একদিন আমরা মঙ্গলে পৌঁছে যাব

নীল আর্মস্ট্রং, চাঁদের বুকে পা রাখা প্রথম মানুষ। ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে জন্ম নেন এই নভোচারী। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি পাইলটের লাইসেন্স পান। কোরিয়ার যুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানের পাইলট ছিলেন তিনি।

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রাখেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন এডুইন অলড্রিন। জীবদ্দশায় খুব একটা জনসমক্ষে আসেননি নীল আর্মস্ট্রং। চন্দ্র বিজয় অভিযানের পর গোটা জীবনই তিনি থেকে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। এই নিয়ে তেমন কথাবার্তাও শোনা যায়নি তাঁর কাছ থেকে। ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট ৮২ বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তিতুল্য নভোচারী।

মৃত্যুর আগে নীল আর্মস্ট্রং সর্বশেষ সাক্ষাত্কারটি দেন ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। নাসার জনসন স্পেস সেন্টার কেন্দ্রীয় ইতিহাস প্রকল্পের অংশ হিসেবে সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন ড. স্টিফেন ই অ্যামব্রোস এবং ডিআর ডগলাস ব্রঙ্কলি। সেই সাক্ষাত্কারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো এই লেখায়। ভাষান্তর করেছেন মোখলেছুর রহমান।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: প্রথমে আপনার শৈশব নিয়ে জানতে চাই। ওহাইওতে আপনার বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা কি মনে পড়ে? শুনেছি আপনি যখন খুব ছোট, তখন আপনার বাবা আপনাকে ন্যাশনাল এয়ার রেসে নিয়ে যেতেন। সেই স্মৃতিগুলো কি মনে পড়ে?

নীল আর্মস্ট্রং: হ্যাঁ। আমার বয়স ছিল তখন দুই বছর। তবে শৈশবের খুব বেশি স্মৃতি আমার মনে নেই।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: আপনার বাবার বিমান চালনার প্রতি আগ্রহ ছিল কি?

আর্মস্ট্রং: না, আমার বাবার এতে খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। শুধু আমাকে নতুন একটি অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্যই তিনি এয়ার রেসে নিয়ে যেতেন।

প্রশ্ন :

অ্যামব্রোস: কখন থেকে প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি আগ্রহী হলেন?

আর্মস্ট্রং: সম্ভবত আট বা নয় বছর বয়স থেকেই মহাশূন্যযানের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করি। বিমান, এর ডিজাইন, প্রস্তুত-সম্প­র্কিত সবকিছুই আমার পড়তে ভালো লাগত। সেই বয়সেই বিমানের নকশা তৈরির প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। যদিও পরে বিমান চালনায় মনোনিবেশ করেছিলাম। কারণ, আমার মনে হয়েছিল বিমান ডিজাইনার হতে হলে সবার আগে বিমান চালানোর দক্ষতা প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

অ্যামব্রোস: সে সময় এভিয়েশন সম্প­র্কে পড়া কোনো বইয়ের কথা কি মনে পড়ে?

আর্মস্ট্রং: সে সময় আমি এভিয়েশন-বিষয়ক অনেকগুলো সাময়িকী পড়তাম। তার মধ্যে ফ্লাইট অ্যান্ড এয়ার ট্রেইল এবং মডেল এয়ারপ্লেন নিউজ-এর কথা আমার এখনো মনে আছে।

প্রশ্ন :

অ্যামব্রোস: যতটুকু জানি, স্নাতক শেষ করার পরপরই আপনি ইন্ডিয়ানার পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৌবৃত্তি পেয়েছিলেন।

আর্মস্ট্রং: যতটুকু মনে পড়ে, হাইস্কুলে থাকা অবস্থাতেই আমাকে নেভি এভিয়েশন কলেজ (নৌ রিজার্ভ অফিসার ট্রেনিং কর্পস—এনআরওটিসি) প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। তবে আমি সঠিক তারিখটি মনে করতে পারছি না।

প্রশ্ন :

অ্যামব্রোস: যখন এই প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন কি তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়েছিল? এই প্রোগ্রামের পর নৌবাহিনী থেকে ডাক পাবেন, এমন কোনো চুক্তি?

আর্মস্ট্রং: হ্যাঁ। প্রোগ্রামটি ছিল সাত বছরের। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বরাদ্দ ছিল দুই বছর। তারপর নৌবাহিনীতে যাই। সেখানে ফ্লাইট প্রশিক্ষণ নিয়ে কমিশনপ্রাপ্ত হই। তারপর তিন বছর নিয়মিত নৌবাহিনীর সদস্যদের মতোই সক্রিয় দায়িত্ব পালন করি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি এবং সেখানে আরও দুই বছর কাটাই।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: ওহাইওতে কি আপনার প্রথম সলো ফ্লাইটটির কথা মনে পড়ে?

আর্মস্ট্রং: হ্যাঁ, কিছুটা মনে করতে পারি। অস্পষ্ট স্মৃতিতে এখনো সেই দিনটার কথা মনে পড়ে। খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল সেই সময়টুকু।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: প্রথম সলো ফ্লাইটটিতে আপনি কোথা থেকে উড্ডয়ন করেছিলেন?

আর্মস্ট্রং: এটি ছিল ওয়াপাকোনেটার একটি ঘাসযুক্ত মাঠে।

প্রশ্ন :

অ্যামব্রোস: আপনার প্রথম প্রশিক্ষক কে ছিলেন?

আর্মস্ট্রং: একজন নয়, সে সময় আমার তিনজন প্রশিক্ষক ছিলেন। প্রথমজনের নাম ফ্রাঙ্ক লুসি, দ্বিতীয়জনের নাম অবারি নুডগার্ড। তৃতীয়জন ছিলেন চক ফিনকেনবাইন।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: তাঁরাও কি ওয়াপাকোনেটার এলাকারই বাসিন্দা ছিলেন?

আর্মস্ট্রং: তাঁরা কোথায় বসবাস করতেন, আমি তা ঠিক জানি না। তবে আমি নিশ্চিত, তাঁরা খুব দূরে কোথাও বসবাস করতেন না।

প্রশ্ন :

অ্যামব্রোস: প্রথম সলো ফ্লাইটের আগে আপনি কি কোনো প্যারাস্যুট প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন?

আর্মস্ট্রং: না, আমার কোনো প্যারাস্যুট ছিল না। তবে আমার স্কোয়াড্রনের একজন ক্যালিফোর্নিয়ার এল সেন্ট্রোর এক প্যারাস্যুট স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনি আমাদের এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: আপনি কি কোনো সমস্যা ছাড়াই দ্রুত অবতরণ করতে পেরেছিলেন?

আর্মস্ট্রং: হ্যাঁ। কে-৩ থেকে অবতরণের পর একটি জিপ আমাকে বহন করে নিয়ে এসেছিল। ড্রাইভার ছিল আমার ফ্লাইং স্কুলের রুমমেট।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: স্পুটনিকের নাম আপনি প্রথম কখন জানতে পারেন? তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

আর্মস্ট্রং: পরীক্ষামূলক পরীক্ষা পাইলট সোসাইটির একটি সিম্পোজিয়ামের সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিল ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলটন হোটেলে। সময়টা সম্ভবত ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাস। আমি সম্ভবত প্রোগ্রাম চেয়ারম্যান ছিলাম, তবে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। সেই সিম্পোজিয়ামেই আমি স্পুটনিক নামটি প্রথম শুনতে পাই।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: সে সময় নভোচারী নির্বাচনের পদ্ধতি কেমন ছিল? যখন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি একজন নভোচারী হবেন, তখন আপনাকে কী ধরনের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?

আর্মস্ট্রং: আমার মনে হয় সে সময়কার ফ্লাইট মেডিসিন এবং ফ্লাইট শারীরবিদ্যা-সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি সম্পর্কে খুব বেশি জানত না। তাদের ধারণা ছিল, শারীরিক ও মানসিক উভয় কারণেই মহাশূন্যে মানুষ বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। তাই তারা সত্যিই জানত না, একজন নভোচারী মহাশূন্যে যাওয়ার আগে তাঁর কোন কোন বিষয় পরীক্ষা করা উচিত।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি যখন চাঁদে মানুষ পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন আপনার অনুভূতি কী ছিল? কেনেডির সেই বক্তৃতার কথা কি এখনো আপনার মনে আছে?

আর্মস্ট্রং: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার এখনো সেই ভাষণটির কথা স্পষ্ট মনে আছে। আমি এর রেকর্ডও বহুবার শুনেছি। এ বিষয়ে আসলে কী ঘটেছিল এবং এর পরিণতি কী হয়েছিল, তা নিয়ে আমি অনেক গল্পও পড়েছি।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: চাঁদে অবতরণের পর যখন আপনি আবার পৃথিবীতে ফিরতে শুরু করেছিলেন, তখন আপনার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল? কোনো ভয় কাজ করছিল? কারণ, দূরবর্তী কোন ভূমিতে স্প্ল্যাশডাউন হতে পারতেন বা সমুদ্রে ডুবে যেতে পারতেন। আরও ভয়ংকর কিছুও ঘটতে পারত।

আর্মস্ট্রং: সত্যি বলতে নৌবাহিনীর একজন পুরোনো সদস্য হওয়ায় আমার এ ধরনের কোনো ভয় কাজ করেনি। আমি তো মনে করি, নভোযানটি সে সময়ে পানির নিচে অবতরণ করলেই ভালো হতো।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: চাঁদে গিয়ে আদৌ পানির সন্ধান পাবেন কি না, এ-সংক্রান্ত কোনো বিতর্ক কি সে সময় ছিল? আপনারা এ ধরনের কিছু শুনেছিলেন?

আর্মস্ট্রং: আমরা আসলে প্রত্যাশাও করিনি যে চাঁদে গিয়ে আমরা পানির সন্ধান পাবই। তবে অতীতের বা গোপন পানির চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে, এমন কিছুই আমরা খুঁঁজছিলাম। আসলে সে সময় আমাদের মধ্যে কী ভাবনা কাজ করছিল, সে বিষয়ে আমার স্পষ্ট কোনো কিছু মনে নেই।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: আপনি কি মঙ্গল মিশনে যেতে আগ্রহী?

আর্মস্ট্রং: হ্যাঁ, অবশ্যই।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: আপনি কি মনে করেন সেটা সম্ভব?

আর্মস্ট্রং: হ্যাঁ। আমি মনে করি, এটি কার্যকর করা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এই মিশন খুবই ব্যয়বহুল হবে এবং সম্ভবত এখন তার উপযুক্ত সময়ও নয়। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই মঙ্গলে মিশন চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য আমরা অর্জন করতে পারব। মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকে। আমিও স্বপ্ন দেখি, একদিন আমরা মঙ্গলে পৌঁছে যাব।

প্রশ্ন :

ব্রঙ্কলি: আপনি কি আবারও মহাশূন্যে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন? যদি আবার যান, তাহলে কোন কোন কাজ করতে চান, যেগুলো আগের মিশনগুলোতে করা হয়নি?

আর্মস্ট্রং: নাসা থেকে যদি আমাকে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়, তবে সবার আগে আমি মঙ্গলে যেতে চাইব। আমি এই মিশনটির নেতৃত্ব দিতে চাই।

অনুবাদক: সাংবাদিক