আমরা লাগাশের বাসিন্দা

রাতের আকাশের তলে চিত হয়ে শুয়ে থাকা আমার একটা পুরোনো অভ্যাস। ছোটবেলায় শুরু হয়েছিল। এখনো সুযোগ পেলে ছাদে গিয়ে এ কাজটা করি।

হাত-পা ছেড়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকলে মুখের ওপর ঝুঁকে আসে আদিগন্ত নক্ষত্রখচিত আকাশ। সারা আকাশ পিটপিট করে জ্বলে-নেভে। আমি আনাড়ি চোখে তাকিয়ে থাকি।

ইদানীং আমার এই রাত্রিকালীন অভ্যাসে যুক্ত হয়েছে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার মেয়ে। সে-ও আমার পাশে চিত হয়ে শুয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা তারাদের থেকে গ্রহগুলো আলাদা করার চেষ্টা করি। চেনার চেষ্টা করি কিছু অতিপরিচিত নক্ষত্রমণ্ডলী। তারাদের আমি নিজেও বেশি চিনিটিনি না। বেশির ভাগের নামধাম জানা নেই। জানতে খুব যে ইচ্ছা জাগে, তা-ও না। মনে হয়, অতিপরিচয়ের কারণে আকাশের প্রতি এই মুগ্ধতা হয়তো কমে যাবে।

আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে সপ্তর্ষিমণ্ডল। বিশাল এক প্রশ্নচিহ্ন যেন ঝুলে আছে আকাশের গায়ে। মনে হয়, দুনিয়ার আদি রহস্যের আজও যে মীমাংসা হলো না, কোনো দিনই যে হওয়ার নয়—সেই মহাজাগতিক ষড়যন্ত্র যেন আকাশজুড়ে ঘোষণা করছেন সাত ভারতীয় ঋষি।

আমি খুব চেষ্টা করি আমার মেয়েকে মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা চেনানোর। আকাশ এফোঁড়-ওফোঁড় করে শুয়ে থাকা একটা আবছা মেঘের রেখা খুঁজি আমরা আঁতিপাঁতি করে। কিন্তু কোথাও সেটা পাই না। পূর্ণিমাতে তো নয়ই, অমাবস্যার রাতেও না।

এই সরল সত্যটা আমরা মেনে নিই যে আমাদের এই রাজধানীর মোহাম্মদপুর জাকির হোসেন রোডের বাসার ছাদ থেকে কোনো দিনই মিল্কিওয়ে দেখা সম্ভব হবে না। শুধু মোহাম্মদপুর নয়, পুরো ঢাকা শহর আসলে অভিশপ্ত। বলতে কি, ঢাকার আকাশে অধিকাংশ চেনা নক্ষত্রই চোখে পড়ে না আলোর উত্পাতের কারণে। শহরের দিগন্তের অনেকটা জুড়ে আলোর আভা ছড়িয়ে থাকে। সেই আলোয় পুরো আকাশটাই সারা রাত ম্যাড়মেড়ে হয়ে থাকে। হাতে  গোনা কয়েকটি অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র ছাড়া ঢাকার আকাশে খুব বেশি জ্যোতিষ্ক দেখার অবকাশ নেই।

মানেভঞ্জন নামে এক পাহাড়ি মফস্বল শহরের কথা আমার মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। দার্জিলিংয়ের কাছে নেপাল সীমান্তের ধার ঘেঁষে এই বিদ্যুিবহীন শহরটিতে বহুদিন আগে একবার গিয়েছিলাম। রাতে শহরের অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। আকাশ ভেঙে পড়ছে অজস্র নক্ষত্রে। আক্ষরিক অর্থে তারায় তারায় থিকথিক করছিল আকাশ। একটা বিন্দুও কোথাও ফাঁকা নেই। এ রকম অদ্ভুত আকাশ আমি কোনো দিন দেখিনি। গা ছমছম করে ওঠে।

ছাদে শুয়ে থেকে আমি আর আমার মেয়ে ঠিক করি, কোনো একদিন আমরা মানেভঞ্জন শহরে আবার যাব। ওখানে এখনো বিদ্যুত্ যায়নি নিশ্চয়ই। আশা করি কোনো দিন যাবে না।

ঢাকা শহর ক্রমাগত আরও আলোকিত হয়ে উঠছে। আর ক্রমেই আকাশ থেকে একটি একটি করে নক্ষত্ররা বিদায় নিচ্ছে। বিদায় নিচ্ছে আমাদের নাগরিক অভিজ্ঞতার জগত্ থেকে। আমরা আর কোনো দিন তাদের দেখতে পাব না। কিংবা যখন পাব, দূর কোনো আলোকহীন শহরে গিয়ে, তখন চিনতে পারব না।

মনে পড়ল, ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর ঢাকায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। কোনো এক যান্ত্রিক ভুলভালের কারণে ওই দিন সারা শহরে, বলতে কি সারা দেশে, বিদ্যুত্ চলে গিয়েছিল। টোটাল ব্ল্যাকআউট। পত্রিকার ভাষায় এটাকে বলা হচ্ছিল গ্রিড বিপর্যয়। কেউ চেষ্টা করেও সেটা সারাতে পারছিল না। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনের ঘাম ছুটে গিয়েছিল। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে থাকলে তারা দপ্তর থেকে দপ্তরে অসহায় ছোটাছুটি করতে থাকে, আর ওদিকে তখন ঢাকার আকাশে একে একে জেগে উঠছে এমন অনেক নক্ষত্র, যারা প্রথমবারের মতো দেখা দিয়েছে। এই শহরের আকাশ আগে কখনো তাদের দেখেনি। কিন্তু তাদের স্বাগত জানানোর অবসর কারও ছিল না। সবাই তখন বিদ্যুত্ অফিসে ফোন করে অভিযোগ জানাতে ব্যস্ত।

আমাদের শহরের ইতিহাসে ওই দিনটা একটা দুর্যোগের দিন হিসেবে লেখা হয়ে আছে। আমিও দিনটাকে আলাদা করে দাগ দিয়ে রেখেছি, রাতের আকাশের মতো মিশমিশে কালো কালিতে দেওয়া দাগ।

প্রায় এ রকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল একবার আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। ১৯৯৪ সালের এক ভোররাতে সেখানে একটা ভূমিকম্প হয়েছিল। ফলে বিদ্যুত্ চলে গিয়েছিল সারা শহরে। ভূমিকম্পে যা হয়, শহরবাসী ছুটে বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়। কিন্তু রাস্তায় নেমে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভড়কে গিয়েছিল তারা। কাছেই গ্রিফিথ মানমন্দিরে একের পর এক টেলিফোন। লোকে ফোন করে জানাচ্ছিল তারা অদ্ভুত এক আকাশ দেখতে পাচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসবাসী আসলে অদ্ভুত বা আলাদা কিছুই দেখেনি। আলোকদূষণহীন স্বাভাবিক আকাশ দেখেছিল তারা।

আইজ্যাক আসিমভের একটা সায়েন্স ফিকশন গল্পের কাহিনি মনে পড়ে যায় আমার। খুব বিখ্যাত গল্প। বলা হয়, সব বিচারে সর্বকালের সেরা সায়েন্স ফিকশন গল্প সেটা। গল্পের নাম ‘নাইটফল’। মানে নিশিকাল। রাত নামা। গল্পে লাগাশ নামের এমন একটা গ্রহের কথা বলা হচ্ছে, যে গ্রহে কোনো দিনই রাত নামে না। ছয়টা সূর্যকে ঘিরে ঘোরে গ্রহটা। ফলে আকাশে সব সময়ই কোনো-না-কোনো সূর্য উপস্থিত। একটা সূর্য যখন দিগন্তে ডুবে যাই-যাই করছে, তখন আরও দুটো সূর্য হয়তো গনগন করছে মধ্যগগনে। এ জন্য একটা অনন্ত দিন বিরাজ করে লাগাশ গ্রহে। লাগাশবাসী কোনো দিনই রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ দেখেনি। রাত নামলে যে সারা আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়, আর সেই অন্ধকারজুড়ে নক্ষত্ররা যে পিটপিট করে জ্বলতে থাকে, সেটা তাদের জানা নেই।

এখন ব্যাপার হয়েছে কী: অনন্ত মনে হলেও লাগাশের দিনের দৈর্ঘ্য আসলে অনন্ত নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণনের এক জটিল যোগসাজশের কারণে বহুদিন পরপর একবার এমন হয় যে লাগাশ গ্রহের পাঁচটি সূর্য তখন দিগন্তে অস্ত যায়। আর যে একটিমাত্র সূর্য তখন মধ্যগগনে থাকে, সেটায় পূর্ণগ্রহণ হয়। অল্প সময়ের জন্য। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের জন্য লাগাশ গ্রহে রাত নেমে আসে। প্রতি ৩০ হাজার বছর পর পর এমনটা হয়। রাত নেমে এলে আকাশে ফুটে ওঠে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। এই অভিজ্ঞতা জীবিত কারও নেই। ফলে সবাই পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে। সামনে যা পায়, তাতেই আগুন ধরিয়ে দিতে থাকে একটু আলোর জন্য। আর এভাবে পুরো লাগাশের সভ্যতা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনার কোনো স্মৃতি কারও কোথাও থাকে না। ফলে আবার গোড়া থেকে শুরু হয় সভ্যতার যাত্রা। ৩০ হাজার বছর পর আরেকটি রাত নামার দিকে, আরেকটি ধ্বংসের দিকে চক্রাকার যাত্রা।

অদ্ভুত গল্প। কিন্তু আমি ভাবি, মাত্র ২১ বছর বয়সে আসিমভ যখন এই গল্প লিখছেন, তাঁর কি ধারণা ছিল তিনি আসলে ভবিষ্যতের পৃথিবীর কথা বলছেন? লাগাশের মতোই একটা অনন্ত দিন নেমে আসছে পৃথিবীজুড়ে। একে একে নক্ষত্ররা যেভাবে বিদায় নিচ্ছে আলোকোজ্জ্বল শহর-গ্রাম-গঞ্জের আকাশ থেকে, একদিন হয়তো সারা আকাশ খটখটে বিরান হয়ে যাবে।

ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার ৮০ শতাংশ এলাকায় এখন কখনোই রাত নামে না। সত্যিকার অন্ধকার কী জিনিস, ৮০ শতাংশ লোকের সেই অভিজ্ঞতাই হয় না। মিল্কিওয়ে তাদের কাছে একটা কাগুজে নথিমাত্র। অথচ ছোটবেলায় শুনেছিলাম, মিল্কিওয়ের আলোয় মানুষের ছায়া পড়ে।

পৃথিবীতে অর্ধেকের বেশি লোক এখন শহরে বাস করে। একদিন দুনিয়ার সব লোক শহরে বসবাস করবে। সেই দিন হয়তো পুরো গ্রহে একটাই শহর তৈরি হবে—দেশকালহীন এবং রাত্রিহীন।

আমরা সবকিছু থেকে অন্ধকার দূর করে দিতে চাই। সেটা প্রতীকী অর্থে বলি বটে। কিন্তু সত্যিকারের যেটা অন্ধকার, মানুষের জীবনে তার দরকার আছে। তার একটা বড় ভূমিকা আছে। আমি মনে করি, নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ মানুষের জন্য জরুরি। আমরা যে এক অনন্ত মহাজগতের বাসিন্দা, অগণিত জ্যোতিষ্ক ছড়ানো একটা শূন্যতায় পৃথিবীটা যে ভেসে বেড়াচ্ছে, এই গূঢ় সত্যটা না জানলে আমাদের অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণ হয় না। দিনের আকাশ কোনো দিনই সেই গূঢ় সত্য জানায় না।