সৌরজগতের গ্রহগুলোর আকার দ্বিগুণ হলে কী হতো?

সৌরজগতের কিছু গ্রহ এমনিতেই প্রকাণ্ড। কেমন হতো বিশাল এসব গ্রহ আরও বড় হতো? আসুন আজ একটা মজার বিষয় চিন্তা করি। সৌরজগতের এই গ্রহগুলো আকার দ্বিগুণ কল্পনা করবো। সত্যি সত্যি এমন হলে বিষয়টা কি দাঁড়াত, তা জানার চেষ্টা করবো বিজ্ঞান ব্যবহার করে। দ্বিগুণ আকারের সেই পৃথিবী বসবাসের অভিজ্ঞতাই বা কেমন হতো আমাদের? বৃহস্পতি আর কতো বড় হলে নক্ষত্রে পরিণত হতো? প্লুটো কি গ্রহের মর্যাদা পেত?

ব্যাস দ্বিগুণ হলে প্রতিটি গ্রহের ওজন হবে প্রায় ৮ গুণ। এক্ষেত্রে সূর্যের ব্যাস দ্বিগুণ করবো না। আগের মতো রেখেই কল্পনা করবো আমরা। দেখার চেষ্টা করবো দ্বিগুণ আকারের বৃহস্পতি সৌরজগতে কেমন প্রভাব ফেলবে। সূর্য কী বর্তমান আয়তন নিয়ে আমাদের এই কাল্পনিক সৌরজগতকে টিকিয়ে রাখতে পারবে? এক এক করে গ্রহগুলোর ব্যাস দ্বিগুণ কল্পনা করে পরিস্থিতি যাচাই করা যাক।

বুধ

সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহটি হলো, বুধ। আকারে আমাদের চাঁদের চেয়ে কিছুটা বড়। আকার দ্বিগুণ করলে হবে বুধ হবে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক। প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি বছর আগে গ্রহটিতে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ছিলো বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। গ্রহের আকার বড় হলে এর অভ্যন্তরীণ শক্তিও হতো বেশি। অতিরিক্ত শক্তি বের হওয়ার জন্য আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্পের মতো ঘটনা ঘটত এখনও।

শুক্র

শুক্রগ্রহের আকার প্রায় পৃথিবীর সমান। পার্থক্যটা বায়ুমণ্ডলে। পৃথিবীর চেয়ে শুক্রের বায়ুমণ্ডল বেশ ঘন। ঘনত্বের কারণে শুক্রের পৃষ্ঠে বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিমাণ ৯৫ গুণ শক্তিশালী। আকার বাড়লে ভর বাড়বে। ভর বাড়লে বাড়বে মহাকর্ষ। বেড়ে যাওয়া এই মহাকর্ষ বায়ুমণ্ডলকে পৃষ্ঠের আরও কাছে টেনে আনবে। সেক্ষেত্রে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব এতই বেশি হবে যে, এর গ্যাসীয় অবস্থা আর থাকবে না। গোটা বায়ুমণ্ডলটা পরিণত হতো তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমুদ্রে।

পৃথিবী

আকারে দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর মহাকর্ষ (পড়ুন অভিকর্ষ) হতো দ্বিগুণ। ফলে, তখন আমাদের ওজনও হতো দ্বিগুণ। এই বাড়তি ওজনের জন্য আমাদের হৃৎপিণ্ডকে দ্বিগুণ শক্তিতে রক্ত পাম্প করতে হবে। শুধু তাই না, পৃথিবীর আকার বেড়ে গেল, খেলাধুলা লাফালাফিতেও আমাদের বেশি শক্তির প্রয়োজন হতো। অতিরিক্ত জ্বালানি লাগতো যানবাহনে। মহাকাশে রকেট পাঠানো অনেক কঠিন হতো এখনকার চেয়ে। অবশ্য সুখের কথা হলো, প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হতো না এই অতিভারী পৃথিবীতে। তবে, সবকিছু এখনকার চেয়ে অনেক ভিন্ন হতো।

মঙ্গল

মঙ্গলের আকার দ্বিগুণ হলে, মঙ্গলের অবস্থা আজকের মতো হতো না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মঙ্গলে এখন বায়ুমণ্ডল প্রায় নেই। পুরো গ্রহ এক বিশাল মরুভূমি। চৌম্বকক্ষেত্র না থাকার কারণে, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল মিলিয়ে গেছে মহাশূন্যে। মঙ্গলের বর্তমান আকার পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক। আকারে দ্বিগুণ হলে এর কেন্দ্রের কোরও হতো দ্বিগুণ। ফলে, এতোদিনেও সক্রিয় থাকতো মঙ্গলের চৌম্বকক্ষেত্র। পৃথিবীর মতো মঙ্গলের অবস্থানও সৌরজগতের বাসযোগ্য অঞ্চলে। এ দুই কারণে দ্বিগুণ আকারের মঙ্গলে থাকতো পৃথিবীর মতো চমৎকার বায়ুমণ্ডল, তরল পানির নদী-নালা-সমুদ্র। উদ্ভিদ ও প্রাণীতে হয়ত ভরে থাকতো গ্রহটি।

শিল্পীর কল্পনায় দ্বিগুণ আকারের পৃথিবী

বৃহস্পতি

বৃহস্পতি সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ। আকার দ্বিগুণ হলে এটা বাকি সব গ্রহের চেয়েও প্রায় ২.৫ গুণ ভারী হতো। ৩১৮টি পৃথিবীর সমান হতো এর আকার। এই অতিদাবনীয় গ্রহের মহাকর্ষের প্রভাবে সৌরজগতের কেন্দ্র বদলে যেত। কারণ গ্রহ আসলে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। শুধু গ্রহ বা নক্ষত্র নয়, মহাবিশ্বের কোনোকিছুই অন্য একটা কিছুকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। ঘোরে দুটো বস্তুর সংযোগ রেখা বরাবর একটি সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারপাশে। এই সাধারণ ভরকেন্দ্রকে বলা হয় ব্যারিসেন্টার।

বৃহস্পতির এখন যে আকার তাতেই সূর্য আর বৃহস্পতির মাঝখানে ব্যারিসেন্টার সূর্যের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪৮ হাজার কিলোমিটার দূরে। গ্রহটির আকার বেড়ে গেলে ব্যারিসেন্টারও সূর্য থেকে দূরে সরে যেত। ফলে একধরণের বিশৃঙখলা তৈরি হতো সৌরজগতে।

তবে, বৃহস্পতি আকারে দ্বিগুণ হলেও সক্রিয় নক্ষত্রে পরিণত হতো না। বর্তমানে বৃহস্পতির যা ভর তার চেয়ে ৮৫ গুণ বেশি হলে গ্রহটি নক্ষত্রে রূপান্তরিত হতো। সক্রিয় নক্ষত্র না হলেও আকার দ্বিগুণ হলে বৃহস্পতি হয়ত বাদামি বামন নক্ষত্রে পরিণত হতো। কারণ বাদামী বামন নক্ষত্র হওয়ার জন্য বৃহস্পতিকে মাত্র ১৩ গুণ ওজন বাড়াতে হবে বর্তমানের চেয়ে।

শনি

শনিগ্রহ বড় হলে বিদায় জানাতে হতো এর অবিশ্বাস্য সুন্দর বলয়কে। দ্বিগুণ শক্তিতে আশেপাশে বস্তুকে নিজের পৃষ্ঠের দিকে টানতো গ্রহটি। বলয় তো বটেই, কাছের ৫টি চাঁদও খসে পড়তো শনির পৃষ্ঠতলে। এখনও শনি প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে এর বলয়কে। প্রতি ত্রিশ মিনিটে এক সুইমিং পুলের সমপরিমাণ পানি শনির বুকে ঝড়ে পড়ছে এর বলয় থেকে।

ইউরেনাস

সৌরজগতে বাইরের দিকে থাকা এই বরফদানোর আকার দ্বিগুণ হলে তেমন কোনো প্রভাব বোঝা যেত না। বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন সালফাইড থাকায় দুর্গন্ধের জন্য এই গ্রহের বেশ পরিচিতি আছে। হাইড্রোজেন সালফাইডের গন্ধ পচা ডিমের মতো। আকার বেড়ে গেলে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব বেড়ে যেত। ফলে বাড়তো দুর্গন্ধ! তবে, এটাও ভাবনার কারণ নেই। কারণ আর যাই হোক, পৃথিবীতে বসে আপনি সে গন্ধ মোটেই টের পেতেন না।

নেপচুন

একই কথা নেপচুনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ আকার বাড়লে নেপচুন সৌরজগতের ওপর তেমন একটা প্রভাব ফেলত না। একেবারের সৌরজগতে প্রান্তে এই বরফদানো গ্রহটির অবস্থান। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মহাকর্ষ বল বৃদ্ধি পেলে পাশের কুইপার বেল্ট থেকে প্রচুর বস্তু টেনে নিতো নিজের দিকে। ফলে, আকার ও আকৃতি বাড়ত। নেপচুন বর্তমান অবস্থাতেই কুইপার বেল্ট থেকে পৃথিবীর ভরের ৭ থেকে ১০ গুণ বস্তু শুষে নিয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

প্লুটো

মহাকাশের কোনো বস্তুকে গ্রহ হতে হলে কিছু শর্ত মানতে হয়। শুরুতে প্লুটোকে গ্রহ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পরে দেখা গেল প্লুটো গ্রহ হবার সব শর্ত পূরণ করে না। ফলে, গ্রহের তালিকা বাদ পড়ে যায় প্লুটো। আকারে দ্বিগুণ হলে প্লুটো আবারও গ্রহ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে বিজ্ঞানীদের কাছে। সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই, ভর ও মহাকর্ষ বাড়তে হবে গ্রহটির। যাতে করে চারপাশে বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরে বেড়ানো মহাজাগতিক আবর্জনা আকর্ষণ করতে পারে প্লুটো।

এতোক্ষণে আশাকরি বুঝে গেছেন, সৌরজগতের গ্রহগুলোর আকার দ্বিগুণ হলে সেটা খুব একটা ভয়ংকর কিছু হতো না। কিছুটা বিশৃঙ্খলা হতো সত্যি। কিন্তু মঙ্গলকে হয়ত তখন আমরা পেতাম একটা চমৎকার বাসযোগ্য প্রতিবেশি গ্রহ হিসেবে। সেটাই বা কম কিসে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ওয়াটইফশো ডট কম, উইকিপিডিয়া, নাসা