বৃহস্পতিতে প্রাণ!
অনেকে মন্তব্য করেন, মাঝারি তাপমাত্রা, তরল পানি, অক্সিজেন, আবহমণ্ডল, অদ্ভুত যোগাযোগ ও সৌভাগ্যের সুবাদে এই পৃথিবী জীবনের জন্য পরিপূর্ণভাবে উপযোগী। আংশিক হলেও এটা কার্যকারণের একটি বিভ্রান্তি। পৃথিবীবাসী সর্বোত্তমভাবে পৃথিবীর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। কারণ, এখানে আমরা জন্মেছিলাম, বড় হয়েছিলাম। এই প্রাচীনতর প্রাণকাঠামো থেকে যারা ভালোভাবে মানিয়ে নিয়ে পারেনি, তারা টিকে থাকতে পারেনি। এই প্রাণ যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে উদ্ভব ঘটত? তাহলে বলা যায়, তা ওই জগৎ বা গ্রহের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকত।
পৃথিবীর সব প্রাণীই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। সবার জীব রসায়ন ও বিবর্তনীয় বংশগতি একই রকম। ফলাফল হিসেবে বলা যায়, পৃথিবীর জীববিজ্ঞানীরা মারাত্মক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি। কেননা, তাঁরা শুধু কাজ করেছেন জীববিজ্ঞানের একটি প্রকার নিয়ে, প্রাণসংগীতের একটি নিঃসঙ্গ সুর নিয়ে। হাজার হাজার আলোকবর্ষ বিস্তৃত এই ক্ষীণ রেশটি কি একমাত্র পরিপূর্ণ সুর? কিংবা এমন কি হতে পারে না যে শতকোটি কণ্ঠ অজস্র রাগ-রাগিনী ও সুরময় গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে কখনো সুর, কখনো বেসুর ঐক্যতানে জীবনসংগীত গেয়ে যাচ্ছে গ্যালক্সি থেকে গ্যালাক্সিতে?
এমনকি যদি অন্যান্য গ্রহের প্রাণও এখানকার প্রাণের মতো একই অণুরসায়নের ওপর গড়ে ওঠে, তাহলে এগুলো আমাদের পরিচিত প্রাণের মতো হবে, এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। বিবেচনা করি, পৃথিবীতে বিশাল বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগতের কথা, যারা প্রত্যেকে একই গ্রহে অবস্থান করে এবং অভিন্ন তাদের অণুজীববিজ্ঞান। যেসব প্রাণীর কথা আমরা এখানে জানি, সেগুলো থেকে অন্য গ্রহের পশু-পাখি ও উদ্ভিদ মূলগতভাবে ভিন্ন।
এগুলো থেকে আমরা বলতে পারি না, একটা বহির্জাগতিক প্রাণীকে কেমন দেখাবে? আমরা একটি ধারণার গণ্ডিতে আবদ্ধ—আমি জানি একধরনের প্রাণের কথা, পৃথিবীর প্রাণ। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখক এবং চিত্রশিল্পীরা অনেক সময় অনুমানের সাহায্যে বর্ণনা দেন অথবা ছবি আঁকেন অন্য জগতের প্রাণীর চেহারা কেমন দেখাতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, বহির্জাগতিকদের ব্যাপারে কল্পবিজ্ঞানী আর শিল্পীরা আমাদের প্রচলিত প্রাণকাঠামোর কথা মাথায় রেখে এই ধরনের প্রাণের কাঠামো তৈরি করেন। যেকোনো প্রাণের বিকাশ ঘটার জন্য একটা দীর্ঘ ধারার স্বতন্ত্র প্রায় অসম্ভব কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এটা মনে করা ঠিক নয়, অন্য গ্রহের বা অন্য কোনো স্থানের প্রাণ দেখতে হবে অনেকটা সরীসৃপ অথবা একটা কীটপতঙ্গের অথবা মানুষের মতো। এমনকি সঙ্গে থাকবে ক্ষুদ্র কসমেটিক অ্যাডজাস্টমেন্ট হিসেবে সবুজ চামড়া, বিন্দুর মতো কান এবং অ্যানটেনা।
কিন্তু তারপরও যদি অনুমানের চেষ্টা করা হয় বেশ ভিন্ন একটা ধরনকে: বৃহস্পতি হলো আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ। বৃহস্পতির মতো একটা বিশাল গ্যাসীয় গ্রহের আবহমণ্ডল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, মিথেন, পানি ও অ্যামোনিয়াতে সমৃদ্ধ থাকে। এই ধরনের গ্রহে কোনো উপযুক্ত শক্ত পৃষ্ঠ নেই। বরং একটি ঘনত্বসম্পন্ন, মেঘময় আবহমণ্ডল আছে, যার মধ্যে আকাশ থেকে জৈব অণুগুলো পড়ছে অনেকটা আমাদের পরীক্ষাগারে উত্পন্ন জৈব অণুগুলোর মতো। যেভাবে হোক, এই ধরনের গ্রহে প্রাণের প্রতিকূলে চরিত্রগত বাধা আছে। এই আবহমণ্ডল খুবই ঝঞ্ঝাপূর্ণ বা টারবুলেন্ট এবং গভীরে প্রচণ্ড উত্তপ্ত। একটা প্রাণীকে অবশ্য নিচে পড়া ও ঝলসানো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্ক হতে হবে। এই ধরনের খুবই ভিন্ন রকম একটি গ্রহে প্রাণের বিকাশ যে প্রশ্নের বাইরে নয়, এটা দেখানোর জন্য কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ই ই সাল্পটার ও কার্ল সাগান একটা হিসাব করেছিলেন। অবশ্য ওই ধরনের জায়গায় প্রাণকাঠামো কেমন হবে, নিখুঁতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। আসলে তারা দেখাতে চাচ্ছিলেন, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকানুন মেনে এই ধরনের একটি গ্রহ বা জগতে প্রাণী–অধ্যুষিত হওয়া সম্ভব হতে পারে।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে একটি জীবন্ত বস্তুকে টিকে থাকতে হলে তাকে ঝলসে যাওয়ার আগেই পুনরুত্পাদনে যেতে হবে। আশা করা যায়, পরিচলন প্রক্রিয়া তাদের বংশধরের কিছু সংখ্যককে আবহমণ্ডলের অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শীতল স্তরের দিকে নিয়ে যাবে। ওই ধরনের প্রাণীগুলো খুব ছোট হতে পারে। আমরা তাদেরকে ডাকব সিঙ্কার বলে। কিছু কিছু ফ্লোটারও হতে পারে, এগুলোর বিশাল হাইড্রোজেন বেলুনগুলোর অভ্যন্তর থেকে হিলিয়াম ও অত্যন্ত ভারী গ্যাসগুলোকে বের করে দিয়ে হাইড্রোজেন ও হালকা গ্যাসগুলোকে ধরে রাখে। অথবা তারা একটা উত্তপ্ত বায়ুভরা বেলুনও হতে পারে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ উষ্ণতা ব্যবহার করে প্লাবতাকে স্থির রাখে। যে খাদ্য এরা গ্রহণ করে, তা থেকে অর্জিত তাপশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটি করে থাকে। পরিচিত পার্থিব বেলুনের মতো, একটা ফ্লোটারকে যত গভীরে নিয়ে যাওয়া হয়, তার ওপর প্রযুক্ত প্লাবতা তত বাড়ে, যা ফ্লোটারকে ঠেলে দেয় আবহমণ্ডলের আরও উঁচু, শীতল, নিরাপদ অঞ্চলের দিকে। একটি ফ্লোটার পূর্বের তৈরি জৈব অণুগুলোকে খায়, অথবা নিজেকে তৈরি করে সূর্যের আলো ও বায়ুমণ্ডলে থেকে, পৃথিবীর উদ্ভিদেরা যেভাবে শক্তি অর্জন করে। এভাবে একটা অবস্থা পর্যন্ত বড় হবে ফ্লোটাররা, হবে আরও দক্ষ। সাল্পটার ও সাগান কল্পনা করেছিলেন, ফ্লোটাররা কিলোমিটার থেকে কিলোমিটার প্রশস্ত হবে। এত বড় যে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তিমির চেয়েও বড়, শহরের আকার–আকৃতির মতো।
ফ্লোটারগুলো নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে গ্যাসীয় পদার্থের দমকা আঘাতে, অনেকটা রামজেট অথবা রকেটের মতো। বিজ্ঞানীরা তাদেরকে অলসভাবে বিচরণশীল প্রাণী হিসেবে কল্পনা করেছিলেন, অন্তত চোখে দেখে তা–ই মনে হবে। তবে তাদের চামড়ায় থাকবে কিছু অভিযোজনক্ষম পরিবর্তনশীল বিন্যাস, যা আসলে একধরনের ছদ্মবেশ, সম্ভবত আত্মরক্ষার জন্য ফ্লোটারদের এগুলো প্রয়োজন হয়। এ রকম পরিবেশে পারস্পরিক পরিবেশগত উপযুক্ত বাস্তুস্থিতি স্থানের কারণে আরেক ধরনের প্রাণীর কথা চিন্তা করা যায়। যেমন হান্টার। এরা হলো দ্রুতগামী ও কৌশলী। ফ্লোটারদের শরীরের থাকা জৈব অণুগুলো এবং জমা করে রাখা বিশুদ্ধ হাইড্রোজেনের জন্য হান্টাররা তাদের ধরে খাবে। স্বচালিত ফ্লোটারদের থেকে প্রথম দিকের হান্টারদের বিকাশ ঘটে থাকতে পারে। সেখানে খুব বেশি হান্টাররা থাকতে পারে না। কারণ, তারা যদি সব ফ্লোটারকে খেয়ে ফুরিয়ে ফেলে, তাহলে খাদ্যের অভাবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্র মেনে নেয় এই ধরনের প্রাণকাঠামো। শিল্পকলা তাদেরকে বিভিন্ন গুণ ও সৌন্দর্য দ্বারা মনোমুগ্ধকর করে তোলে। এই ধরনের অনুমান অনুসরণে প্রকৃতি বাধ্য নয়। যদি শতকোটি প্রাণী–অধ্যুষিত জগৎ থাকে এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে, তাহলে সেখানে অন্তত কিছুসংখ্যক জগতে সিঙ্কার, ফ্লোটার, হান্টারদের মতো প্রাণীরা অধ্যুষিত হবে, যা আমাদের কল্পনায় তৈরি হয়েছে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের নিয়ম মেনে। জীববিজ্ঞান হলো এমন একটা বিজ্ঞান, তা যত না পদার্থবিজ্ঞানের মতো, তার চেয়ে বেশি ইতিহাসের মতো। বর্তমানকে বোঝার জন্য আমাদেরকে জানতে হবে অতীত এবং জানতে হবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে। জীববিজ্ঞানে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তত্ত্ব নেই, যেমন নেই ইতিহাসে। কারণগুলো একই: উভয় বিষয় এখনো খুবই জটিল আমাদের কাছে। আমরা আমাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানি অন্য ক্ষেত্রগুলো বোঝার দ্বারা।
কার্ল সাগান বলেন, ‘বহির্জাগতিক প্রাণের একটি ঘটনা হয়ত জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদেরে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে পারে। প্রথমবারের মতো জীববিজ্ঞানীরা বুঝতে পারবেন, আর কী কী ধরনের প্রাণকাঠামো সম্ভব। যখন আমরা বলি বহির্জাগতিক প্রাণের অনুসন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার মানে এই নয় যে আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি বহির্জাগতিক প্রাণের ব্যাপারে। আমরা শুধু এ কথা বলতে চাচ্ছি, এই অনুসন্ধান মহামূল্যবান। পৃথিবীতে প্রাণের প্রকৃতি এবং আর কোনো জায়গায় প্রাণ আছে কি না, তার অনুসন্ধান হলো একই প্রশ্নের দুটো দিক। তা হলো ‘আমরা কে’—তার অনুসন্ধান, যা প্রাচীন কাল থেকে মানুষ করে আসছে। আমরা এ পর্যন্ত প্রাণের একটি সুর শুনেছি। শুধু একটি ছোট্ট জগতে। কিন্তু অবশেষে আমরা শুনতে আরম্ভ করেছি মহাজাগতিক ঐক্যতানের অন্যান্য সুর, যা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা করবে।