ট্রোজান গ্রহাণুর উদ্দেশ্যে ছুটছে লুসি

লুসি। নাসার নতুন মহাকাশযান। গত ১৬ অক্টোবর উড়ে গিয়েছে পৃথিবী ছেড়ে। লক্ষ্য তার আটটি গ্রহাণু। এর একটির অবস্থান সৌরজগতের অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট বা গ্রহাণু বেষ্টনীতে। বাকি সাতটি হলো বৃহষ্পতির ট্রোজান। ১২ বছর ধরে চলবে এই অভিযান।

গ্রহাণু বেষ্টনীর অবস্থান মঙ্গল ও বৃহষ্পতির কক্ষপথের মাঝে। অসংখ্য গ্রহাণু ও অনিয়ত আকৃতির আরও লাখো বস্তু আছে এই অঞ্চলে। আছে বামন গ্রহসহ আরও নানা কিছু। ১১ থেকে ১৯ লাখের মতো ১ কিলোমিটারের চেয়ে বড় ব্যাসবিশিষ্ট গ্রহাণু আছে এখানে। ছোট ছোট বস্তু আছে অসংখ্য। সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে এরা সবাই ঘুরছে। তবে লুসি এ অঞ্চলের একটি মাত্র গ্রহাণুর পাশ দিয়ে উড়ে যাবে। ৫২২৪৬ ডোনাল্ডজোহানসন। মার্কিন জীবাশ্মবিদ ডোনাল্ড জোহানসনের নামে এর নাম। এই নামকরণের কারণটা বেশ মজার। তবে সে কথায় পরে আসছি।

কেপ ক্যানাভেরাল থেকে লুসির উৎক্ষেপণ

লুসির পরবর্তী গন্তব্য বৃহষ্পতির সাতটি ট্রোজান গ্রহাণু। 'ট্রোজান' শব্দটি কি পরিচিত মনে হচ্ছে? স্বাভাবিক। ট্রয়ের যুদ্ধের আসল নাম ট্রোজান যুদ্ধ। গ্রিকরা ট্রোজান হর্স ব্যবহার করেছিল সে যুদ্ধে। চালাকি করে একটি কাঠের ঘোড়ায় ঢুকে বসেছিল গ্রিক যোদ্ধারা। ট্রয়ের যোদ্ধারা যখন সেই কাঠের ঘোড়া নিয়ে এল শহরের ভেতর, বেরিয়ে এল গ্রিক যোদ্ধারা। সে আরেক গল্প। আস্ত মহাকাব্য রচিত হয়েছে এ নিয়ে।

প্রসঙ্গে ফিরি। বৃহস্পতির কক্ষপথ ধরেই এ অঞ্চলের গ্রহাণুগুলো ঘোরে সূর্যকে কেন্দ্র করে। ৯ হাজার ৮শর বেশি গ্রহাণু আছে এখানে। তবে লুসি উড়ে যাবে কেবল সাতটির পাশ দিয়ে। উদ্দেশ্য, সৌরজগতে গ্রহ গঠনের ফসিল বা জীবাশ্মের তথ্য সংগ্রহ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ট্রোজান গ্রহাণুগুলো মূলত সৌরজগতের প্রথম দিকে গ্রহ গঠনের সময়, গ্রহ গঠিত হওয়ার পর বাড়তি থেকে যাওয়া পদার্থ দিয়ে গঠিত। মানে, সে সময়ের চিহ্ন আছে ওতে, যেমনটা থাকে জীবাশ্মে। তার মানে, এসব গ্রহাণু নিয়ে গবেষণা করে আরও সঠিকভাবে জানা সম্ভব, কীভাবে কী হয়েছিল সে সময়। এতদিন এ অঞ্চলে আর কোনো মহাকাশযান পাঠানো হয়নি। লুসিই প্রথম যাচ্ছে।

প্রায় ছেচল্লিশ ফিট দীর্ঘ লুসি মহাকাশযানের প্রায় ২৪ ফিট জুড়েই শুধু সৌরকোষ

লুসি নামকরণও সে কারণেই। হোমিনিন প্রজাতির এক নারীর কয়েকশ হাড়গোড় পাওয়া যায় আফ্রিকার ইথিওপিয়ায়, ১৯৭৪ সালে। এই জীবাশ্ম জীববিজ্ঞানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর আবিষ্কারক জীবাশ্মবিদ ডোনাল্ড জোহানসন। সে কারণে এ মহাকাশযানটির নাম রাখা হয়েছে লুসি। মনে আছে তো, আগেই বলেছি, গ্রহাণু বেষ্টনীর ৫২২৪৬ ডোনাল্ডজোহানসন গ্রহাণুর পাশ দিয়ে এটি উড়ে যাবে।

একেকটি মহাকাশ অভিযানের পেছনে থাকে দীর্ঘ প্রস্তুতি। লুসি মহাকাশযানের ধারণা নির্বাচন করে নাসা ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ২০১৭ সালে এটিকে ১৩তম 'ডিসকভারি ক্লাস মিশন' বা নতুন আবিষ্কার অভিযান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেই শুরু। চারটি পর্বে, অনেকগুলো ধাপে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয়েছে মহাকাশযানটিকে। তারপর, গত ১৬ অক্টোবর কেপ ক্যানাভেরাল থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।

প্রায় ছেচল্লিশ ফিট দীর্ঘ এ মহাকাশযানের প্রায় ২৪ ফিট জুড়েই শুধু এর সৌরকোষ। বারো বছরের এ অভিযানে লুসিকে শক্তি যোগানোর মূল কাজ করবে এটি। আর, প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য রয়েছে নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্র। কোনোটি গ্রহাণুপৃষ্ঠের বিভিন্ন পদার্থ, বরফ, সিলিকেট ইত্যাদির শোষণ বর্ণালী খুঁজে বেড়াবে, তো কোনোটি তৈরি করবে বিস্তারিত মানচিত্র। কোনোটি মাপবে তাদের তাপীয় জড়তা ইত্যাদি। শোষণ বর্ণালীকে বলা যায় মৌলের হাতের ছাপ। এমন অন্যন্য চিহ্ন, যা দেখে ঠিক ঠিক শনাক্ত করা যায় মৌলের নাম-পরিচয়। তাপীয় জড়তা, একটি গ্রহাণু কী হারে তাপ ধরে রাখছে ও কী হারে বিকিরণ করছে ইত্যাদি তথ্য থেকে জানা যাবে, গ্রহটির আভ্যন্তরীণ গঠন কেমন।

২০২৪ সাল পর্যন্ত লুসি পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরবে। তারপর পৃথিবীর মহাকর্ষকে কাজে লাগিয়ে ছুট দেবে গ্রহাণুদের উদেশ্যে, আনুমানিক ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। ২০২৫ সালের ২০ এপ্রিল এটি পৌঁছাবে ৫২২৪৬ ডোনাল্ডজোহানসনের কাছে। সেখান থেকে প্রথম ট্রোজান গ্রহাণু ৩৫৪৮ ইউরিবেটস-এ পৌঁছাবে আনুমানিক ২০২৭ সালের ১২ আগস্ট। এ অভিযানের সব কাজ শেষ হবে আনুমানিক ২০৩৩ সালের মার্চে।

এরপরের সময়টা বোনাস। যতদিন লুসি সক্রিয় থাকবে, ঘুরে বেড়াবে বিভিন্ন গ্রহাণুর পাশে পাশে, সংগ্রহ করবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য। তারপর জীবন ফুরিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে অগণিত গ্রহাণুর ভীড়ে, মহাকাশের বিশালতায়।

সূত্র: নাসা, লুসি ডট এসডব্লিউআরআই ডট এডু, স্পেস ডট কম, উইকিপিডিয়া