আজ বিরল সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে উত্তর আমেরিকায়

সূর্যগ্রহণের কথা শুনলেই এককালে আঁতকে উঠত মানুষ। মনে করত, দেবতা রুষ্ট হয়েছে। অথচ এখন পরিস্থিতি বদলেছে। শুধু বদলাইনি, দলে দলে সূর্যগ্রহণ দেখতে যাচ্ছে মানুষ!

হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই এ ঘটনা ঘটছে। ৮ এপ্রিল, সোমবার (আজ) বিরল এক সূর্যগ্রহণ হবে। দেখা যাবে উত্তর আমেরিকা থেকে। এই সূর্যগ্রহণ দেখতেই দলে দলে উত্তর আমেরিকায় আসছে মানুষ। সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, এই সূর্যগ্রহণ বেশ বিরল। একে 'গ্রেট নর্থ আমেরিকান এক্লিপস'ও বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, কেন? এই সূর্যগ্রহণের বিশেষত্ব কী আসলে? সেটা জানতে, প্রথমে বুঝতে হবে সূর্যগ্রহণ কী।

আমরা জানি, পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ। অর্থাৎ চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। এই চাঁদ ও পৃথিবী মিলে একটি যুগ্মব্যবস্থা। এই চাঁদ-পৃথিবী আবার একসঙ্গে সূর্যকে ঘিরে ঘোরে।

এখানে মজার বিষয় হলো, সূর্যকে পৃথিবী যে তলে প্রদক্ষিণ করে, চাঁদ  সেই একই তলে পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে না। পৃথিবী সূর্যকে যে তলে প্রদক্ষিণ করে, তার একটা নাম আছে। অয়ন বৃত্ত। চাঁদের কক্ষপথ এই অয়ন বৃত্তের সঙ্গে পাঁচ ডিগ্রি কোণ করে ঘোরে। এই পাঁচ ডিগ্রি কোণের কারণেই চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য এক সরলরেখায় থাকে না। তবে ঘুরতে ঘুরতে প্রতিবছর চাঁদের কক্ষপথ দুইবার এই অয়নবৃত্তকে ছেদ করে। মানে, দুবার চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য এক সরলরেখায় চলে আসে। এ সময়ই হতে পারে গ্রহণ। আর ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের ঠিক মাঝখানে চলে এলেই ঘটে সূর্যগ্রহণ।

চাঁদ সূর্যকে ঢেকে দেয়

কিন্তু চাঁদ তো একটা ছোট জিনিস। এটা সূর্যকে ঢেকে দেয় কীভাবে? একদম সরল করে বলা যায়, চাঁদের ব্যাস সূর্যের ব্যাসের তুলনায় ৪০০ গুণ ছোট। কিন্তু পৃথিবী থেকে চাঁদের যে দূরত্ব, সূর্য আছে তার ৪০০ গুণ দূরে। সে কারণেই পৃথিবী থেকে দেখে মনে হয়, চাঁদ সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। তবে সব সময় পুরো ঢেকে দিতে পারে না। এ কারণে সূর্য কতটা ঢাকা পড়ল, তার ওপর ভিত্তি করে সূর্যগ্রহণকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

চাঁদ যদি সূর্যকে সম্পূর্ণ ঢেকে না ফেলে আংশিক ঢেকে ফেলে, তাহলে একে বলে আংশিক সূর্যগ্রহণ। ইংরেজিতে পার্শিয়াল সোলার ইক্লিপস। আবার চাঁদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। তাই এটি কখনো পৃথিবীর কাছে থাকে, তখন বড় দেখায়। কখনো আবার দূরে থাকে, তখন দেখে মনে হয় চাঁদ ছোট হয়ে গেছে।

চাঁদ যদি পৃথিবী ও সূর্যের ঠিক মাঝখানে থাকে, কিন্তু পৃথিবী থেকে খানিকটা দূরে থাকে, তখন এই ছোট চাঁদ সূর্যকে পুরো ঢেকে দিতে পারে না। এ সময় সূর্যগ্রহণ হয় বটে, তবে দেখে মনে হয়, অন্ধকার একটা গোলকের চারপাশে যেন আগুনের বলয় বা রিং ঝুলে আছে আকাশের পটে। এটাকে বাংলায় বলে বলয় গ্রাস। ইংরেজি নাম, অ্যানুলার সোলার ইক্লিপস। আর চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে, মানে পৃথিবীর কাছাকাছি থাকে, তখন পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়। ইংরেজিতে যাকে বলে টোটাল সোলার ইক্লিপস। এই আসন্ন সূর্যগ্রহণটি ঠিক তাই। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ।

প্রতি দেড় বছরে একবার পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়। তবে এ গ্রহণ সব জায়গা থেকে দেখা যায় না। শুধু সঠিক জায়গা থেকেই দেখা যায়। বর্তমান পূর্ণ সূর্যগ্রহণটি যেমন দেখা যাবে উত্তর আমেরিকা থেকে। এ অঞ্চলের তিনটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডার অধিবাসীরা এ সূর্যগ্রহণ দেখতে পারবেন। এটি প্রথম দেখা যাবে মেক্সিকোর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে, স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৭ মিনিটে। বিবিসি, সিএনএনসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪ কোটি মানুষ এই সূর্যগ্রহণ স্বচক্ষে দেখতে স্থানীয় এলাকাগুলোয় ভিড় জমাচ্ছেন। কিন্তু কেন এ নিয়ে এত আগ্রহ?

খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখা ঝুঁকিপূর্ণ। উঁহু, শুধু খালি চোখেই নয়। ক্যামেরা, বাইনোকুলার বা দুরবিন দিয়েও দেখা উচিত নয়। নাসার ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।

কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে পুরো মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় শুধু এই সূর্যগ্রহণটিই দেখা যাবে। এর আগে কানাডায় এরকম সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল ১৯৭৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। মেক্সিকোয় শেষ পূর্ণগ্রহণ দেখা গিয়েছিল ১৯৯১ সালের ১১ জুলাই। আর যুক্তরাষ্ট্রে এরকম সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট।

পরেরবার এরকম আরেকটি সূর্যগ্রহণের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও ৫৪ বছর। মানে, ফের ২০৭৮ সালে এরকম সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। মাত্র ১০০ মিনিট স্থায়ী হবে এই গ্রহণ। মাঝে যেসব সূর্যগ্রহণ হবে, সেগুলো দেখার সুযোগ থাকবে না। যেমন ২০২৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি পূর্ণসূর্যগ্রহণ হবে। তবে এটি দেখা যাবে অ্যান্টার্কটিকা থেকে। বুঝতেই পারছেন, সে জিনিস দেখার কোনো উপায় নেই।

তবে খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখা ঝুঁকিপূর্ণ। উঁহু, শুধু খালি চোখেই নয়। ক্যামেরা, বাইনোকুলার বা দুরবিন দিয়েও দেখা উচিত নয়। নাসার ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ ধরনের ফিল্টার দিয়ে দেখতে বলা হয়েছে সূর্যগ্রহণ।

কালে কালে বিভিন্ন ঘটনা ভিন্নভাবে ধরা দেয় আমাদের কাছে। তাই তো এককালের ভয়ংকর বলে বিবেচিত সূর্যগ্রহণ আজ আনোন্দৎসব। ৪ কোটি মানুষের জমায়েতকে উৎসব না বলে আর উপায় কী!

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নাসা, বিবিসি, সিএনএন, এনবিসি, উইকিপিডিয়া