সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা ধূমকেতু নিয়ে বিজ্ঞানীরা এত উত্তেজিত কেন

ধূমকেতু 3I/ATLASছবি: নাসা

সৌরজগতে প্রবেশ করেছে এক রহস্যময় অতিথি। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘3I/ATLAS’। এটি কোনো সাধারণ ধূমকেতু নয়। এর গায়ে লেখা আছে কোটি কোটি কিলোমিটার দূরের অজানা এক জগতের ইতিহাস। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এই ধূমকেতুটি এমন কিছু আচরণ করছে, যা বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। কেন এই ধূমকেতু নিয়ে এত হইচই? কী এমন লুকিয়ে আছে এর বরফশীতল বুকে?

সাধারণত ধূমকেতু ধুলো, পাথর আর বরফের তৈরি এক মহাজাগতিক বল। যখন এরা সূর্যের কাছাকাছি আসে, তখন উত্তাপে বরফ গলে গ্যাস ও ধুলোর লেজ তৈরি করে। কিন্তু ‘3I/ATLAS’ বিজ্ঞানীদের ভাবনার সব সমীকরণ ওলটপালট করে দিয়েছে।

চিলির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণের সময় বিজ্ঞানীরা এর চারপাশে নিকেলের বাষ্প বা ধোঁয়া দেখতে পেয়েছেন। প্রশ্ন হলো, নিকেল তো একধরনের ধাতু। ধাতু বাষ্পে পরিণত হতে গেলে প্রচণ্ড তাপমাত্রার প্রয়োজন। অথচ এই ধূমকেতুটি যখন শনাক্ত করা হয়, তখন সেটি সূর্য থেকে পৃথিবী যতটা দূরে, তার চেয়েও চার গুণ বেশি দূরে ছিল। মহাকাশের ওই অঞ্চলে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে। এত প্রচণ্ড ঠান্ডায় ধাতু কীভাবে গলে বাষ্প হয়ে গেল?

এই আবিষ্কারের অন্যতম গবেষক রোহান রাহাতগাঁওকর এবং টমাস পুজিয়া প্রথমে এটা বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁরা আসলে নিকেল খুঁজছিলেন না। তাঁরা শুধু দেখতে চেয়েছিলেন, এই আগন্তুক কী দিয়ে তৈরি। কিন্তু ডেটা বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেন, ধূমকেতুটি যত সূর্যের দিকে এগোচ্ছে, নিকেলের বাষ্পের পরিমাণ তত বাড়ছে।

আরও পড়ুন
সাধারণত ধূমকেতু ধুলো, পাথর আর বরফের তৈরি এক মহাজাগতিক বল। যখন এরা সূর্যের কাছাকাছি আসে, তখন উত্তাপে বরফ গলে গ্যাস ও ধুলোর লেজ তৈরি করে।

ঠান্ডার মধ্যে গরম ধাতব বাষ্পের এই ধাঁধাই এখন বিজ্ঞানীদের প্রধান গবেষণার বিষয়। এটি কি ভিনগ্রহের কোনো অজানা রসায়ন, নাকি আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে নতুন কিছু?

মানব ইতিহাসের রেকর্ডে এটি মাত্র তৃতীয় বস্তু, যা সৌরজগতের বাইরে থেকে আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছে। এর আগে আমরা পেয়েছিলাম ‘ওমুয়ামুয়া’ এবং ‘বরিসভ’ নামে দুই অতিথিকে। কিন্তু ‘3I/ATLAS’ এদের চেয়েও বেশি কিছু শেখাতে পারে আমাদের।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ধূমকেতুটি আমাদের সৌরজগতের চেয়েও পুরোনো হতে পারে। সৌরজগতের বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। আর এই আগন্তুক হয়তো তার চেয়েও বেশি সময় ধরে মহাকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এর ভেতরে জমে থাকা রাসায়নিক উপাদানগুলো হয়তো সেই সময়ের সাক্ষী, যখন সূর্য বা পৃথিবী জন্মই নেয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড্যারিল জেড সেলিগম্যান বলেন, ‘এ ধরনের বিরল ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। কারণ, আমরা চাইলেই অন্য কোনো নক্ষত্রমণ্ডলে গিয়ে সেখানকার পাথর বা মাটি পরীক্ষা করে আসতে পারি না। আমাদের প্রযুক্তি এখনো অতটা উন্নত হয়নি। কিন্তু প্রকৃতি যখন দয়া করে ভিনদেশি কোনো বস্তুকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়, তখন সেটাকে ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেলার সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?’

আরও পড়ুন
সৌরজগতের বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। আর এই আগন্তুক ধূমকেতু হয়তো তার চেয়েও বেশি সময় ধরে মহাকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

অবশ্য এটা নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিজ্ঞানীদের হাতে কিন্তু খুব বেশি সময় নেই। কারণ, এই ধূমকেতুটি আমাদের সৌরজগতে স্থায়ীভাবে থাকবে না। সূর্যের পাশ দিয়ে ঘুরে আবার হারিয়ে যাবে মহাকাশের অনন্ত অসীম অন্ধকারে। হয়তো আর কোনো দিন ফিরেও আসবে না।

তাই বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এখন টেলিস্কোপ তাক করে বসে আছেন এর দিকে। ধূমকেতুটি যত সূর্যের কাছে আসছে, তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর ভেতরে নানা ধরনের থার্মোডাইনামিক পরিবর্তন হচ্ছে। এটি নিয়ে আরও গবেষণা করলে হয়তো জানা যাবে, এটি কোন নক্ষত্রে জন্মেছিল, কীভাবে এটি গঠিত হয়েছিল এবং কেনই বা এটি তার নিজের জগত ছেড়ে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এই গবেষণা থেকে হয়তো জানা যাবে, মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে প্রাণের বা পদার্থের রসায়ন আমাদের চেয়ে কতটা আলাদা। ‘3I/ATLAS’ শুধু একটি ধূমকেতু নয়, এটি একটি মহাজাগতিক রহস্যময় বস্তু। আমরা কি পারব এর ভাষা পুরোপুরি উদ্ধার করতে? নাকি রহস্যটা রহস্যই থেকে যাবে? উত্তরটা সময়ই বলে দেবে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

তথ্যসূত্র: এনপিআর ও অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারস

আরও পড়ুন