সূর্যের সাতকাহন

সূর্য আমাদের সবচেয়ে কাছে নক্ষত্র। শুধু কি তাই? পৃথিবীর কোটি কোটি প্রাণের জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ আর আলো তৈরি হচ্ছে সূর্যের বুকে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে অবিরত ঘুরছে। প্রকৃতির বর্ণিল রূপ, ঋতু পরিক্রমা সবকিছুর পিছনে আছে সূর্যের ভূমিকা।

পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্য সম্পর্কে জেনেছেন। এখনও অনেককিছু অজানা। তবে, যেটুকু আমরা জানি তাই কম বিস্ময়কর নয়। অক্সিজেন ছাড়া সূর্য কীভাবে এতো বিশাল অগ্নিগোলক হলো? সূর্যের তাপমাত্রা বা চৌম্বকক্ষেত্রই বা কেমন? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে সূর্যের এই সাতকাহনে।

কত দূরে সূর্য

পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব প্রায় ১৪ কোটি ৯৬ লাখ কিলোমিটার। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর সময় লাগে প্রায় ৮.৩ মিনিট। গড় দূরত্ব বলার কারণ, পৃথিবীর কক্ষপথ পুরোপুরি বৃত্তাকার নয়। উপবৃত্তাকার কক্ষপথের কারণে পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যকার দূরত্ব কম-বেশি হয়। উপবৃত্তের যে কেন্দ্রতে দুইটি বস্তু সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে, তাকে বলা হয় পেরিহিলন বা অনুসূর। অন্য কেন্দ্রটিকে বলা হয় অফেলিওন বা অপসূর।

পৃথিবী আর সূর্য যখন অনুসূরে থাকে, তখন এদের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ কিলোমিটার। অপসূরের বেলায় এই দূরত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ কোটি ২০ লাখ কিলো মিটার।

সূর্য জ্বলছে অক্সিজেন ছাড়াই

সূর্যে তাপ উৎপন্ন হচ্ছে থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে। এর কেন্দ্রে প্রচণ্ড তাপ ও চাপের কারণে দুইটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস জোড়া লেগে তৈরি হচ্ছে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। একে বলে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এ সময় কিছুটা ভর বিখ্যাত E=mc2 সূত্র অনুসারে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে বেরিয়ে আসে। তাই সূর্য জ্বলার জন্য অক্সিজেনের কোন প্রয়োজন পড়ে না। এখানকার মূল জ্বালানি হাইড্রোজেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, প্রতি সেকেন্ডে সূর্য প্রায় ৪২.৬ লাখ টন ভর হারাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে সূর্যের বুকে এই পরিমাণ ভর রূপান্তর হচ্ছে শক্তিতে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এই ভর সূর্যের মোট ভরের মাত্র ০.০০০০০০০০৭ শতাংশ। আরও ৫০০ কোটি বছর হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহার করে টিকে থাকতে পারবেন সূর্য।

সূর্য যত বড়

সূর্যের ব্যাস প্রায় ৬ লাখ ৯৬ হাজার কিলোমিটার, যা পৃথিবীর ব্যাসের তুলনায় প্রায় ১০৯ গুণ বেশি। তবে পুরো আয়তনের কথা চিন্তা করলে পৃথিবীর সমান প্রায় ১৩ লাখ গ্রহ অনায়েসে এটে যাবে সূর্যের মধ্যে।

সূর্যের তাপমাত্রা

সূর্যের সব স্তরের তাপমাত্রা একরকম নয়। কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সৌরপৃষ্ঠ অর্থাৎ ফটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা মাত্র ৫ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ফটোস্ফিয়ারের বাইরে সূর্যের আবহমণ্ডলের তাপমাত্রা আবার অস্বাভাবিক রকম বেশি। প্রায় ২ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। কেন এতোটা বেশি, তার সঠিক ব্যাখ্যা অবশ্য বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো নেই। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র এজন্য দায়ী বলে মনে করেন তাঁরা।

সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র

মোটামুটি ২ থেকে ৬ গাউসের মধ্য ওঠানামা করে সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের তুলনায় এটা প্রায় ১০ গুণ বেশি। তবে, এগুলো আসলে খুবই দুর্বল চৌম্বকক্ষেত্র।

সাধারণ ফ্রিজ ম্যাগনেটের চৌম্বকক্ষেত্রের মান প্রায় ১০০ গাউস। লাউড স্পিকারের যে চুম্বক ব্যবহার হয় তার চৌম্বকক্ষেত্রের মান প্রায় ১০ হাজার গাউস।

মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র দেখা যায় ম্যাগনেটার নামে পরিচিত বিশেষ ধরনের নিউট্রন নক্ষত্রে চারপাশে। এদের চৌম্বকক্ষেত্রের মান প্রায় ১,০০০,০০০ বিলিয়ন গাউস। এই ধরনের চৌম্বকক্ষেত্র পরমাণুর আকার পর্যন্ত বিকৃত করে দিতে সক্ষম।

সূর্যের বয়স

বয়স প্রায় ৪৫৭ কোটি বছর। নক্ষত্রের হিসেবে সূর্য এখন মাঝবয়সী। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, সূর্য আরও প্রায় ৫০০ কোটি বছর আলো দিবে। জীবনীকালের শেষ পর্যায়ে সূর্য পরিণত হবে রেড জায়ান্ট বা লোহিত দানব নক্ষত্রে। এ সময় বুধ ও শুক্রের কক্ষপথ জুড়ে প্রসারিত হবে সূর্য। এমনকি ওই প্রসারণ পৃথিবীর কক্ষপথ পর্যন্তও হতে পারে। এই গ্রহগুলো সূর্যের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে বলে মনে করে অনেকে।

তবে তার আগেই, এখন থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর পর, সূর্য থেকে বের হওয়া প্রচণ্ড শক্তির কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। লোহিত দানব নক্ষত্র হওয়ার ১০০ কোটি বছর পর সূর্য আরও ছড়িয়ে পড়বে। তখন হঠাৎ এক বিস্ফোরণে সূর্যের বাইরের স্তর ছিটকে বাইরে চলে যাবে। এভাবে জন্ম দিবে এক প্লানেটারি নেবুলা বা নীহারিকার। সূর্যের কেন্দ্র তখন পরিণত হবে উত্তপ্ত শ্বেতবামন নক্ষত্রে। যেটা শীতল হতে থাকবে হয়ত আরও শত শত কোটি বছর ধরে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস