ট্রানজিট পদ্ধতিতে বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কার

যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড শহরের অন্যতম কুৎসিত দালান হিসেবে বেশ খ্যাতি (!) আছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রোফিজিকস বিভাগের মূল ভবনটির। কিন্তু তারপরও ২০০৪ সালের ৮ জুন এ ভবনের ছাদেই বসেছিল দারুণ এক মিলনমেলা। উপস্থিত সবাই এসেছিলেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে। ঘড়ির কাঁটা দুপুর ছোঁয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় সূর্যের বুক চিরে ভেনাস বা শুক্র গ্রহের পথ চলা। শুক্রের ট্রানজিট বা অতিক্রমণ। এই বিরল ঘটনা ১৮৮২ সালের পর সেবারই প্রথম দেখা গিয়েছিল পৃথিবীর আকাশে।

মহাজাগতিক কোনো বস্তু (যেমন শুক্র গ্রহ) যদি বিশাল আকারের অন্য একটি বস্তু (যেমন সূর্য) ও পৃথিবীর মধ্যকার শূন্যস্থান দিয়ে সরাসরি অতিক্রম করে, এর ফলে যদি বিশাল বস্তুটির (যেমন সূর্যের) সামান্য অংশ আড়াল হয়ে যায়, তাহলে সেই ঘটনাটিকে বলা হয় ট্রানজিট বা অতিক্রমণ। (অন্য কোনো বস্তুও হতে পারে, আমরা পৃথিবীর সাপেক্ষে বলছি, তাই পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে।) অতিক্রমণ ও গ্রহণ যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ। ট্রানজিটে বিশাল বস্তুটির খুব সামান্য অংশ আড়াল হয়। অন্যদিকে গ্রহণের মাধ্যমে আড়াল করার মাত্রা হয় অনেক বেশি। এমনকি গ্রহণের মাধ্যমে বেশ ছোট আকারের বস্তু পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে বিশাল আকারের কোনো বস্তুকে। যেমনটা আমরা দেখি সূর্যগ্রহণের সময়। পুঁচকে চাঁদ ঢেকে দেয় পরাক্রমশালী সূর্যকে। মূলত সূর্য থেকে চাঁদের (এবং পৃথিবীর) দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এমনটা ঘটে। শুক্র গ্রহের ব্যাসার্ধ চাঁদের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। কিন্তু এর অবস্থান সূর্যের অনেক কাছে। তাই এ অতিক্রমণের সময় মাত্র ০ দশমিক ১ শতাংশ আলো বাধা পায়। সে জন্য গ্রহণ না হয়ে সংঘটিত হয় ট্রানজিট বা অতিক্রমণ। উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে পৃথিবী থেকে কোনোভাবেই শুক্রের এই অতিক্রমণ শনাক্ত করা সম্ভব নয়। ১৬৩৯ সালের আগে পর্যন্ত এমনটাই হয়ে আসছিল।

জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারের পোট্রেট
ছবি: উইকিপিডিয়া

জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারের হাত ধরে গ্রহগুলোর উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার আগপর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করত, এগুলো নিখুঁত বৃত্তাকার পথে ঘোরে। কেপলারের আবিষ্কৃত তিনটি সূত্রের মাধ্যমে গ্রহদের গতিপথ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। তবে মজার বিষয় হলো, কেপলারও শুক্র গ্রহের ট্রানজিট নিয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে যেতে পারেননি। নিজ চোখে দেখে যেতে পারেননি এই বিরল মহাজাগতিক ঘটনা। ট্রানজিট সংঘটিত হওয়ার কয়েক বছর আগেই তিনি পাড়ি জমান পরলোকে।

যাই হোক, ট্রানজিট দেখতে হলে তিনটি মহাজাগতিক বস্তু, যেমন পৃথিবী, সূর্য ও শুক্রকে পরস্পরের সাপেক্ষে বিশেষ অবস্থানে থাকতে হয়। এ জন্য প্রতি ২৪৩ বছরে মাত্র একবার ঘটতে দেখা যায় এ ঘটনা। বৈজ্ঞানিকভাবে সর্বপ্রথম এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন বিশ বছর বয়সী ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ জেরেমিয়া হোরকস। সে সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলেন বন্ধু উইলিয়াম ক্যাবট্রি। মজার বিষয় হলো, কয়েক শ বছর আগে হোরক্সের ব্যবহৃত সেই টেলিস্কোপের সংবেদনশীলতা অক্সফোর্ডের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাদে স্থাপন করা যন্ত্রপাতির চেয়ে বেশি ছিল!

সূর্যের বুকে শুক্রের অতিক্রমণ বেশ বিরল ঘটনা হলেও মহাবিশ্বে কিন্তু হরহামেশাই এমনটা ঘটে। অগণিত মহাজাগতিক বস্তু নিয়ত নক্ষত্রের বুক চিরে ছুটে চলেছে। এদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্যোতির্বিদরা উদ্ভাবন করেছেন গ্রহের মতো আলোহীন ক্ষুদ্র বস্তুদের অস্তিত্ব শনাক্তের এক অভাবনীয় পদ্ধতি। চলুন, এবার জেনে নেওয়া যাক এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ শনাক্ত করার ট্রানজিট মেথড বা অতিক্রমণ পদ্ধতি।

২.

অস্ট্রেলিয়ান প্ল্যানেটারি সায়েন্টিস্ট (গ্রহবিজ্ঞানী) স্টিফেন কেইনের মতে, বহিঃসৌরগ্রহের ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ‘এইচডি ২০৯৪৫৮বি আবিষ্কার’-এর আগে এবং পরে।

গ্রহটির নামের প্রথম অংশে থাকা এইচডি-এর উৎস জ্যোতির্বিদ হেনরি ড্রেপারের তৈরি নক্ষত্রের তালিকার নাম। নামের শেষ অংশে থাকা ‘২০৯৪৫৮’ সংখ্যাটি নির্দেশ করে মহাকাশে এর কো-অর্ডিনেট বা স্থানাঙ্ক। অর্থাৎ গ্রহটি যে নক্ষত্রকে ঘিরে ঘোরে, তার নাম এইচডি ২০৯৪৫৮। আর নামের শেষের বি (b) ইংরেজিতে ছোট হাতের অক্ষরে লেখা হয়। বোঝায়, এটি একটি গ্রহ। বড় হাতের অক্ষরে লেখা হলে এইচডি ২০৯৪৫৮ নক্ষত্রের সঙ্গী কোনো নক্ষত্রকে বোঝানো হতো। যেমন আলফা সেন্টাউরি এ (A) ও বি (B)। অবশ্য আলফা সেন্টাউরি বি-এর অন্য একটি নামও আছে, টোলিমান। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি।

এই গ্রহটির অবস্থান পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫০ আলোকবর্ষ। এক্সোপ্ল্যানেটটির আকার অনেকটা আমাদের বৃহস্পতির সমান। অথচ এর অবস্থান মূল নক্ষত্রের বেশ কাছে। মূল নক্ষত্রকে ঘুরে আসতে এর প্রয়োজন পড়ে মাত্র সাড়ে তিন দিন।

রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক ব্যবহার করে আগেই এইচডি ২০৯৪৫৮বি-এর অস্তিত্ব শনাক্ত করে ফেলেছিলেন বিজ্ঞানীরা। অচিরেই তাঁরা বুঝতে পারলেন, গ্রহটির বিশাল আকারের জন্য মূল নক্ষত্রের বুক চিরে এর ট্রানজিট বা অতিক্রমণ দেখতে পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে তাঁরা কাজ শুরু করেন। দুটি আলাদা দল গঠন করা হয়। দুই দলই তীক্ষ্ণ নজর রাখতে শুরু করে গ্রহটির ওপরে।

ট্রানজিট মেথডের ধারণা
ছবি: সংগৃহীত

যে সব নক্ষত্রের অবস্থান আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক দূরে, সেগুলোতে শুক্রের মতো সরাসরি টেলিস্কোপ দিয়ে ট্রানজিট পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তবে ঘুর পথে ট্রানজিট শনাক্ত করা সম্ভব। কোনো গ্রহ যখন মূল নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যায়, তখন এর উপস্থিতির জন্য সেই নক্ষত্র থেকে আসা আলো কিছুটা বাধা পায়। ফলে পৃথিবী থেকে নক্ষত্রটিকে খুব সামান্য হলেও অনুজ্জল দেখায়। বৃহস্পতির মতো বিশাল আকারের গ্রহগুলো খুব বেশি হলে মূল নক্ষত্রের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ আলো আটকাতে পারে। অন্যদিকে পৃথিবীর আকারের গ্রহের বেলায় এর মান এক শতাংশের একশ ভাগের মাত্র এক ভাগের মতো। তবে খুব সূক্ষ্মভাবে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার মান পরিমাপ করতে পারলে ঠিকই ধরা যায় ট্রানজিট। পাশাপাশি হদিস পাওয়া যায় সেখানে লুকিয়ে থাকা এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহদের।

রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক ও ট্রানজিট মেথড যুগ্মভাবে কাজে লাগিয়ে বেশ নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যায় অজানা বহিঃসৌরগ্রহের ভর ও ব্যাসার্ধ। সেখান থেকে খানিকটা হিসাব-নিকাশ করে খুব সহজেই জেনে নেওয়া যায় এর গড় ঘনত্ব।

দুই দল বিজ্ঞানীই উঠে পড়ে লাগলেন এইচডি ২০৯৪৫৮বি এক্সোপ্ল্যানেটের মূল নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা পরিমাপে। সাফল্য লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ জেনেও দুটি দলই নিরলসভাবে কাজ করে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভাগ্য কাউকেই নিরাশ করেনি। দুই দলই মূল নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা কমে যাওয়ার বিষয়টি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। উজ্জ্বলতা কমার এই ঘটনার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল-এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়। নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় বহিঃসৌরগ্রহের ট্রানজিট বা অতিক্রমণ। প্রতিষ্ঠিত হয় এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্তের ট্রানজিট পদ্ধতি।

এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্তে রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিকের খুব ভালো বিকল্প এই ট্রানজিট পদ্ধতি। প্রথম পদ্ধতিতে এক্সোপ্ল্যানেটের সত্যিকার ভরের মান জানা সম্ভব হতো না। কেবল জানা যেত এর ভরের সর্বনিম্ন মান। ট্রানজিট মেথডে এই ঝামেলা নেই। তার ওপর এই পদ্ধতিতে গ্রহের সত্যিকার ব্যাসার্ধও জানা যায়। এগুলোর বাইরেও এক্সোপ্ল্যানেটের কক্ষপথ সম্পর্কেও জানা যায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেমন পরপর দুবার মূল নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা কমে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময় নির্দেশ করে গ্রহটির পর্যায়কাল। অর্থাৎ, মূল নক্ষত্রকে একবার ঘুরে আসতে যে সময় লাগে, তা।

রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক ও ট্রানজিট মেথড যুগ্মভাবে কাজে লাগিয়ে বেশ নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যায় অজানা বহিঃসৌরগ্রহের ভর ও ব্যাসার্ধ। সেখান থেকে খানিকটা হিসাব-নিকাশ করে খুব সহজেই জেনে নেওয়া যায় এর গড় ঘনত্ব। পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহগুলোর গড় ঘনত্বের মান মোটামুটি বেশি। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই মান ৫.৫১ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার। তবে পৃথিবীর কেন্দ্রে থাকা উপাদানগুলোর ঘনত্ব এই মানের চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু পৃষ্ঠে থাকা উপাদানগুলোর ঘনত্ব তুলনামূলক কম, তাই সব মিলিয়ে গড় ঘনত্বের এই মান। আমাদের সৌরজগতের আরেকটি পাথুরে গ্রহ মঙ্গলের গড় ঘনত্বের মান ৩.৯ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার। অন্যদিকে, গ্যাসদানব গ্রহগুলোর গড় ঘনত্বের মান পাথুরে গ্রহের তুলনায় অনেক কম। এ ধরনের গ্রহদের মূল গাঠনিক উপাদান হাইড্রোজেন। তাই সামগ্রিকভাবে এগুলোর গড় ঘনত্বের মান বেশ কম। সৌরজগতের অন্যতম গ্যাসদানব গ্রহ বৃহস্পতির গড় ঘনত্বের মান যেমন মাত্র ১.৩৩ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার।

শিল্পীর কল্পনায় বৃহস্পতি গ্রহ
ছবি: সংগৃহীত

এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক বহিঃসৌরগ্রহ এইচডি ২০৯৪৫৮বি-এর দিকে। গ্রহটির ভর আমাদের বৃহস্পতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান। আর ব্যাসার্ধ দেড় গুণের চেয়ে সামান্য কম। ফলে এর গড় ঘনত্বের মান দাঁড়ায় মাত্র ০.৩৭ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার। তাই নিঃসন্দেহে একে গ্যাসদানব গ্রহ বলা যায়।

মহাশূন্যে পৌঁছানোর পর টেলিস্কোপটি নির্ধারিত কক্ষপথে অবস্থান নেয়। ৭ এপ্রিল খুলে ফেলা হয় এর ধুলারোধী আবরণ। ফলে মহাশূন্যে প্রথমবারের মতো চোখ খোলে কেপলার নভোদুরবিন। এতে থাকা আয়না তাক করা হয় আমাদের গ্যালাক্সির সিগন্যাস এবং লিরা নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে।

৩.

ট্রানজিটের জন্য নক্ষত্রের উজ্জলতা হ্রাস শনাক্ত এবং রেডিয়াল ভেলোসিটি নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা—দুটোই বেশ কঠিন কাজ। অন্যদিকে, সব গ্রহ মূল নক্ষত্রের সামনে দিয়ে ট্রানজিট সম্পন্ন করে না। আবার অনেক নক্ষত্রের রেডিয়াল ভেলোসিটির মান খুব কম। ফলে আলাদা করে শনাক্ত করা যায় না। তাই মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়ানো অগনিত বহিঃসৌরগ্রহের সবগুলোকে এ দুই পদ্ধতিতে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও জ্যোতির্বিদরা আশাবাদী। কারণ এদের সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করার পাশাপাশি বোনাস হিসেবে জানা যায় তাদের ভর, ঘনত্ব, পর্যায়কাল ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তাই জ্যোতির্বিদরা এই দুই পদ্ধতি একসঙ্গে ব্যবহার করে আরও বড় পরিসরে গ্রহ খুঁজে বের করার কাজে মনোনিবেশ করেন।

২০০৯ সালের ৭ মার্চ গভীর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে একটি রকেট যাত্রা শুরু করে মহাশূন্য পানে। এটি বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল একটি বিশেষ ধরনের স্পেস টেলিস্কোপ বা নভোদুরবিন। এর মূল কাজ ছিল মহাবিশ্বের বুকে লুকিয়ে থাকা বহিঃসৌরগ্রহদের খুঁজে বের করা। টেলিস্কোপটির নামকরণ করা হয় বিখ্যাত জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারের নাম অনুসারে—কেপলার নভোদুরবিন।

মহাশূন্যে পৌঁছানোর পর টেলিস্কোপটি নির্ধারিত কক্ষপথে অবস্থান নেয়। ৭ এপ্রিল খুলে ফেলা হয় এর ধুলারোধী আবরণ। ফলে মহাশূন্যে প্রথমবারের মতো চোখ খোলে কেপলার নভোদুরবিন। এতে থাকা আয়না তাক করা হয় আমাদের গ্যালাক্সির সিগন্যাস এবং লিরা নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। টেলিস্কোপটি একসঙ্গে এক লক্ষেরও বেশি নক্ষত্র থেকে আসা আলো বিশ্লেষণ করতে পারত। নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কেপলার খুঁজে বের করতে পারত ট্রানজিট সম্পন্নকারী এক্সোপ্ল্যানেটদের। বায়ুমণ্ডলের বাধার কারণে পৃথিবীতে বসে এই পদ্ধতিতে গ্রহ খুঁজে বের করার সম্ভাবনা খুব কম। তবে মহাকাশে এমন সীমাবদ্ধতা নেই, তাই বহিঃসৌরগ্রহ খোঁজায় অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে কেপলার টেলিস্কোপ। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির শীতকালীন সম্মেলনে টিম কেপলার ১০০০ তম বহিঃসৌরগ্রহ শনাক্তের ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি চার হাজারেরও বেশি সম্ভাব্য গ্রহের অবস্থান শনাক্ত করার কথা জানায় তারা। তবে সেগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন আরও তথ্য।

ট্রানজিট মেথড ও রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক—দুটোই মূল নক্ষত্রের কাছ দিয়ে ঘুরে চলা বড় আকারের গ্রহ শনাক্ত করার কাজে বেশ কার্যকর।
আরও পড়ুন

মাত্র সাড়ে তিন বছর কর্মক্ষম থাকার কথা ছিল এই নভোদুরবিনের। কিন্তু ৯ বছর ৭ মাস ২৩ দিন কর্মক্ষম থাকার পর, ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর এটির আয়ু শেষ হয়। ২০২৩ সালের ১৬ জুন পর্যন্ত এ নভোদুরবিনের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে সফলভাবে ২৭৭৮টি বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। পাশাপাশি আরও ২ হাজারের মতো সম্ভাব্য গ্রহের অবস্থান শনাক্ত করেছে নভোদুরবিনটি।

কেপলার মিশনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সৌরজগতের বাইরে পৃথিবীর মতো গ্রহের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। আড়াই হাজারেরও বেশি বহিঃসৌরগ্রহ শনাক্ত করার মাধ্যমে সেই লক্ষ্য পূরণে একে বেশ সফলই বলা যাবে। তবে কেপলারের মূল সফলতা অন্য জায়গায়। এ মিশনের আগপর্যন্ত গ্রহের উৎপত্তি সংক্রান্ত সব তত্ত্বই ছিল আমাদের সৌরজগৎকেন্দ্রিক। এদের যৌক্তিকতা যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না। কেপলার টেলিস্কোপের কল্যাণে খুঁজে পাওয়া প্রায় পাঁচ শতাধিক প্ল্যানেটারি সিস্টেম বা গ্রহ ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব তত্ত্ব নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণার সুযোগ তৈরি হয়। গ্রহদের গঠন রহস্য সমাধানে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে এটি।

ট্রানজিট মেথড ও রেডিয়াল ভেলোসিটি টেকনিক—দুটোই মূল নক্ষত্রের কাছ দিয়ে ঘুরে চলা বড় আকারের গ্রহ শনাক্ত করার কাজে বেশ কার্যকর। কারণ এদের বিশাল আকারের জন্য মূল নক্ষত্র থেকে আসা আলো যেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাধা পায়, তেমনি বিশাল ভরের দরুন রেডিয়াল ভেলোসিটির মানও শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট হয়। সে জন্য কম ব্যাসার্ধের কক্ষপথে পরিভ্রমণ করা বহিঃসৌরগ্রহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এই দুটি ছাড়াও গ্রহ শনাক্তের আরও কয়েকটি পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন। তবে সেগুলোর সফলতার হার খুব বেশি নয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত আবিষ্কৃত বহিঃসৌরগ্রহের সংখ্যা ছিল ৩৪৩৯টি। এর মধ্যে ৩৩১৪টিই আবিষ্কৃত হয়েছে এই দুই পদ্ধতির একটি ব্যবহার করে। পদ্ধতি দুটোর সফলতা বুঝতে এই তথ্যই বোধ হয় যথেষ্ট।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)

সূত্র: এলিজাবেথ জে টাস্কার, দ্য প্ল্যানেট ফ্যাক্টরি: এক্সোপ্ল্যানেটস অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর আ সেকেন্ড আর্থ