একটা শূন্যচর। অনেক কোটি বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এর ওপরিভাগ আর সূর্যরশ্মির খুব কম অংশ পৃথিবীর দিকে প্রতিফলিত হলেও সে অংশটায় বেশ কয়েকটা রশ্মি আছে। তাই চাঁদের চাকতি উজ্জল ঠেকে আমাদের কাছে।

ঝকঝকে চাঁদিনী রাতে আমাদের চোখে পৌঁছনো সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়েছে দুই বার: প্রথমত, চাঁদ থেকে এবং দ্বিতীয়ত চাঁদের আলো-পড়া জিনিস থেকে, অর্থাৎ যে সব জিনিস আমাদের কাছে দৃশ্যমান।

চাঁদের চেয়ে ৬ গুণ বেশি আলো প্রতিফলিত করে পৃথিবী। চাঁদ থেকে দেখলে পৃথিবীকে চাঁদের চেয়ে ১৫ গুণ বড় আর ৮০ গুণ উজ্জল মনে হতো। কিন্তু পৃথিবী যে আলো প্রতিফলিত করে, অর্থাৎ পৃথিবীর ঔজ্জল্য— তার মাপ কীভাবে করলেন বিজ্ঞানীরা?

চাঁদ

অমাবস্যার সময়ে যখন ছোট সরু একটা কাস্তের মতো চেহারা চাঁদের তখন তার অনালোকিত দিকটায় একটা প্রায় দেখা না-যাওয়া রূপালি আভা থাকে। আভাটা হলো চাঁদের ওপর পৃথিবীর আলো, পৃথিবী থেকে আসা আলো প্রতিফলিত করে চাঁদ। চাঁদের রূপালি আভা হলো দুবার প্রতিফলিত রশ্মির নমুনা পৃথিবীর বুক থেকে চাঁদে, চাঁদ থেকে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে।

চন্দ্রকলার আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার উজ্জল রশ্মি মৃদু রূপালি আভা ম্লান করে দেয়, আর আমরা দেখি না সেটা।

পৃথিবী থেকে পাঠানো রূপালী আভার ঔজ্জ্বল্য মেপে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ঔজ্জ্বল্য বিচার করতে পেরেছেন।

চাঁদ থেকে পৃথিবীকে দেখলে মনে হবে ভারি সুন্দর ভাস্বর একটি দেহ।

সৌরমণ্ডলের বিন্যাস হিসেবে, অর্থাৎ সূর্য থেকে দূরত্ব হিসেবে তার গ্রহগুলোর তালিকা হলো: বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল—এগুলোর নাম হলো অন্তর্গ্রহ; বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনস, নেপচুন এবং প্লটো হলো বহিগ্রহ। বুধ, শুরু এবং প্লুটো বাদে সবগুলোর উপগ্রহ আছে।

এগুলো বড় গ্রহ। এ ছাড়া অনেক ক্ষুদে গ্রহ আছে যাদের নাম গ্রহাণুপুঞ্জ বা গ্রহিকা। অন্তগ্রহ ও বহিঃগ্রহগুলোর মধ্যে আছে গ্রহিকার একটা বেষ্টনী।

১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রহিকারা দলে ভারি হয়: সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা তখন একটি কৃত্রিম বা মানুষের সৃষ্ট গ্রহ পাঠান পৃথিবী থেকে।

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।