নিঃসঙ্গ কৃষ্ণগহ্বর

সম্প্রতি একটি দলছুট কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছেন একদল বিজ্ঞানী। কৃষ্ণগহ্বরটির আবিষ্কারক যুক্তরাষ্টেরে বাল্টিমোরের স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী কৈলাশ সাহা ও তাঁর নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষক দল।

গবেষকেরা এই কৃষ্ণগহ্বরটির নাম দিয়েছেন MOA-11-191/OGLE-11-0462। এটি পৃথিবী থেকে ৫২০০ আলোবর্ষ দূরে। এর ঘটনা দিগন্তের পরিধি মাত্র ৪২ কিলোমিটার। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা কৃষ্ণগহ্বরের তুলনায় এটা ভর ও আকারে অনেক ছোট।

কৃষ্ণগহ্বরের নাম শুনলেই প্রথমে মাথায় আসে, এটি এমন এক বস্তু, যার ভেতর থেকে আলোও বের হতে পারে না। সাধারণত সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ ভারী নক্ষত্রগুলো তার জীবনকালের শেষে সব জ্বালানি পুড়িয়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর যদি সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ ভর অবশিষ্ট থাকে, তাহলে নক্ষত্রের ভেতরের বস্তুকণাগুলো খুব কাছাকাছি চলে আসে। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, মহাকর্ষীয় টান ইত্যাদি নানা কারণেই সেগুলো খুব ক্ষুদ্র একটা জায়গায় এসে জড়ো হয়। এগুলোই একসময় তৈরি করে প্রবল শক্তিশালী এক মহাকর্ষ বলের আধার। সেটা এতটাই শক্তিশালী, তার ভেতর একবার কোনো বস্তু ঢুকে পড়লে আর বেরুতে পারে না। এ ধরনের বস্তু তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয় অসীমভাবে। ফলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না আলোক রশ্মিও। সেই বস্তুটাকেই বলে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত বেশিরভাগ কৃষ্ণগহ্বর একটি নিউট্রন স্টার বা আরেকটি ব্ল্যাকহোলকে কেন্দ্র করে ঘোরে। অথবা হতে পারে সেটি কোনো গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল।

কিন্তু কৈলাশ সাহা ও তাঁর দলের আবিষ্কৃত নতুন এই কৃষ্ণগহ্বর নির্দিষ্টভাবে কোথাও স্থির থাকে না। মহাকাশে একাকী ভেসে বেড়ায়। এধরনের কৃষ্ণগহ্বরকে বলা হয় ভাসমান কৃষ্ণগহ্বর।

কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পাওয়া এমনিতেই কঠিন। কারণ কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো আলো নির্গত হয় না। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা যে সব কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছেন, তাদের মধ্যে যারা মাঝারি ধরনের তারা কোনো না কোনো নিউট্রন নক্ষত্রের সঙ্গে আছে যুগল হিসেবে। কৃষ্ণগহ্বরের প্রচণ্ড মহাকর্ষ টানের কারণে নিউট্রন নক্ষত্রের গা থেকে পদার্থ বের হয়ে কৃষ্ণগহ্বরের দিকে ছুটে যায়। এই বস্তুগুলো কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের কাছে গিয়ে পতিত হয় কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে। তখন কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে এক ধরনের উজ্জ্বল বলয় তৈরি হয়। এই বলয়ের কারণেই আমরা কৃষ্ণগহ্বরটিকে দেখতে পারি। কিন্তু একটি ভাসমান কৃষ্ণগহ্বর যেহেতু কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে যুগল হিসেবে থাকে না, তাই এর চারপাশে কোনো বলয় তৈরি হয় না। তাহলে কীভাবে এই কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে পাওয়া গেল?

এই ধরনের কৃষ্ণগহ্বর খোঁজার গ্র্যাভিটেশনাল মাইক্রোলেন্সিং। এই পদ্ধতিতে বেশি ভারী বস্তুর গা ঘেঁষে আলো আসার সময় তা সামান্য বেঁকে যায়। কারণ বেশি ভরের কারণে স্থান কালের মধ্যে বক্রতার সৃষ্টি হয়। ফলে তা আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। গ্র্যাভিটেশনাল মাইক্রোলেন্সিং আসলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে এসেছে। গ্রাভিট্যাশনাল মাইক্রোলেন্সিং শনাক্তের জন্য দুটি প্রোগ্রাম চালু আছে পৃথিবীতে। একটি হলো মাইক্রোলেন্সিং অবজারভেশন ইন অ্যাস্ট্রোফিজিকস এবং অন্যটি অপটিক্যাল গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সি এক্সপেরিমেন্ট। এই দুটি প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা মহাকাশের মাইক্রোলেন্সিংয়ের ওপর নজর রাখে। এরাই প্রথম এই MOA-11-191/OGLE-11-0462-এর মাইক্রোলেন্সিং শনাক্ত করে ২০১১ সালে। পরে কৈলাশ সাহা ও তাঁর দল হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে টানা ছয় বছর এই লেন্সিং পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, MOA-11-191/OGLE-11-0462-এর মাইক্রোলেন্সিংয়ের প্যাটার্ন সাধারন লেন্সিংয়ের চেয়ে আলাদা। কারণ সাধারণ লেন্সিংয়ে কোনো তারার সামনে দিয়ে কোনো বস্তু চলে গেলে তারাটি হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যদি লেন্সিংয়ের কারণ হয় কোনো লাল দানব বা শ্বেত বামন, তাহলে উজ্জ্বলতার স্থায়ীত্বকাল হবে খুবই কম। কিন্তু MOA-11-191/OGLE-11-0462-এর মাইক্রোলেন্সিংয়ের ঘটনায় তারার ঔজ্জ্বল্যের স্থায়ীত্ব ছিল ২৭০ দিন।

বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, কৃষ্ণগহ্বরটি সূর্যের চেয়ে প্রায় ৭ দশমিক ১ গুণ ভারী। এর অবস্থান পৃথিবী থেকে ৫ হাজার ১৫০ আলোকবর্ষ দূরে এবং সেকেন্ডে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলছে।

সূত্র: স্পেস ডট কম ও এক্সট্রিমটেক ডট কম